অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।
ওরা সবাই ভেবেছিল, ফিরে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে দেদার ফূর্তি হবে, সারারাত। বাইরে ক্যাম্পফায়ারেরও ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন ম্যানেজার ব্রিজভূষণ কাপাডিয়া। ভদ্রলোক অবাঙালি হলেও বাংলা ভালোই বোঝেন, ভাঙা ভাঙা বলতেও পারেন। এখানে তারা আসার পর বলেছিলেন, “আমি কলকাতায় তিন বছর পহেলে থা। ফির চলে আয়ে ইঁহা নোকরিকে ওয়াস্তে। বাংলা হামি ভালোই বুঝি, লেকিন বোলনে মে থোড়া থোড়া পরেসানি হোতা হ্যায়। পর বাঙালি যদি না থাকত, হামারা ইয়ে পর্যটন শিল্প থাকত না। বাঙালি দিলদার আদমি আছে, বহুত ঘুমনা পসন্দ করে!”
অঞ্জন বলেছিল, “ইসি লিয়ে তো আপকে রিসর্ট মে ঠাহরে হুঁ। নেহি তো হামারা কদর অর কৌন করতা?”
অরণ্য বলেছিল, “কিন্তু অঞ্জনবাবু, আপনি বাঙালি নন!” সে অঞ্জনকে আর্যর মতো ‘দাদা’ ডাকতে পারেনি। পারবে বলে মনেও হয় না।
অঞ্জন বলেছিল, “ইসি লিয়ে তো আপকে রিসর্ট মে ঠাহরে হুঁ। নেহি তো হামারা কদর অর কৌন করতা?”
অরণ্য বলেছিল, “কিন্তু অঞ্জনবাবু, আপনি বাঙালি নন!” সে অঞ্জনকে আর্যর মতো ‘দাদা’ ডাকতে পারেনি। পারবে বলে মনেও হয় না।
অঞ্জন রিসেপশনের ডেস্কে একটা সজোর চাপড় মেরে বলেছিল, “আলবাত বাঙালি। কলকাতায় জন্ম আমার। আমি বাঙালি নয় তো কি বাংরিশ বলা তোমরা বাঙালি চাঁদু?” বলে নিজেই হেসে উঠেছিল।
আর্য অবাক হয়ে বলেছিল, “তুমি ‘চাঁদু’ও জানো?”
“লে শালা। তু তো আজিব আদমি হ্যায় ! আই নো এভরিথিং। খিস্তি ভি। বলু কেয়া?” বলে চোখ দিয়ে অশ্লীল ভঙ্গি করেছিল।
সকলে হেসে উঠেছিল। উন্মেষা কনুইয়ের ঠেলা মেরে অঞ্জনকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, রিসেপশন থেকে রুম আর চাবি বুঝে নাও। আমায় ফ্রেস হতে হবে।”
অঞ্জন দ্রুত সিরিয়াস হয়ে গিয়ে ব্রিজভূষণের কাছ থেকে সকলের রুম নম্বর এবং চাবির হিসেব বুঝে নিতে লাগল। অঞ্জন আর উন্মেষা একটা ডাবল বেডরুম বুক করেছিল, অরণ্য আর তৃধা আর একটা, অনিল আর আর্য আর একটা।
আর্য অবাক হয়ে বলেছিল, “তুমি ‘চাঁদু’ও জানো?”
“লে শালা। তু তো আজিব আদমি হ্যায় ! আই নো এভরিথিং। খিস্তি ভি। বলু কেয়া?” বলে চোখ দিয়ে অশ্লীল ভঙ্গি করেছিল।
সকলে হেসে উঠেছিল। উন্মেষা কনুইয়ের ঠেলা মেরে অঞ্জনকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, রিসেপশন থেকে রুম আর চাবি বুঝে নাও। আমায় ফ্রেস হতে হবে।”
অঞ্জন দ্রুত সিরিয়াস হয়ে গিয়ে ব্রিজভূষণের কাছ থেকে সকলের রুম নম্বর এবং চাবির হিসেব বুঝে নিতে লাগল। অঞ্জন আর উন্মেষা একটা ডাবল বেডরুম বুক করেছিল, অরণ্য আর তৃধা আর একটা, অনিল আর আর্য আর একটা।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫: কালাদেওর কিস্সা
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৮: ‘ঈশ্বর… অদ্ভুত ম্যাজিক করেন, চাহিদা যত বেশি তিনি ততো কৃপণতা করেন’
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১১: বন থেকে বনান্তরে
আজ এখন নিজেদের রুমে ওরা সকলে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। কেবল অনিলের ঘরে অনিল একা। আর্য সেই কোথায় স্কুপ নিউজের খোঁজে গিয়েছে। ফলে আজ রাতটা তাকে একাই কাটাতে হবে। সত্যি বলতে কী, ব্যাপারটা তার ভালোই লাগছিল। আর্য থাকলেই যেন তার রাতটা বিচ্ছিরি কাটত। এই মুহূর্তে সে যাবতীয় পোশাক-আশাক খুলে ছোট একটা শর্টস পরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। এই রিসর্টটি দোতলা। প্রতিটি রুমের সঙ্গে একটা করে বারান্দা আছে। তাতে ছোট বেতের চেয়ার, টেবিল রাখা। কোনও ঘরের বারান্দা থেকে অন্য কোনও ঘরের বারান্দা অবশ্য দেখা যায় না।
বারান্দার এক কোণ বেয়ে নাম-না-জানা লতানে একটা গাছ উঠেছে। তার ডালপালাগুলি কোথাও কোথাও এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে, দেখে মনে হচ্ছে, কেউ বাহু মেলে কাউকে ধরবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মনোরম পরিবেশ। সন্ধ্যের এই সময়টায় বেশ সুন্দর বসন্তকালীন হাওয়া দিচ্ছিল। রাত গড়ালেই অবশ্য ঠান্ডা ফিরে আসবে আবার। ভোরের দিকে ব্ল্যাঙ্কেটের তলায় না সেঁধুলে ঘুমটাই বরবাদ হয়ে যাবে। এখন কেউ ইচ্ছে করলে এখানেই আড্ডা জমাতে পারে, মনে হল অনিলের। যদিও সে আড্ডা জমানোর চেয়ে একাকী অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানাটাকেই উপভোগ করছিল। আর মনে মনে ভাবছিল, অনেক কিছু। গাড়ল আর্যটার কথা, যার কবিতা তার কাছে রাবিশ লাগে। ইচ্ছে করে ওর চুলের মুঠিটা ধরে সজোরে দেওয়ালে ঠুকে দেয়।
শালা উন্মেষার কাছে তার নামে নিশ্চয়ই কিছু চুকলি কেটেছে, তা না হলে এখানে আসা ইস্তক ধান্দাবাজ মেয়েছেলেটা ভালো করে কোনও কথাই বলছে না তার সঙ্গে। যেন সে অনিলকে চেনেই না, আগে কখনও দেখেনি। এসব মেয়েকে…! মনে মনে আরও কিছু নোংরা কথা ভাবল সে। আর্য না চলে গেলে এখন হয়তো তার ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে হতো। তার চেয়ে এই বেশ ভালো। তার তো মনে হয়, আর্য কোনও দেহাতি মেয়ের সঙ্গে রাতে ফূর্তি জমাতে গিয়েছে। তা না হলে, হঠাৎ করে কোনও ফোন এল আর সে স্কুপ নিউজ করতে চলে গেল, এ হতে পারে না। শালা, মুখে যতই সতীপনা দেখাক, আর্য যে আসলে কী, সেটা কেবল সে-ই জানে। আজ থেকে বছর ছয়েক আগের সেই পার্টিতে যারা যারা সেদিন উন্মেষার পানীয়তে নেশার ওষুধ মিশিয়ে তার সঙ্গে রংরলিয়া মানিয়েছিল, তাদের মধ্যে আর্যও ছিল। তার তো মনে হয়, সেই লজ্জা ঢাকতেই উন্মেষা তড়িঘড়ি হিরণ্ময়ের সঙ্গে প্রেমের নাটক করে বিয়েটা সেরে ফেলেছিল। আচ্ছা, সেদিনের ঘটনায় সে কী প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছিল? কে জানে? কোনও কোনও জিনিস জানবার কৌতূহল থাকলেও উপায় থাকে না।
বারান্দার এক কোণ বেয়ে নাম-না-জানা লতানে একটা গাছ উঠেছে। তার ডালপালাগুলি কোথাও কোথাও এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে, দেখে মনে হচ্ছে, কেউ বাহু মেলে কাউকে ধরবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মনোরম পরিবেশ। সন্ধ্যের এই সময়টায় বেশ সুন্দর বসন্তকালীন হাওয়া দিচ্ছিল। রাত গড়ালেই অবশ্য ঠান্ডা ফিরে আসবে আবার। ভোরের দিকে ব্ল্যাঙ্কেটের তলায় না সেঁধুলে ঘুমটাই বরবাদ হয়ে যাবে। এখন কেউ ইচ্ছে করলে এখানেই আড্ডা জমাতে পারে, মনে হল অনিলের। যদিও সে আড্ডা জমানোর চেয়ে একাকী অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানাটাকেই উপভোগ করছিল। আর মনে মনে ভাবছিল, অনেক কিছু। গাড়ল আর্যটার কথা, যার কবিতা তার কাছে রাবিশ লাগে। ইচ্ছে করে ওর চুলের মুঠিটা ধরে সজোরে দেওয়ালে ঠুকে দেয়।
শালা উন্মেষার কাছে তার নামে নিশ্চয়ই কিছু চুকলি কেটেছে, তা না হলে এখানে আসা ইস্তক ধান্দাবাজ মেয়েছেলেটা ভালো করে কোনও কথাই বলছে না তার সঙ্গে। যেন সে অনিলকে চেনেই না, আগে কখনও দেখেনি। এসব মেয়েকে…! মনে মনে আরও কিছু নোংরা কথা ভাবল সে। আর্য না চলে গেলে এখন হয়তো তার ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে হতো। তার চেয়ে এই বেশ ভালো। তার তো মনে হয়, আর্য কোনও দেহাতি মেয়ের সঙ্গে রাতে ফূর্তি জমাতে গিয়েছে। তা না হলে, হঠাৎ করে কোনও ফোন এল আর সে স্কুপ নিউজ করতে চলে গেল, এ হতে পারে না। শালা, মুখে যতই সতীপনা দেখাক, আর্য যে আসলে কী, সেটা কেবল সে-ই জানে। আজ থেকে বছর ছয়েক আগের সেই পার্টিতে যারা যারা সেদিন উন্মেষার পানীয়তে নেশার ওষুধ মিশিয়ে তার সঙ্গে রংরলিয়া মানিয়েছিল, তাদের মধ্যে আর্যও ছিল। তার তো মনে হয়, সেই লজ্জা ঢাকতেই উন্মেষা তড়িঘড়ি হিরণ্ময়ের সঙ্গে প্রেমের নাটক করে বিয়েটা সেরে ফেলেছিল। আচ্ছা, সেদিনের ঘটনায় সে কী প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছিল? কে জানে? কোনও কোনও জিনিস জানবার কৌতূহল থাকলেও উপায় থাকে না।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল
দশভুজা: সেই ষোলো মিনিটের দূরত্ব কোনওদিন পূরণ হয়নি
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন
একটা কথা সে প্রায়শই ভাবে, হিরণ্ময়কে হারিয়ে উন্মেষা কি আদৌ দুঃখ পেয়েছে? না কি সবটাই তার নাটক? তা যদি হয় বলতে হবে, উন্মেষার এ ভাবে এর-ওর পিছনে না পড়ে সিরিয়ালে নাম লেখানো উচিত। তার বুকটা তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও উন্মেষার শোক তাকে যেন পাথর করে দিচ্ছিলো।
আচ্ছা, ওটা কী গাছ? বারান্দার থাম বেয়ে কি কোন গাছ দেখেছিল আজ সকালে? যদি না দেখে তাহলে গাছটা তো আর রাতারাতি গজিয়ে উঠতে পারে না! তাহলে?
অনিল বাইরের দিকে তাকালো। ঝকঝকে সন্ধ্যার আকাশে তারাদের মেহফিল জমে উঠেছে। আকাশ জুড়ে নক্ষত্রের আলপনা দিচ্ছে অদৃশ্য কেউ। এই বিশ্বসংসারের নিয়ামক সে। তার চাওয়াতেই কেউ ফুটে ওঠে, কেউ ঝরে যায় আচমকা। আচ্ছা, আজ আর্যও যদি এমনিভাবে ঝরে যায়, আর না ফেরে? তাহলে কেমন হয়? তার মনের কথা জেনে ফেলে বারান্দার থাম বেয়ে উঠে আসা লতাটা যেন খুশিতে মাথা দুলিয়ে বলে উঠছিল, বেশ হয়, বেশ হয়।
আচ্ছা, ওটা কী গাছ? বারান্দার থাম বেয়ে কি কোন গাছ দেখেছিল আজ সকালে? যদি না দেখে তাহলে গাছটা তো আর রাতারাতি গজিয়ে উঠতে পারে না! তাহলে?
অনিল বাইরের দিকে তাকালো। ঝকঝকে সন্ধ্যার আকাশে তারাদের মেহফিল জমে উঠেছে। আকাশ জুড়ে নক্ষত্রের আলপনা দিচ্ছে অদৃশ্য কেউ। এই বিশ্বসংসারের নিয়ামক সে। তার চাওয়াতেই কেউ ফুটে ওঠে, কেউ ঝরে যায় আচমকা। আচ্ছা, আজ আর্যও যদি এমনিভাবে ঝরে যায়, আর না ফেরে? তাহলে কেমন হয়? তার মনের কথা জেনে ফেলে বারান্দার থাম বেয়ে উঠে আসা লতাটা যেন খুশিতে মাথা দুলিয়ে বলে উঠছিল, বেশ হয়, বেশ হয়।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৭: আপন হতে আপন জন ‘রাইকমল’
হাত বাড়ালেই বনৌষধি: চৈত্রের বন্ধু বেল
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১১: লিকার চা খাওয়া কি সত্যই শরীরের পক্ষে ভালো?
বাইরের দিক থেকে একটা হাড়-কাঁপানো ঠান্ডার স্রোত বয়ে গেল, বসন্তকালের পক্ষে যা বেমানান। দার্জিলিং-এ কি আবার তুষারপাত হচ্ছে? কিংবা উত্তর ভারতের কোথাও? বাংলা টিভি খুললেই সেই একই কিস্সা ! রাজনীতি আর রাজনীতি। আর একটাই আত্মপ্রসাদ, আমি করেছি কিংবা আমরা করেছি। আদতে যে করে, সে নিজেকে এ ভাবে উন্মুক্ত করে দেয় না। সহজতার মধ্যে একপ্রকার উপেক্ষা থাকে। যদিও অনিলের তিনকুলে কেউ নেই, আর পার্টিতে কে অচেনা-অজানা লোক তাকে উপেক্ষা করল না কী সাদরে বরণ করল, এ সব তার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। অনিল অন্যদিকে তাকাল। তার গলাটা শুকিয়ে আসছে। সে একটা জলের বোতলের জন্য ঘরের দিকে পা বাড়াল। পিছনে যদি সে দেখত, তাহলে জানতে পারত, থামের গা বেয়ে উঠে আসা লতাটার একটা শাখা সর্পিল গতিতে বড় হতে হতে যেন তার দিকেই এগিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল, আবার ফিরেও যাচ্ছিল।—চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।