মা সারদা।
একবার গড়বেতা থেকে এক ভক্ত স্বামী-স্ত্রী তাদের চারজন মেয়ে ও কোলের ছোট ছেলেকে নিয়ে হেমন্তকালে আধপাকা ধানের আল পেরিয়ে গরুর গাড়ি করে নয় ক্রোশ পথ সারা রাত চলে সকালে জয়রামবাটি পৌঁছন। জিবটে গ্রামের পূর্বপ্রান্তে বড়রাস্তায় গাড়ি রেখে দেড়মাইল মাঠ হেঁটে এসে তারা দশটার সময় শ্রীমার নতুন বাড়িতে আসেন। তখন তাদের ছেলেটি ম্যালেরিয়া জ্বরে অসুস্থ।
এ ভাবে সারা রাত ধরে গাড়িতে ও হেঁটে আসায় তারা খুবই ক্লান্ত ছিল। অপরিচিত জায়গায় লোককে জিজ্ঞাসা করে তারা অনেক কষ্টে শ্রীমায়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। মা সারদার বাড়ির লোকজন কাউকেই তারা চেনে না। কি বলবেন কিছুই বুঝতে না পেরে তারা হতচকিত হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে ভাবতে লাগল যে শ্রীমার কত কথা শুনে অনেক আশা নিয়ে তারা এসেছে। তাঁর কৃপা, দর্শন কি তারা পাবে না? কোথায় তিনি, কি করে জানা যাবে, এতো অতি ছোট লোকে ভরা একটি খড়ের বাড়ি! কিন্তু শ্রীমা ঠিকই খবর পেয়েছেন। তাদের ভেতরে ডেকে পাঠিয়েছেন। পরম স্নেহভরে তাদের শিশুকন্যাকে নিজের ঘরের বারান্দায় নিয়ে গেলেন।
আরও পড়ুন:
বিচিত্রের বৈচিত্র, গল্পবৃক্ষ, পর্ব-২: লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
শ্রীমার স্নেহময় ‘এসো মা’ ডাক শুনে আর তাঁর মুখখানি দেখে বউটির অবসন্ন মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। জলভরা চোখে শ্রীমার পায়ে প্রণাম করলে তিনি আশীর্বাদ করে হাত ধরে উঠিয়ে মুখচুম্বন করলেন। স্বামীও ভক্তিভরে শ্রীমাকে প্রণাম করলে তিনি ‘এসো বাবা’ বলে তাকেও শুভাশীষ দিলেন। ভক্ত বউটি এক এক করে তার মেয়েদের শ্রীমার চরণে প্রণাম করালো। তারাও সকলে তাঁর আশীষ পেল। নিমেষের মধ্যে শ্রীমার লীলায় যেন দৃশ্য পরিবর্তন হয়ে গেল। ভক্ত দম্পতির আর কোন চিন্তাই রইল না। শ্রীমাই যে উদ্ধারকর্ত্রী। হলই বা ছেলের অসুখ, তাতে ভয় কি? সকল বিপদ থেকে যিনি রক্ষা করেন, তারা তো তাঁরই আশ্রয়ে রয়েছেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৫: সাফল্য কি বংশগত উত্তরাধিকার? না কি ব্যক্তিগত কৃতিত্বের প্রমাণ?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৮: লক্ষ্মীস্বরূপিনী মা সারদা
শ্রীমা নিজের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে দিলেন, শিশুটিকে শোওয়াবার জন্য। আর বাকি সকলের বিশ্রামের ব্যবস্থাও মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে গেল। তাই নয়, শিশুটিকে দুধ খাইয়ে তাকে ওষুধও দেওয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ভক্ত মহিলার সঙ্গে শ্রীমার ঘরের অন্য মহিলাদের ভাব জমে উঠল। খানিকবাদে দেখা গেল যে মহিলাটি কলসি কাঁখে নিয়ে অন্য মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করতে করতে বাঁড়ুজ্যেদের পুকুরে স্নান করতে চলেছে। আর তার স্বামী বাইরের ঘরে পুরুষদের সঙ্গে মজলিস জমিয়েছে। পরে তাদের সঙ্গে সেও স্নান সেরে নিল। ঠাকুরের পুজো করার পরে শ্রীমা সেই দম্পতিকে কৃপা করলেন। তাদের যে মা সারদার কাছে দীক্ষা নেবার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল। তাদের সেই আকাঙক্ষা পূর্ণ হল। আজ যেন তাদের জন্ম সার্থক হল।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক
শ্রীমা ছেলেদের বারান্দায় বসিয়ে নিজহাতে পুজোর প্রসাদ ফল, মিষ্টি, মুড়ি জলখাবার খাওয়ালেন। এরপর মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজেও খেলেন। সেদিন আরও ভক্ত এসেছিল। তারা সব জিনিস নিয়ে এসেছিল। রান্নার আয়োজন ও পরিমাণ সেদিন বেশি থাকায় রাঁধুনিমাসিকে জলখাবার থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য শ্রীমা নিজে খুন্তি ধরেন। শ্রীমা ভোরে শয্যা ত্যাগ করে স্নানাদি করে ঠাকুর তুলে স্বয়ং কুটনো কুটে দেন। ঠাকুরের পুজোর ফলাদির খোসা ছাড়িয়ে রাখেন। নিজের হাতেই নৈবেদ্য তৈরি করতেন। পুজোর পর সকলকে প্রসাদ বিতরণ করে নিজে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে রান্নার তদারকি করে পান সাজতে বসলেন। শ্রীমার সঙ্গে থাকা সব মহিলারাই এই সব কাজে দরকারমত তাঁকে সাহায্য করতেন।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৩: বীরচন্দ্রের রাজকার্যে বাংলা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
শ্রীমার বিশেষ ভক্ত মহিলারা তাঁকে সহায়তা করলেও তিনি নিজের কাজ নিজেই করতে ভালবাসতেন। যখন তাঁর শারীরিক সামর্থ্য ছিল তখন নিজের হাতে রান্না করে পরিবেশন করে সন্তানদের খাওয়াতেন। তাদের এঁটোপাত পরিষ্কার করতেন। এখন আর এতটা করতে না পারলেও একটু আড়ালে বসে তাঁর ছেলেদের আহার নিজের চোখে দেখেন। বলে বলে তাদের পেটভরে খাওয়ান। ছেলেদের রুচি বুঝে তাদের নানা খাবার খেতে দিতেন। খাবার শেষে পান দিতেন। যারা একটা চাইত, তাদের দুটো দিতেন। দুটো চাইলে চারটে দিতেন। ছেলেরা যখন মুখভর্তি পান চিবোতো, তা দেখে তিনি খুব খুশি হতেন। পান সাজার পর সময় পেলে তিনি কোনও কোনও দিন তাঁর ভাইদের কাছে গিয়ে তাদের সংসারের খোঁজ নিতেন, কাজে সাহায্য করতেন।
অনেক সময় তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে আসতেন ও ভালো কিছু রান্না করে তরকারি, মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে আসতেন। রান্না হয়ে যাবার পর সকল জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়। শ্রীমা স্বয়ং তা ঠাকুরকে নিবেদন করেন। তারপর ছেলেদের খাওয়া হয়ে যাবার পর শ্রীমা নিজে মেয়েদের সঙ্গে বসে খেতেন ও খাওয়াতেন। তারপর তিনি অবসর নিতেন। আর কখনো যদি কেউ তাঁর খাওয়ার পরে খেতে বসে, তখন তিনি বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে মুখে গুল দিতে দিতেই তার সঙ্গে কথা বলে আদরযত্নে খাওয়াতেন। তার খাওয়া শেষ হলে বেলাশেষে তিনি বিশ্রাম নিতেন।—চলবে।
অনেক সময় তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে আসতেন ও ভালো কিছু রান্না করে তরকারি, মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে আসতেন। রান্না হয়ে যাবার পর সকল জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়। শ্রীমা স্বয়ং তা ঠাকুরকে নিবেদন করেন। তারপর ছেলেদের খাওয়া হয়ে যাবার পর শ্রীমা নিজে মেয়েদের সঙ্গে বসে খেতেন ও খাওয়াতেন। তারপর তিনি অবসর নিতেন। আর কখনো যদি কেউ তাঁর খাওয়ার পরে খেতে বসে, তখন তিনি বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে মুখে গুল দিতে দিতেই তার সঙ্গে কথা বলে আদরযত্নে খাওয়াতেন। তার খাওয়া শেষ হলে বেলাশেষে তিনি বিশ্রাম নিতেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।