মা সারদা।
রামায়ণগান গেয়ে বাঁকু জয়রামবাটির সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে। সর্বদা তাঁর সেখানে যাতায়াত। তবে যখন তাঁর গানের পসার বেশ জমে উঠেছে, তখন তার আর দেখা পাওয়া গেল না। সব ছেড়ে সে উধাও হয়ে গেল। বহুদিন তার কোন খবর নেই। একদিন সকালে জয়রামবাটির সবাই খুব উল্লসিত হয়ে ছুটে চলেছে সতীশ বিশ্বাসের বাড়ির ভিতরে। সকলে জানতে পেরেছে যে, ভোরে শৌচাদির সময় সতীশ আমোদর নদীর দিকে গিয়েছিলেন। সেখানে বাঁকুকে দেখতে পেয়ে তাকে বুঝিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন। কিন্তু বাঁকু এখন সাধু হয়েছে। একথা শুনে স্বয়ং মা সারদা সতীশের বাড়ি যান।
জয়রামবাটিতে ভানুপিসি আর নিজের ভাইদের বাড়ি যাওয়া ছাড়া শ্রীমা অন্য কারো বাড়িতে যেতেন না। সকলেই তাঁর কাছে যেত। তবে আজ শ্রীমাকে সতীশের গৃহে যেতে দেখে স্বামী সারদেশানন্দ কৌতুহলী হয়ে তাঁকে অনুসরণ করলেন। মহারাজের সঙ্গেও বাঁকুর আগে হৃদ্যতা ছিল। তাই বহুদিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভেবে মহারাজ মনে মনে খুশি হলেন। সতীশের বাড়ির ভিতর উঠোনে তখন লোকের ভিড়। শ্রীমার ভানুপিসিও সেখানে আছেন। সতীশ বিশ্বাস যে তারই ভাইপো। পিসি তার আলাদা বাড়িতে থাকলেও সতীশের ঘরেই খেতেন। তার অতি স্নেহের সারুকে দেখে পিসিও আনন্দিত হয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘সতীশ, ওরে সতীশ, আজ তোর সৌভাগ্যের দিন। মা নিজে এসেছেন তোর ঘরে। শিগগির আসন দে, প্রণাম করে বসা’।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৭: জননী সারদা সন্তানের দুঃখভার লাঘব করেন
শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৪
সতীশের স্ত্রী ঘরের দুয়ার মুছে সবে উঁচু বারান্দায় লেপেছেন। গ্রামবাংলার সুদক্ষ গৃহিণীদের নিপুণ হাতে সুচারুরূপে মাটি গোবর লেপে অর্ধচন্দ্রাকারে ফোটা পদ্মদলের মতো এক একটি পোঁছ কাঁচা মাটির বাড়ির সকালবেলার শোভা। যার শুদ্ধতা মনকে পবিত্র ও অমলিন করে দেয়। পাড়াগাঁয়ের প্রত্যেক ঘরে প্রভাতে এই ছবি দেখা যায়। সতীশের স্ত্রী দৌড়ে এসে শ্রীমার হাত ধুইয়ে সুন্দর একটি গালিচা এনে বারান্দায় বিছিয়ে দিলে। স্বামী-স্ত্রী খুশি হয়ে হাতজোড় করে মা সারদাকে ডেকে আসনে বসালেন ও ভক্তিভরে তাঁর শ্রীচরণে প্রণাম করল।
শ্রীমা সেই সদ্য পবিত্র করা বারান্দায় পূর্বমুখী হয়ে বসলেন। বারান্দার কিনারার নীচে তাঁর পাদুটি ঝুলছে। তাঁর দুটিহাত কোলের উপরে রাখা। শ্রীমার পরণে সরু লালপাড়ের শ্বেতবস্ত্র। মাথায় সামান্য ঘোমটা দেওয়া থাকলেও তাঁর প্রসন্ন মুখখানি দেখা যাচ্ছে। তাঁর ডান পাশে ঈষৎ কুঞ্চিত লম্বা কেশদাম নীচে ঝুলে রয়েছে। মা সারদা বসেছেন এমনভাবে যে দেখে মনে হচ্ছে যেন স্বয়ং সৌভাগ্যদায়িনী মালক্ষ্মী গৃহস্থের দরজায় বসে আছেন। আর তার পাশেই ধানে পূর্ণ মরাই যেন মায়ের শুভ আগমনের প্রতীকরূপে শোভা পাচ্ছে।
শ্রীমা সেই সদ্য পবিত্র করা বারান্দায় পূর্বমুখী হয়ে বসলেন। বারান্দার কিনারার নীচে তাঁর পাদুটি ঝুলছে। তাঁর দুটিহাত কোলের উপরে রাখা। শ্রীমার পরণে সরু লালপাড়ের শ্বেতবস্ত্র। মাথায় সামান্য ঘোমটা দেওয়া থাকলেও তাঁর প্রসন্ন মুখখানি দেখা যাচ্ছে। তাঁর ডান পাশে ঈষৎ কুঞ্চিত লম্বা কেশদাম নীচে ঝুলে রয়েছে। মা সারদা বসেছেন এমনভাবে যে দেখে মনে হচ্ছে যেন স্বয়ং সৌভাগ্যদায়িনী মালক্ষ্মী গৃহস্থের দরজায় বসে আছেন। আর তার পাশেই ধানে পূর্ণ মরাই যেন মায়ের শুভ আগমনের প্রতীকরূপে শোভা পাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৪: অরাজকতার ফল ও একটি দুঃস্বপ্ন
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
সারদেশানন্দ মহারাজ এক হেমন্তকালের কথা বলেছেন, যেন শ্রীমা হৈমন্তিকা লক্ষ্মীস্বরূপা। শ্রীমা কাকভোরে প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে শিশিরভেজা চরণে ফিরছেন। তাঁর শ্রীচরণে শুষ্কধুলোর কণা লেপে রয়েছে। কিছুক্ষণ আগে শ্রীমার পুরোনো কাজের লোক শশীমাসি এসে ঘরের ভিতরের প্রবেশদ্বার রোজের মতো নিখুঁতভাবে লেপে দিয়ে গেছে। শ্রীমা দরজার সামনে দুই পা জোড় করে দাঁড়িয়েছেন, দরজা খোলার অপেক্ষায়। তিনি দরজা ঠেললেন, খুলে গেল, ভিতরে প্রবেশ করলেন। খানিক ভেজা দরজার মাটিতে শ্রীমার ধুলোমিশ্রিত পদরেণুর এমন সুন্দর ছাপ পড়ল যে তার অপূর্ব শোভা দেখে মনে হল মালক্ষ্মী এইমাত্র নিজ গৃহাভ্যন্তরে পদার্পণ করলেন।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক
লক্ষ্মীপুজোর দিনে গৃহের দুয়ারে চালের গুঁড়ো দিয়ে যেমন আল্পনা দেওয়ার সময় দেবীর গৃহপ্রবেশের শুভ পদচিহ্ন আঁকা হ্য়, শ্রীমার পদচিহ্ন অবিকল তেমনই। সেই পদচিহ্ন যে সত্য, ভক্তের কল্পনা নয়, একথা ভেবে মহারাজের মন আনন্দে ভরে উঠল। তাঁর মনে হল যেন যমুনাতটে এই পদচিহ্ন দেখেই তো ব্রজের গোপীরা অনুভব করেছিলেন অলৌকিক পুলক শিহরণ। সত্যই এ ধরণীও তাই ভাগ্যবতী। পরমুহূর্তেই মহারাজের মন হরিষে বিষাদপূর্ণ হল। কারণ, এই চরণচিহ্ন তো ক্ষণস্থায়ী, খানিকবাদেই তা বিলীন হয়ে যাবে মহামায়ার মায়ায়। সেখানে যে কত নিত্যলীলা বহমান, ক্ষুদ্র জীবের পক্ষে তা জানার জো নেই। তিনি ভাবলেন যে, এই ক্ষণিকত্বকে কি চিরকালীন করার উপায় নেই। না নেই, এটাই সত্য, দার্শনিকতা অনুসারে যা অস্থায়ী, তাকে স্থায়ী করা যায় না, তা সময় হলে বিলীন হবেই।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩২: কল্যাণ মাণিক্যের সনদে বাংলা গদ্য
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
মহারাজ দুঃখিত অন্তরে শ্রীমার সেই পদরেণু তাঁর শিরে ও বক্ষে ধারণ করলেন। মন তখন শান্তি পেল আর তিনি আনন্দিত হলেন। সেইসঙ্গে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মতো মনে ভেসে উঠল যে, ‘আশ্রিত ভক্তহৃদয়ে লীলাময়ী মহামায়া তাঁর লীলাময় চরণকমল চিরমুদ্রিত করেন। শতকোটি শশী হাসে চরণ-নখরে, আলো করে কালো রূপ হৃদয়-কন্দরে’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।