বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

মাতামহের রাজ্য থেকে ভরত অযোধ্যায় এসেছেন, পিতার ভবনে। সেখানে পিতার দর্শন না পেয়ে গেলেন মাতার আলয়ে। প্রবাসী পুত্রকে দেখে আনন্দে আত্মহারা কৈকেয়ী তাঁর স্বর্ণময় আসন ত্যাগ করলেন। ধার্মিক ভরত, দেখলেন তাঁর নিজভবন শ্রীহীন। সেখানে প্রবেশ করে, তিনি মায়ের শ্রীচরণ স্পর্শ করলেন। রানি কৈকেয়ী ভরতকে স্নেহভরে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর মাথার ঘ্রাণ নিয়ে ঠাঁই দিলেন নিজের কোলে। রানি পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভরত রানির পিত্রালয় থেকে রওনা হয়েছেন, কত রাত অতিবাহিত হয়েছে পথে? রথারোহী ভরতের দ্রুত আসতে পথশ্রম হয়নি? মাতুল যুধাজিৎ ও মাতামহ কুশল তো? প্রবাস হতে ফেরা, পুত্রের কাছে সুখবরগুলি জানতে, উৎগ্রীব হলেন রানি।

পদ্মনেত্র ভরত রানিকে প্রিয় সংবাদগুলি জানালেন। আজ সাত রাত হল, তিনি মাননীয় মাতামহের গৃহ থেকে রওনা হয়েছেন। সেখানে রানির পিতা ও ভরতের মাতুলের খবর, শুভ। মাতামহ যে সব ধনরত্ন দিয়েছেন, সেই সব পথেই রয়েছে, ভরত এসেছেন আগে। রাজদূতদের বার্তায় তাড়া ছিল, তাই ভরত সত্বর এসেছেন। এখন তিনি, মায়ের কাছে জানতে চাইছেন, এই কাঞ্চন পালঙ্ক, শয্যা সব শূন্য। ইক্ষ্বাকুকুলের কাউকেই সন্তুষ্ট দেখছেন না। এই মাতৃভবনেই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হত পিতার, যাঁর দর্শনেচ্ছায় এখানে এসেও তাঁর দেখা পেলেন না আজ। রাজা ভবতি ভূয়িষ্ঠম্ ইহাম্বায়া নিবেশনে। তমহং নাদ্য পশ্যামি দ্রষ্টুমিচ্ছন্নিহাগতঃ।। পিতার চরণধূলি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ভরত।সেই কারণেই ভরত জানতে চাইছেন, পিতা কী জ্যেষ্ঠা মাতা কৌশল্যার ভবনে আছেন?

যা ঘটে গিয়েছে, ভরত তার আঁচটুকু পর্যন্ত পাননি। রাজ্যে যাঁর তীব্র লোভ,সেই রানি কৈকেয়ী মনে করলেন ভরতের খবরটি ভীষণ প্রিয় হবে,কিন্তু কার্যত ভরতের ঘোর অপ্রিয় বৃত্তান্ত জানালেন। সর্বভূতের পরিণাম যেখানে নির্দিষ্ট,তোমার পিতা মহাত্মা, তেজস্বী, যাজ্ঞিক, সজ্জনদের সেই লোকে গমন করেছেন। খবর শুনে ধর্মাত্মা, পবিত্রহৃদয়, ভরত পিতার শোকে মাটিতে আছড়ে পড়লেন।হায় আমি আর নেই হা হতোঽস্মি বীর ভরত, মাটিতে পড়ে, হাত ছুঁড়ে, কাতর চিৎকার করতে লাগলেন। পিতার মৃত্যুশোকে ব্যাকুল, শোকার্ত, উদভ্রান্তচিত্ত, মহাতেজস্বী ভরত আকুলভাবে বিলাপ করতে লাগলেন। বর্ষণ শেষে অমল আকাশে চাঁদ যেমন শোভা পায় তেমনই এই শয্যার দীর্ঘদিন ধরে শোভা হয়ে ছিলেন রাজা। ধীমান রাজার অভাবে শয্যা এখন জলহীন সাগর বা চাঁদবিহীন গগনতুল্য রূপ ধারণ করেছে।
ভরতের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ, বস্ত্রে আবৃত তাঁর মুখমণ্ডল, গভীর মর্মাহত ভরত বিলাপ করতে লাগলেন। সেই আর্ত দেবপ্রতিম রাজপুত্র যেন কুঠারাঘাতে ছিন্ন ভূপতিত সালতরুর স্কন্ধ, এমন গজসদৃশ বলশালী, চন্দ্র ও সূর্যতুল্য উজ্জ্বল শোকার্ত পুত্রকে মাটি থেকে তুলে ধরে, দেবী কৈকেয়ী বললেন, হে মহাযশস্বী রাজন, ওঠ, ওঠ, তোমার মতো সজ্জনের এই শোক শোভা পায় না।দান ও যজ্ঞে তোমার অধিকার। চরিত্র, বেদ ও তপস্যার অনুগমন করে থাকে। হে বুদ্ধিমান, তোমার বুদ্ধি, সূর্যপ্রভার মতোই। দানযজ্ঞাধিকারা হি শীলশ্রুতিতপোঽনুগা। বুদ্ধিস্তে বুদ্ধিসম্পন্ন প্রভেবার্কস্য মন্দিরে।।

শোকাচ্ছন্ন ভরত, দীর্ঘক্ষণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে জননীকে বললেন, রাজা দশরথ রামকে অভিষিক্ত করবেন, তাই হয়তো যজ্ঞ করছেন, এই মনে করে খুশি মনে যাত্রা করেছিলেন। তার অন্যথা হল, ভরতের হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে। পুত্র ভরত, সর্বদা পুত্রের কল্যাণচিন্তায় নিবেদিতপ্রাণ পিতার দর্শন পাবেন না। সরলমনে মায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন ভরত। মা, আমি এসে পৌঁছনর আগেই পিতা কোন অসুখে পড়ে দেহ রাখলেন? রাম প্রভৃতি ভাইরা ধন্য, যাঁরা পিতার অন্তিম সৎকার সম্পন্ন করেছেন তাঁরাই ধন্য। অম্ব কেনাত্যগাদ্রাজা ব্যাধিনা ময্যনাগতে। ধন্যা রামাদয়ঃ সর্ব্বে যৈঃ পিতা সৎকৃতঃ স্বয়ম্।। কীর্ত্তিমান পিতা, পুত্র ভারতের উপস্থিতি নিশ্চয়ই টের পাননি। পুত্র এসেছে, এ সংবাদ জেনে তিনি সত্বর এসে পুত্রের মাথাটি নামিয়ে নিয়ে স্নেহভরে আঘ্রাণ নিতেন।

হায়, পুত্রের ধূলিধূসর দেহের সব ক্লেদ মুছিয়ে দিত যে হাত, যা কাউকে কষ্ট দেয়নি, পিতার করের সেই সুখপরশ কোথায়? ভরত জানতে চাইলেন, যিনি ক্লেশদায়ক কাজ কখনও করেননি, যিনি আমার ভাই, পিতা, বন্ধু, যাঁর চিরসেবক আমি, সেই রাম কোথায়? শীঘ্র বলুন। যো মে ভ্রাতা পিতা বন্ধুর্যস্য দাসোঽস্মি সম্মতঃ। তস্য মাং শীঘ্রমাখ্যাহি রামস্যাক্লিষ্টকর্ম্মণঃ।। আর্যধর্মবেত্তা, ধার্মিক, মহান এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পিতৃতুল্য জ্যেষ্ঠ, তিনি এখন ভরতের পরম আশ্রয়, তাঁর পদবন্দনা করবেন ভরত। সত্য যাঁর শক্তির, সেই পিতা, অন্তিম সময়ে কী বলে গিয়েছেন? মাননীয়া জননীর বয়ানানুসারে সেই সংবাদ ভরত শুনতে ইচ্ছুক। এমন প্রশ্নের উত্তরে কৈকেয়ী যথাযথ তথ্য জানালেন, সেই মহাপ্রাণ রাজা,’হা রাম’, ‘হা সীতে’ এমন নাম ধরে বিলাপ করতে করতে পরলোকগমন করেছেন। রামেতি রাজা বিলপন্ হা সীতে লক্ষ্মণেতি চ। স মহাত্মা পরং লোকং গতো গতিমতাং বরঃ।। পাশবদ্ধ গজরাজের মতো মৃত্যুর করাল পাশে আবদ্ধ, এমন বিলাপরত রাজা মৃত্যুবরণ করেছেন। রাজা বলে গিয়েছেন, যাঁরা, রাম, লক্ষ্মণ ও সীতার প্রত্যাবর্তন দেখবেন, তাঁদের জীবন সার্থক।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৭: যুগধর্মের সমর্থনহীন ধর্মচিন্তার স্থান কোথায়?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন

মা কৈকেয়ী, এ বার সেই, রামের নির্বাসনের অপ্রিয় দুঃসংবাদটি শোনালেন। শুনে ,বিষণ্ণ ভরত আরও শুনতে চাইলেন। রামের বর্তমান অবস্থান কোথায়? এ বিষয়টি সম্বন্ধে তাঁর যত উদ্বেগ। ক্ব চেদানীং স ধর্মাত্মা কৌসল্যানন্দবর্দ্ধনঃ।লক্ষ্মণেন সহ ভ্রাত্রা সীতয়া চ সমাগতঃ।। সেই ধার্মিক কৌশল্যা মায়ের আনন্দবর্দ্ধক সন্তান, লক্ষ্মণভাই ও দেবী সীতার সঙ্গে এখন কোথায় আছেন? জননী, কাল বিলম্ব না করে পুত্রের আনন্দ উদ্রেকের জন্যে অপ্রিয় সত্য কথাটি বললেন, সেই রাজপুত্র, চীর বসন ধারণ করে, বৈদেহী সীতা ও অনুচর লক্ষ্মণভাইকে সঙ্গে নিয়ে দণ্ডকারণ্য নামে গহনারণ্যে প্রবেশ করেছেন।

খবর শুনে ভীত হলেন ভরত। কারণ, বংশের মাহাত্ম্য স্মরণ করে, ভ্রাতার চারিত্রিক ত্রুটি সম্বন্ধে আশঙ্কিত হলেন তিনি। তাঁর মনে নানা সন্দেহ — রাম কোনও ব্রাহ্মণের ধন অপহরণ করেননি তো?তিনি কোন নিষ্পাপ ধনী বা দরিদ্রের ধ্বংসের কারণ নন? সেই রাজপুত্র,কোন পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হননি তো? কী কারণে জ্যেষ্ঠভ্রাতার দণ্ডকারণ্যে নির্বাসন? কস্মাৎ স দণ্ডকারণ্যে ভ্রাতা রামো বিবাসিতঃ। তখন মা কৈকেয়ী, নিজেকে পণ্ডিত মনে করেন যিনি, মহিলাসুলভ বাচালতাবশত, নিজের কৃতকর্ম সবিস্তারে বর্ণনা করলেন।

ভরতের উৎকণ্ঠার উত্তরে, আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে, বললেন, রাম কখনও। কারও ধন হরণ করেননি। ধনাঢ্য বা ধনহীনের প্রতি হিংসাচরণ তো দূরের কথা। কোনও পরস্ত্রীর প্রতি চোখ তুলে তাকাননি পর্যন্ত। কৈকেয়ী, পুত্রকে জানালেন, রামের অভিষেকবার্তা শুনে আমি তোমার পিতার কাছে রাজ্য ও রামের নির্বাসন, প্রার্থনা করলাম। পিতা প্রতিজ্ঞাপালনরূপ ক্ষত্রিয়ধর্ম পালনার্থে সেটাই করলেন। যাচিতস্তে পিতা রাজ্যং রামস্য চ বিবাসনম্। স স্ববৃত্তিং সমাস্থায় পিতা তে তৎ তথাকরোৎ।। রাম, সুমিত্রানন্দন লক্ষ্মণ ও সীতার সঙ্গে, দেশান্তরী হলেন।প্রিয় পুত্রের অদর্শনজনিত শোকে মহাযশস্বী নৃপতি দশরথ পরলোকগমন করেছেন।পুত্র ভরতের কাছে রানির অনুরোধ, ত্বয়া ত্বিদানীং ধর্মজ্ঞ রাজত্বমবলম্ব্যতাম্। হে ধর্মজ্ঞ, তুমি এখনই সেই রাজ্য গ্রহণ কর। পুত্রের জন্যই মায়ের এই যা কিছু উদ্যোগ। এখন, শোকের সময় নয়, নয় কোন পরিতাপ। ধৈর্য্য আশ্রয় করাই বিধেয়। এই নিষ্কণ্টক নগরী ও রাজ্য এখন ভরতের আয়ত্তাধীন। তাই বিধিসম্মতভাবে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ বশিষ্ঠ প্রভৃতি দ্বিজশ্রেষ্ঠদের সহ, মহাপ্রাণ রাজা দশরথের অন্তিম সংস্কার যথাবিধি সম্পন্ন করে এই রাজ্যে অভিষিক্ত হও। তৎ পুত্র শীঘ্রং বিধিনা বিধিজ্ঞৈর্বসিষ্ঠমুখ্যৈঃ সহিতো দ্বিজেন্দ্রৈঃ। সঙ্কাল্য রাজানমদীনসত্ত্বমাত্মানমুর্ব্ব্যামভিষেচয়স্ব।।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৪: আততায়ী এক, নাকি দুই?

পিতার মৃত্যুসংবাদ ও দুই ভাই-এর নির্বাসনবার্তা শুনে দুঃখদীর্ণ ভরত অনুভব করলেন, তিনি নিজে একাধারে পিতৃহীন, সেইসঙ্গে পিতৃতুল্য ভ্রাতৃহীন। শোকাহত ভরতের রাজ্যের কী প্রয়োজন? জননীকে তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে বিদ্ধ করলেন ভরত। রাজাকে মৃত এবং রামকে তপস্বীর জীবন বরণ করতে বাধ্য করে, পর পর দুঃখ দিয়েছেন মা। তিনি যেন ব্রণের ওপরে ক্ষার লিপ্ত করেছেন। এই কুল ধ্বংসের কারণরূপে, কালরাত্রি হয়ে রানির আবির্ভাব হয়েছে। নিজের অজান্তে পিতা, অঙ্গার আলিঙ্গন করেছিলেন। মৃত্যুবরণ করেছেন পিতা, তার কারণ পাপিষ্ঠা, জননী। কুলকলঙ্কিনী জননী, মোহহেতু কুলতিলক দশরথকে হত্যা করে, এই বংশ সুখহীন করে তুলেছেন। জননীকে দোষারোপ করলেন ভরত। দেবী কৈকেয়ীকে লাভ করে, সত্য প্রতিজ্ঞ, মহাযশস্বী পিতা, দুঃখতাপদগ্ধ হয়েছেন। রাজা মৃত, নির্বাসিত রাম না জানি এখন কোন বনে হতে বনান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পুত্রশোকাহতা দেবী কৌশল্যা ও সুমিত্রার জীবন ভরতজননীর সান্নিধ্যে দুর্বহ হয়ে উঠবে।

গভীর দুঃখের সঙ্গে, ভরত, মাকে বললেন, ধর্মপ্রাণ রাম জানেন গুরুজনদের প্রতি যথাযথ ব্যবহার, তিনি তোমার প্রতি জননীর সমমর্যাদার ব্যবহার প্রদর্শন করতেন। নন্বার্য্যোঽপি চ ধর্ম্মাত্মা ত্বয়ি বৃত্তিমনুত্তমাম্। বর্ত্ততে গুরুবৃত্তিজ্ঞো যথা মাতরি বর্ত্ততে।। আর জ্যেষ্ঠা মাতা কৌশল্যা, যিনি অতীব দূরদর্শিনী, তিনি কৈকেয়ীর প্রতি ধর্মসম্মত ভগিনীতুল্য ব্যবহার করতেন। ভরত, জননীকে শাণিত বাক্যবাণে বিদ্ধ করলেন। হে পাপিষ্ঠা, সেই দেবী কৌশল্যার পুত্র মহাত্মা রামকে চীর বসন পরিধান করিয়ে,বনবাসে প্রস্থান করতে বাধ্য করে, একবারও অনুশোচনা হল না রানির? পাপ কী?— রাম জানেন না, তিনি নিষ্পাপ, শৌর্যবান, জিতেন্দ্রিয় এবং যশস্বী। তাঁর মতো মানুষকে নির্বাসিত করেছেন, চীরবসন ধারণ করিয়েছেন কৈকেয়ী।

এ সবের কারণ কী? খুঁজে দেখেছেন কখনও? উদারমনা ভরত,জ্যেষ্ঠর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা রেখে বলে চললেন, আমি জানি আপনি অতি লোভী। আমার রামের প্রতি মনোভাব আপনি জানেন না। তাই আমার রাজ্যলাভের প্রতি আপনার যত আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এর ফল হল এই মহাবিপত্তি। *লুব্ধায়া বিদিতো মন্যে ন তেঽহং রাঘবং যথা। যথা হ্যনর্থো রাজ্যার্থং ত্বয়া নীতো মহানয়ম্।।* পুরুষোত্তমদ্বয় রাম ও লক্ষ্মণকে না দেখে কোন শক্তি প্রভাবে রাজ্যকে রক্ষা করতে উৎসাহী হবেন ভরত?সুমেরু পর্বতের আশ্রয় যেমন নিজের সৃষ্ট অরণ্য তেমনই সেই বলশালী মহা তেজস্বী রামচন্দ্র ছিলেন মহারাজ দশরথের,সতত আশ্রয়। কেমন করে মহাবৃষভের বহনযোগ্য গুরুভার তুল্য রাজ্য, নবীন বৃষসম আমি, দুর্বহ এ ভার বহন করি? সোঽহং কথমিমং ভারং মহাধুর্য্যসমুদ্যতম্। দম্যো ধুরমিবাসাদ্য সহেয়ং কেন চৌজসা।।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

ভরত প্রবল ঘৃণাভরে জননীকে জানালেন, যোগবলে কিংবা বুদ্ধিবলে যদি বা এ কাজে তিনি সক্ষম হন, তবু তিনি পুত্রস্বার্থরক্ষায় তৎপরা মায়ের মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেন না। রামের দৃষ্টিতে ভরতজননী যদি মাতৃতুল্যা না হতেন তবে নিশ্চিতভাবে পাপ কর্মের সঙ্গে যুক্তা ‘মা’কে পরিত্যাগ করবার বিশেষ ইচ্ছা ভরতের হতো না। রঘুবংশীয়দের পরম্পরাক্রমে রাজকীয় উত্তরাধিকার বিষয়টির মতবিরোধী এমন বুদ্ধি, পাপদর্শিনী মায়ের হল কী করে? ভরতের মনে বিস্ময়। বংশের নিয়ম হল, সকলের জ্যেষ্ঠ সিংহাসনে অভিষিক্ত হবেন, অন্যরা সমাহিত চিত্তে তাঁর অনুরক্ত থাকবেন। ভরতের মনে হয়, তাঁর মা অতি নির্মম, তিনি চিরন্তন রাজধর্মের গতিপ্রকৃতি জানেন না। সর্বদাই জ্যেষ্ঠ রাজপদে অভিষিক্ত হবেন, সকল রাজাদের ক্ষেত্রে এই সমতা বর্তমান, বিশেষভাবে ইক্ষ্বাকুবংশেও এই নিয়ম চলে আসছে।

ভরত মায়ের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন এই বলে, আজ সেই ধর্মমাত্ররক্ষাকারী, চরিত্রবলে বলী, ইক্ষ্বাকুরাজাদের, চরিত্রবলের গর্ব তোমার কারণে বিনষ্ট হল। তেষাং ধর্ম্মৈকরক্ষাণাং কুলচারিত্রশোভিনাম্। অদ্য চারিত্রশৌণ্ডীর্য্যং ত্বাং প্রাপ্য বিনিবর্ত্তিতম্।। মহাভাগ্যবতী, মহান কুলে জাতা, ভরতজননীর এমন মন্দ বুদ্ধি হল কী করে? ভরত, পাপকর্মে নিশ্চিতভাবে যুক্তা মায়ের, পাপকর্মের প্রাণঘাতী উদ্যোগ, সফল হতে দেবেন না। মায়ের অপ্রিয় কাজটি ভরত করবেন। স্বজনপ্রিয় রামকে, বনবাস থেকে ফিরিয়ে আনবেন তিনি।ভরতের অভিলাষ হল, তিনি প্রদীপ্ত তেজশালী রামকে বনবাস হতে ফিরিয়ে এনে, সুস্থির চিত্তে তাঁর সেবক হয়ে থাকবেন। মহাত্মা ভরত, এমন অপ্রিয়ভাষায় জননীকে আঘাতের পর আঘাত করতে লাগলেন। শোকসন্তপ্ত ভরত, আবারও, মন্দরপর্বতের গুহাস্থিত সিংহতুল্য আর্তনাদ করতে থাকলেন।

দশরথপুত্র ভরত, প্রমাণ করলেন, চারিত্রিক সততার নিরিখে তিনি রামের যোগ্য ভাই। আসক্তি হীন, নির্লিপ্ত,অনমনীয় মেরুদণ্ডের অধিকারী, একজন প্রকৃত সজ্জন। তিনি কর্তব্যে অবিচল,তাঁর আনুগত্যে আছে পরম নিষ্ঠা। জননী রাজ্যসুখ উপভোগের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন, তিনি বীতরাগ সন্ন্যাসীর মতো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তিনি সীমার মধ্যে থাকতে ইচ্ছুক, পরম্পরার প্রতি আস্থাশীল। রাজ্যসুখজনিত প্রলোভন, ক্ষমতা অধিগত করবার স্পৃহা, তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করতে পারেনি। মহানুভবতা কিন্তু তাঁকে অসীম চারিত্রিক ঐশ্বর্যের অধিকারী করে তুলেছে। তিনি জানেন, রাজত্বের উত্তরাধিকার তাঁর জন্যে নয়। পরম্পরাগত ক্রমানুযায়ী এবং ঐতিহ্য অনুসারে, এর যোগ্য উত্তরাধিকারী রাম। পিতৃপুরুষদের সেই চিরন্তন ধ্যানধারণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ছলে বলে কৌশলের মাধ্যমে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা রাজ্যসুখলাভের প্রলোভন তাঁর রাজকীয় আভিজাত্যে চিড় ধরাতে পারে নি, পূজনীয়া মায়ের প্রস্তাব তো নয়ই।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত

রামায়ণের মূল সুর,রামের কাহিনি হলেও সেই সুরে পূর্ণতা দিয়েছেন ভরত ও লক্ষ্মণ। লক্ষ্মণ যদি রামের ছায়া হন ভরত হলেন রামের হৃদয়ের প্রতিভূ। রাম, পিতার বাক্য মিথ্যা প্রতিপন্ন হতে দেননি, তাঁর আসন্ন অভিষেকসমারোহের সূচনাতে এক কথায় নির্লিপ্ত ঔদাসীন্যে রাজকীয় সুখ প্রত্যাখ্যান করে তুলে নিয়েছেন বৈরাগ্যের গৈরিক পরিধেয়। ভরতের মা, পুত্রের রাজসুখ উপভোগের সম্ভার সাজিয়ে রেখেছেন। ভরত সেই রাজসিংহাসন, অসীম চারিত্রিক দৃঢ়তায় অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। অনৈতিক প্রাপ্তি, অস্বীকারের দৃঢ়তা কজনের থাকে? পৃষ্ঠবল, জীবনের স্তম্ভস্বরূপ, নিজের গর্ভধারিণী জননীকে, ধিক্কার দিতে কণ্ঠ কেঁপে ওঠেনি একটুও। নির্দ্বিধায় রানি, পিতার মৃত্যুসংবাদ শুনে ভেঙে পড়া পুত্রকে প্রিয় সংবাদ ভ্রমে, রামের নির্বাসনবার্তা জানিয়েছেন। ভরত তাঁর পিতৃতুল্য জ্যেষ্ঠ রামের মধ্যে,স্নেহের আশ্রয় খুঁজেছেন।

শোক উপশমের জন্য, ভরত হয়তো উষ্ণ আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে, পরম নির্ভরযোগ্য জ্যেষ্ঠ রামের স্নেহের পরশ অনুভব করতে চেয়েছেন।এ কেমন মা? যিনি পুত্রের উদার, নিরপেক্ষ, দৃঢ় মানসিকতার খবরটুকু পর্যন্ত রাখেন না। অথবা বিলাসিনী মায়েদের হয়তো সে সময়টুকুও নেই। কিংবা মাতুলালয়ে প্রতিপালিত ভরতের জন্য রাজ্যপাটের ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু পুত্রের মনের খবর রাখেন না। এমন মাতৃত্বের নিদর্শন শুধু রামায়ণের যুগে নয়, আধুনিক কৃত্রিম ও ভোগ সর্বস্ব জীবনেও হয়তো বিরল নয়। আমরা সন্তানের জন্যে ভোগোপকরণ সাজিয়ে রাখি,তাদের মনের খবর রাখি না। রানি ভোগসর্বস্বতার প্রতীক। আর ভরত? তিনি, যা প্রাপ্য সেই অধিকারে বিশ্বাসী, তার অতিরিক্ত কিছুতে নয়। রামের নির্বাসনের নেপথ্য কাহিনি শুনে অধিকারবোধের সীমা লঙ্ঘন করেননি। সহজলভ্য অযাচিত বস্তুতে অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি এবং অনধিকারচর্চা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। যে কোনও সৎব্যক্তিত্বের যা করণীয় ভরত সেটাই করেছেন। তিনি মায়ের অশুভ ইচ্ছাকে নস্যাৎ করে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, নিবর্ত্তয়িত্বা রামঞ্চ তস্যাহং দীপ্ততেজসঃ। দাসভূতো ভবিষ্যামি সুস্থিতেনান্তরাত্মনা।। তিনি সেই তেজস্বী রামকে ফিরিয়ে আনবেনই।সমাহিত চিত্তে তাঁর দাস হবেন। মায়ের কূট চক্রান্তের ফলে সহজলভ্য রাজত্বলাভ ও ক্ষমতার প্রলোভন ভারতকে প্রভাবিত করতে পারেনি।

যা অনায়াসে হাতে আসে, যে ক্ষমতালাভের প্রেক্ষিতে আছে অশুভ কোনও শক্তি, যেটি অন্যায্য প্রাপ্তি সেটি বর্জনীয়।রামায়ণে, ভরতের মানসিকতায় প্রচ্ছন্ন এই জীবনবোধ, আজকের দিনে ভোগসর্বস্বতায় নিমগ্ন মানুষের শিক্ষণীয় বিষয় নয় কী?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content