মঙ্গলবার ১ এপ্রিল, ২০২৫


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

আগের পর্বে:
শাক্যও স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে হয়তো আসবার আগে দু’বার ভাবত। কিন্তু তার মধ্যে তখন রোখ চেপে গিয়েছিল বলেই সে কোনও কিছুই না ভেবে দৌড়েছিল। এখন তাকে যদি এখানে কেউ অতর্কিত আক্রমণ করে মেরে রেখে যায়, তাহলে তার মরণান্তিক আওয়াজ শুনে পাভেল হয়তো খুঁজে খুঁজে আসবে এই স্পটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে। নাহ্‌, ফিরতে হবে।

কিন্তু ফিরবে কী ভাবে? সে তো সামনের ব্যক্তিটিকে লক্ষ্য করে দৌড়াচ্ছিল, খেয়ালও করেনি কোন পথে সে এসেছে। আর জঙ্গলে ঢোকার চেয়েও বেরোনো খুব কঠিন। পথ না চিনলে জঙ্গলেই ঘুরপাক খেয়ে মরতে হবে তাকে। ভাবতেই শরীর শিরিশির করে উঠল তার। পিছন ফিরতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। সামনের ব্যক্তিটি যদি সশস্ত্র হয় এবং আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপিসাড়ে তাকে লক্ষ্য করে, তাহলে সে অ্যাটেম্পট নিতেই পারে। আর তা নিলে তাকে বেঘোরে মারা পড়তেই হবে। কী করবে সে বুঝে উঠতে পারছিল না। কিন্তু যা করার তাকে তাড়াতাড়ি করতে হবে। তা না হলে সমূহ বিপদ। তখনই তার মনে হল, ফোন তার পকেটেই আছে। পাভেলকে সে অনায়াসেই ফোন করতে পারে। থানাতেও। মনে হতেই বুকে বল পেল সে।
ফোনে খুব বেশি টাওয়ার দেখাচ্ছে না। জঙ্গলের এত ভিতরে নেটওয়ার্ক পাওয়াটা স্বাভাবিকভাবেই মুশকিল। তবে একেবারে শূন্যও নয়। চেষ্টাচরিত্তির করা যেতেই পারে। এই ভেবে সে পাভেলকে কল করল। প্রথমবার না পেলেও, পরের বার সে রিং শুনতে পেল। পাভেল কী শুনতে পাচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছিল, তত অধৈর্য হচ্ছিল সে। পাভেল কেন ফোন তুলছে না? তাহলে কি পাভেলের কোন বিপদ হল? সে তার পিছন পিছন আসছিল, কিছুক্ষণ আগেও তার পিছনে আসার আওয়াজ শুনেছে সে। কিন্তু এখন যেখানেই থাক, সুস্থ থাকলে তার ফোন না-ধরার তো কোন কারণ নেই! তাহলে?
“তুমি কি বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছ না?”
হঠাৎ পিছন থেকে অপরিচিত গলার এই প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল শাক্য। “কে?” বলে মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল সে, তার সামনে একটা রোগা-ভোগা রুক্ষ-শুষ্ক চুলের কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে। গাত্রবর্ণ স্থানীয়দের মতো, কিন্তু চোখদুটি বেশ বড় এবং সেই চোখে এখন জিজ্ঞাসা।
“তুমি কি বেরুনোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছ না?” মেয়েটি আবার জিজ্ঞাসা করল।
“নাহ্!” এবার উত্তর দিতে দেরি হল না তার, সে বলল, “কিন্তু তুমি কে?”
“আমি যেই হই না কেন, হু আর ইউ?” মেয়েটি বেশ দার্ঢ্যের সঙ্গে প্রত্যুত্তর করল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৬: মুখোমুখি প্রথমবার /১

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৯: রাঙা হাসি রাশি রাশি

নিজের সঠিক পরিচয় দেবে কি না একবার ভাবল শাক্য। প্রথমে ভাবল গোপন করবে, কিন্তু তারপর ভাবল, নাহ্‌, সত্যি যা সেটা বলেই দেখা যাক্‌ না কেন। আর কিশোরী এখানে আছে এর অর্থ সে বেরোনোর রাস্তাও জানে। তা না হলে তাকে এই ধরণের প্রশ্ন করত না। ফলে শাক্য সঠিক পরিচয়টাই দিল।
“আমি একজন পুলিশ অফিসার।”
“তুমি এখানে কী করছ?”
“একজনের পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এসেছি। এখানে নতুন, ফলে জঙ্গল থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না!”
“জঙ্গলকে এত সহজে চেনা যায়? নতুন বলে তুমি চিনতে পারছ না সে ঠিক আছে। কিন্তু ইভেন দোজ হু আর লং-টাইম রেসিডেন্টস অফ দিস রিজিয়ন আর নট ফ্যামিলিয়র উইথ দিস জাঙ্গল। কেবল যারা আসা-যাওয়া করে নিয়মিত, তারাই জানে!”
“তুমি তো ভারি চমৎকার ইংরেজি বলো! শিখলে কোথায়?”
“চার্চের স্কুলে। কিন্তু আমি লেখাপড়া করি না। অন্য কিছু দিলে পারব না। তবে ইংরাজিটা আগের ফাদার শিখিয়েছিলেন, সেজন্য কিছু কিছু পারি। তুমি পুলিশ অফিসার কি না, তাই তোমায় চমকে দিতেই ইংরাজি বললাম!”
এত দুর্ভাবনার মধ্যেও হাসল শাক্য। বলল, “কিন্তু তোমার নামটাই জানা হল না!”
“আগে বেরুতে চাও না কি সারারাত জঙ্গলে থেকে নাম জানতে চাও?”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

ভোটস্য পরিবেদনা

মেয়েটি তো বেশ রসিক! শাক্য বলল, “না না, আমি আগে বেরুতে চাই। আমার কেমন একটা ফিল হচ্ছে!”
মেয়েটি তার কথা শুনে হাসল না। গম্ভীরভাবে বলল, “জঙ্গলে যারা অভ্যস্ত নয়, তাদের এইরকমই মনে হয়। এস আমার পিছন পিছিন, আমিই তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি!” বলে শাক্য যেদিক দিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিল সেই দিকে এগোতে লাগল।
একটু আগেও মেয়েটিকে দেখে শাক্যর খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার সে একটু ইতিস্তত করল। মেয়েটিকে বিশ্বাস করা ঠিক হচ্ছে ? মেয়েটি ইংরাজি জানে, তার মানে শিক্ষিত। তা হলে এই মেয়েটিই বা কী করছে এই গভীর জঙ্গলে? সে দাঁড়িয়ে ভাবছিল। এমনসময় মেয়েটি সম্ভবত তার পিছনে তাকে অনুসরণ করতে না দেখে একটু গিয়েই থমকে দাঁড়াল। তারপর শাক্যকে ওই রকম অবস্থায় দেখে মৃদু হাসল। বলল, “আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি ডাইনি নই। আমি নুনিয়া। আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না, বরং আমি তোমাকে হয়তো সাহায্য করতে পারি। তুমি পিশাচপাহাড়ের কালাদেওর মিস্ট্রি জানতে এসেছ, তাই তো?”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

অবাক হয়ে গেল শাক্য। মেয়েটি, যে নিজের অদ্ভুত নাম বলছে, ‘নুনিয়া’, সে জানে যে, শাক্য কোন্‌ কারণে এখানে এসেছে? এ কী থট রিডিং জানে না কি?
“তাড়াতাড়ি এসো। তুমি দৌড়াতে দৌড়াতে অনেকদূর চলে এসেছ। বেরুতেও সময় লাগবে। ভয় পেও না। আমাকে ভয় পেলে তোমারই বিপদ!” বলে সে উল্টোদিকে হাঁটতে লাগল।
শাক্যও আর দ্বিধা না করে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করল। যেভাবেই হোক আগে তাকে জঙ্গল থেকে বেরোতে হবে। —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content