শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

নুনিয়া দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল। ঝোপঝাড়-জঙ্গলের গাছের ভিড়ে তার কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। সে যেন এই জঙ্গলে নিত্য আসে। এমন তার ভঙ্গি। সে যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যাচ্ছিল, যদিও মাঝেমধ্যেই পিছনে ফিরে দেখে নিচ্ছিল শাক্য তাকে অনুসরণ করতে পারছে কি-না। সে জানে, তার পক্ষে হয়তো আশেপাশের জঙ্গল কিছুই না, কিন্তু বাইরে থেকে আসা পুলিশ অফিসারের পক্ষে এই জঙ্গলই কেনিয়ার জঙ্গলের মতো। আর-একটা চিন্তা তার হচ্ছিল। বসন্তকাল। সাপেরা এই সময় গর্ত থেকে শীতঘুম শেষ করে বিষের থলিতে অনেকখানি বিষ নিয়ে বেরিয়ে পড়বে শিকারে। এই জঙ্গলে কালাচ আর চন্দ্রবোড়া নেহাত কম নেই। এমনি সময়েই তাদের খপ্পরে পড়লে ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে যেতে পারে, আর এখন তো শীত গিয়ে বসন্ত চলছে। এইসময় ওদের বিষ খুব তীব্র হয়।

চলতে চলতে একজায়গায় গিয়ে তার মনে হল, পরশু এখানেই সে একখানা বড় গাছ কাটা পড়তে দেখেছে। তার চারপাশে কিছু ডালপালাও পড়ে ছিল। কারা কেটেছে তা সে জানে না। তবে রাতের অন্ধকারে যে কাটা হয়েছে, তা জানতে তার বাকি নেই। বনরক্ষীদের মধ্যেও কেউ-কেউ এইসব চোরাকাঠুরেদের সঙ্গে যোগসাজগ রাখে। সে-কারণেই এরা এত নিশ্চিন্ত হয়ে অপরাধ করতে পারে। দু’খানা ডাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সে একবারের জন্য হাত দেখিয়ে শাক্যকে বলল, “ওয়েট জাস্ট আ মিনিট। আমি এক্ষুনি আসছি। কোথাও যাবেন না। নড়াচড়াও করবেন না বেশি।” বলে ঢুকে পড়ল বাঁ-দিকের জঙ্গলে।
শাক্য মুগ্ধ হচ্ছিল তার দায়িত্ববোধ দেখে। এইটুকু মেয়ে, কিন্তু যেভাবে গাইড করছিল তাকে যা বড়রাও অনেকসময় ঠিক করে পারে না। যদিও নুনিয়া কেন এ ভাবে জঙ্গলের এই পথে দৌড়াতে শুরু করল সে বুঝতে পারছিল না। দিনের আলো মরে আসছে দ্রুত। এরপর অন্ধকার নেমে গেলে আর উপায় থাকবে না। তখন কী যে হবে, সেই চিন্তা করেই তার বুকের ভিতর গুড়গুড় করে উঠল। মোবাইল বার করে দেখল, এখনও কানেকশন আসেনি। এই জায়গায় কাছেপিঠে সম্ভবত কোনও মোবাইল টাওয়ার নেই, সেই কারণেই এই অবস্থা। টাওয়ার পেলেই সে থানায় ফোন করবে ঠিক করল। তারপরেই সে এদিক-ওদিক তাকাল। সাবধানের মার নেই। যার পিছনে সে দৌড়াচ্ছিল, সে যদি অতর্কিতে পিছন থেকে আক্রমণ করে, তাহলে তার জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার। এই সময়েই তার মনে হল, নুনিয়া এদের চর নয় তো? তাকে এখানে রেখে সে হয়তো জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাবে। তখন শাক্য কী করবে? সে ভেবে পেল না তার এখন কী করা উচিত। অবশ্য কিছু ভাবার আগেই সে দেখল, হাতে গাছের দু’টি ভাঙা ডাল নিয়ে নুনিয়া বেরিয়ে আসছে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

বর্ষা হল সর্দি-কাশি, পেটখারাপের মরসুম, সুরক্ষিত থাকতে পাতে কী কী রাখবেন?

একটা ডাল তার হাতে দিয়ে নুনিয়া বলল, “এই ডাল হাতে রাখ। এখন সাপেদের ঘুম ভাঙার সময়। হাতে ডাল থাকলে কিছুটা অন্তত ভরসা পাবে।”
সাপ! তার পায়ে হান্টিং শ্যু নেই। জঙ্গলের গভীরে ঢুকতে হবে, সে-কথা তো তার জানা ছিল না। বুকের মধ্যে কেমন শিরশির করে উঠল শাক্যর।
নুনিয়া আবার এগিয়ে যাচ্ছিল। শাক্য তাকে জিজ্ঞাসা করল, “নুনিয়া আমরা জঙ্গল থেকে বেরুচ্ছি না-কি অন্য কোথাও যাচ্ছি?”
নুনিয়া ঘুরল তার দিকে, তারপ স্পষ্ট গলায় বলল, “জঙ্গল থেকে বেরুনো কঠিন নয়। তার জন্য চিন্তা করো না পুলিশ-সাহেব। কিন্তু ওইদিকে একজনের বিপদ। আমরা এখনই না-গেলে হয়তো কোন একজনের প্রাণ বাঁচাতে পারব না!”
“কার বিপদ?” শাক্য অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।
“তোমার পিছুন-পিছন যে জঙ্গলে দৌড়ে আসছিল, তার! আমি গাছের উপর উঠে দেখলাম, তাকে পিছন থেকে মেরে আহত করে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল একজন।”
“কী? পাভেল আহত?” প্রায় চিৎকার করে উঠল শাক্য।
“নাম জানি না। পাভেল হলে পাভেল। হ্যাঁ, তাকেই মেরে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল একজন। তাড়াতাড়ি এস।”
“কে তাকে মারল? তুমি তাকে চেন নুনিয়া?”
“আমি অনেককেই চিনি, আবার কাউকেই চিনি না। পরে নাম জেনো। আগে তোমার বন্ধুকে বাঁচাও। যদিও আমি জানি না সে আদৌ বেঁচে আছে কি-না! আর দেরি করো না, এসো। যত তাড়াতাড়ি আমাদের সেই জায়গায় পৌঁছতে হবে। অবশ্য আশার কথা হল, জায়গাটা খুব পরিচিত। আর কথা বলো না পুলিশ-সাহেব। তাড়াতাড়ি এসো।”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

পাভেলের বিপদ হয়েছে শুনে শাক্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। সে বেঁচে আছে কি-না জানা নেই। মনে মনে সে প্রার্থনা করছিল যেন পাভেল অন্তত বেঁচে থাকে। তার সঙ্গে শাক্যর প্রতিনিয়ত খিটিমিটি লাগে, ঝগড়া হয়, কিন্তু তা-ও তাকে নিজের ভাইয়ের মতো, বন্ধুর মতো মনে করে সে। পাভেলের কিছু হয়ে গেলে শাক্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। এই জঙ্গলের গভীরে সে-ই হঠকারীর মতো ঢুকেছিল। পাভেল তাকে একা যেতে দিতে চায়নি বলেই অনুসরণ করছিল। এখন তার যদি কিছু হয়ে যায়, অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খাবে। নুনিয়া আগে-আগে দ্রুত যাচ্ছিল। হাতে ডাল থাকার জন্য গতি মাঝেমাঝে শ্লথ হয়ে গেলেও শাক্যও যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি নুনিয়াকে অনুসরণ করছিল।

পাখিরা একে-একে ফিরে আসছে। জঙ্গল মুখরিত তাদের ফিরে আসার কথোপকথনে। পায়ের নীচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ হচ্ছে। বেলা ফুরিয়ে আসার সময় বলেই বসন্তের মৃদু মৃদু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আর একটু পরেই কুয়াশারা ঘুম থেকে জেগে উঠে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়বে সারা রাত ডিউটি দেওয়ার জন্য। মাথার উপর গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছিল, সেখানে কেবল নীল আর নীল। এত সুন্দর পবিত্র পৃথিবীতে কেন যে মানুষ হানাহানি-রক্তপাত ঘটায়, কে জানে!
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

কুসুমগাছটা শেষ বিকেলের আলোয় জ্বলছিল। গায়ে রক্তাভ নতুন পাতার পোশাক। তার উপর রোদ পড়ে স্বর্গীয় এক সুষমা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই স্বর্গের নীচেই পড়েছিল পাভেল। হাত-পা ছড়ানো। এক পা ভাঁজ করা। মাথার কাছটায় মাটি রক্তে ভিজে গিয়েছিল।

“ওহ্‌ মাই গড্!” বলে চোখের পলকে পাভেলের কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল শাক্য। নুনিয়া তার দিকে দেখল একবার। তারপর বলল, “আগে দেখ, বেঁচে আছে কি-না!”

শাক্য অবশ্য ততক্ষণে নাড়ি দেখতে শুরু করেছিল। নাড়ির গতি খুব ক্ষীণ। অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। মাথার পিছনটা রক্তে জ্যাবজেবে হয়ে আছে। এখনও রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্তক্ষরণ বন্ধ না-করতে পারলে পাভেলকে বাঁচানো আসম্ভব। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল শাক্যর। কেন সে পাভেলকে তখন বারণ করল না?

কিন্তু এখন সে-সব ভাবার সময় নয়। সে নুনিয়াকে বলল, “নুনিয়া, পাভেলের এত রক্তপাত হয়েছে যে নাড়ি খুব ধীরে চলছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন জঙ্গল থেকে বেরনো। আমি এই অবস্থায় পাভেলকে কোলে তুলে নিতে পারি। কিন্তু ভয় হচ্ছে নিয়ে যেতে গিয়ে ঝাঁকুনি ইত্যাদি লেগে এর কিছু না হয়ে যায়। তাহলে আমি আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। এখন দরকার স্ট্রেচারে করে একে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এখানে মোবাইল টাওয়ার নেই। আমি যে ফোন করে থানাকে জানাবো, তার উপায় নেই। তুমি যদি একটু কষ্ট করে জঙ্গলের বাইরে যাও তাহলে ভালো হয়। সেখানে ড্রাইভারজি আছেন, তাঁকে বলো, তিনি যেন থানায় ফোন করে এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করেন। যত তাড়াতাড়ি এটা করতে পারবে, তত আমার বন্ধুর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে।”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

“বেশ। কিন্তু তার আগে অর রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে। আমি জানি। আর তুমি গভর্ণমেন্টের হেলথ সেন্টারে নিয়ে যেতে পারো, তবে আমার মনে হয় আমাদের চার্চের হসপিটালে নিয়ে গেলেই ভালো। সেখানে এমার্জেন্সি আছে। হেলথ সেন্টারে সেই সুযোগ তুমি পাবে না। যাই হোক্‌, সে-সব পরে হবে। আগে তো জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে ড্রাইভারজিকে বলে সব ব্যবস্থা করি। তারপর না-হয় ভাবা যাবে। এখন আমি একটা লতা দিয়ে যাচ্ছি। এদিকে কাছেই একজায়গায় জঙ্গল হয়ে আছে। আমি দেখেছি। তুমি সেগুলি থেঁতো করে তার রস মাথার উণ্ডেড জায়গাটায় লাগিয়ে দাও। দেখবে আপাতত রক্তপড়া বন্ধ হবে। দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।” বলে দ্রুত জঙ্গলের একদিকে দৌড়ে গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে গেল।

সে চলে যেতেই শাক্য পাভেলের মাথাটা কোলের উপর তুলে নিল। তার পোশাকে রক্ত লাগছে। লাগুক। পাভেলকে যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে। লালবাজারে আসা ইস্তক তার পাভেলের সঙ্গে পরিচয়। এই পাঁচ-সাত বছরে সেই পরিচয় ক্রমে হৃদ্যতায় পরিণত হয়েছে। প্রোফেশনের ক্ষেত্রে তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়েছে, আবার গলায় জড়িয়েও ধরেছে। বন্ধুত্ব যদি ভালোবাসার আর এক নাম হয়, তাহলে তারা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসে। পাভেলের প্রেমিকাও ব্যাপারটি জানে। শাক্য তাকে বোন বলে ডাকে। আজ পাভেলের যদি কিছু হয়ে যায়, তার সামনে গিয়ে কী করে দাঁড়াবে সে? কী বলবে তাকে? শাক্যর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। সে ঈশ্বর বিশ্বাস করে না। কিন্তু আজ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল। মনে মনে কোন এক অদৃশ্য শক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “যদি সত্যিই তুমি থাকো, তাহলে পাভেলের কিছু হতে দিও না তুমি। আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও তাকে বাঁচিয়ে তোলো হে শক্তিমান!” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content