শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

রাস্তার দু’পাশে কিছু ঝোপঝাড়, ছোট ছোট শাল গাছও হয়ে রয়েছে, তবে ওগুলি বাড়বে না। বড় গাছগুলি, যে গুলি থেকে বীজ পড়ে এই গাছগুলি হয়েছে, তারাই ওদের মাথা তুলতে দেবে না বেশিদিন। আসলে আধিপত্য আর আত্মরতি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। মানুষের মতো গাছেদের সমাজেও একই নিয়ম।

পুলিশের গাড়িটা থামল রাস্তার ধার ঘেঁষে। একটুও দেরি না করে সুদীপ্ত লাফ দিয়ে নামলো। অভিষেকের ভারি শরীর। তাঁর নামতে দেরি হল। সুদীপ্ত ততক্ষণে এগিয়ে গিয়েছে বাইকের দিকে। রামদাস তার পিছনে।

বাইকটার সামনের অংশের বেশিরভাগটাই গাছপালার গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে রাখা ছিল, তবে পিছনের কিছু অংশ বেরিয়ে ছিল রাস্তার দিকে। আসলে এই জাতীয় লেটেস্ট মডেলের স্পোর্টস বাইকগুলি আকারে একটু বেশি লম্বা হয় সাধারণ বাইকের চেয়ে। সম্ভবত সে কারণেই বাইকটি সম্পূর্ণ আড়ালে রাখা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এই বাইক নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে বেশিদূর যাওয়া অসম্ভব, সেই কারণেই মোটামুটি কাজ চলার মতো করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তাছাড়া পুরনো মোকামের জঙ্গলের দিকে কেউ সচরাচর আসে না। যে সব ট্রাক, লরি ইত্যাদি এই রোড ধরে যায়, সেগুলিও এই জায়গাটি দ্রুত পার হতে পারলেই যেন বাঁচে। ফলে, তারা বাইকটি না-ও দেখতে পারে।

তাছাড়া অনেক দুঃসাহসী ট্যুরিস্ট থাকে, যারা এই জঙ্গল এক্সপ্লোর করতে আসতে পারে। তাদের কেউ এ ধরণের বাইক এনে জঙ্গলে ঢোকার আগে মোটামুটি গোছের আড়াল করে রেখে গেছে, এমন ভেবে নেওয়াও অসঙ্গত নয়। সেই কারণেই বাইকটি ওখানে থাকলেও কারুর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে, এটি চোরাই বাইক। তাছাড়া বাইকটি কাল দুপুরের পর থেকে মিসিং। এত তাড়াতাড়ি কারও পক্ষে জানাও সম্ভব না, জানলে তাদের কেউ না কেউ আগেই খবর দিত। কারণ, সুদীপ্তের মন বলছে এই দামি বাইকটিই অঞ্জনের, যেটা অর্ক নিয়ে গিয়েছিল কাল দুপুরে। ভাগ্য ভালো যে, বাইকটি অতি দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব হল। সুদীপ্ত বাইকটির দিকে এগিয়ে গেল।
বাইকটির রঙ অরেঞ্জ আর হোয়াইট মেশানো। একেবারে ঝাঁ চকচকে লেটেস্ট মডেলের বাইকটি কিন্তু এখন ধুলোয় ধুসরিত। খুব কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সুদীপ্ত। বাইকটির জায়গায় জায়গায় আঁচড়ের দাগ। কোথাও ঘষা লেগে যেন এক দিকের রঙ উঠে গেছে খানিকটা। উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে চুরমার। ট্যাঙ্কটা খুলে দেখল সুদীপ্ত, তেল একেবারে শেষ। তার অর্থ, বাইকটা এখানে রাখার আগে কিংবা পরে এর তেল সব বের করে নেওয়া হয়েছিল। কেন? বাইকটা যাতে কেউ এখান থেকে তাড়াতাড়ি না নিয়ে যেতে পারে, সেজন্য? না কী, বাইকটা এতদূর পাড়ি দিয়েছিল যে এখানে আসতে আসতেই তেল ফুরিয়ে গিয়েছে? মাথায় কিছু এল না সুদীপ্তর।

আসলে সে তখন বাইকের গায়ে রক্ত ইত্যাদির মার্ক খুঁজছিল। সে ধরেই নিয়েছে অর্ক এই বাইকটির উপর বসা অবস্থাতেই হয় অ্যাকসিডেন্ট নয়, কালদেও নামক কোন আততায়ীর হাতে নিহিত হয়েছিল এবং তার মুণ্ড চিবিয়ে কিংবা ছিঁড়ে খাবার সময় নিশ্চয়ই রক্ত-ঘিলু ইত্যাদি ছিটকে পড়ে থাকবে। বাইকের গায়ে তার কোনও চিহ্নমাত্র পাওয়া যাবে না? অবশ্য ফরেন্সিকে পাঠালে তাঁরা নিশ্চয়ই কোনও না কোনও সূত্র আবিষ্কার করবেনই। একটা ব্যাপারে সে নিঃসন্দেহ হল, কালকে যেখানে লাশটা মিলেছে, সেখানে ফরেন্সিক টিম স্যারকে বলে আজকেই পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে, অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সন্দেহ নেই, ঘটনাটি ঘটেছিল যেখানে অর্কর মুণ্ডহীন লাশটি মিলেছে সেইখানেই। কারণ, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ মতে, কালাদেও তখন রাস্তার উপর পড়ে থাকা মৃতদেহর উপর ঝুঁকে পড়ে রক্ত কিংবা আর কিছু খাচ্ছিল। হয়তো বাস সেই সময় না পৌঁছলে বুধন মাহাতোর মতো গোটা দেহটাই সেই অদ্ভুত প্রাণীটি খেয়ে ফেলত।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩৪: দ্বিতীয় লাশ

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৮: ও দয়াল! বিচার করো!

আশেপাশে তাও একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। যদি পোড়া বিড়ি, সিগারেট কিংবা আর কিছু পড়ে থাকে ইতিউতি। তাহলে অন্তত বোঝা যাবে, কত জন ছিল কিংবা যারা ছিল তাদের ক্লাস। কিন্তু না, তেমন কিছুই চোখে পড়ল না তার। গাছের তলায় শুকনো পাতার স্তুপ। যেমন হয়, এই ধরণের জঙ্গলে। অভিষেক বিরক্ত হচ্ছিলেন। এত কী দেখার আছে বাইকে, তা তাঁর মাথায় ঢুকছিল না। মৃত্যু হয়েছে কতদূরে বাসরাস্তায়, এখানে বাইকটা নিশ্চয়ই কোন চোর, যে কি না মৃত্যুর পর পরই ওইখান দিয়ে পার হচ্ছিল, সেই নিশ্চয়ই বাইকটা চুরি করে এখানে এনে রেখেছিল, পরে সুযোগ বুঝে নিয়ে যাবে বলে। তার আবার এত কী দেখার আছে বাপু? থানায় বাইকটা চালান করে সিজার লিস্টে তুলে রাখ, তারপর আর চিন্তা করার কিছু নেই। পড়ে পড়ে এভিডেন্সও নষ্ট হবে, কেসের রায়দানেও দেরি হবে, সঠিকও হবে না। তাতে আমাদের কী বাপু? আমরা মাস গেলে মাইনে পাই, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এই খান পর্যন্ত আসাটাই আমাদের কাজ।

মনে মনে নিজেকে বললেন, “এই করেই তুমি বাপু পঁয়ত্রিশটা বছর কাটিয়ে এসেছ। আর ক’টা দিন কাটিয়ে দাও। তারপর নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমাও। ওই সব পলিটিক্যাল নেতা থেকে শুরু করে ঘেমো জামা গায়ের আম-জনতা, কেউ আর থানার ধারকাছ মাড়াবে না। সুদীপ্তকে অসহিষ্ণু হয়েই বললেন, “কী হে, এত কী দেখছ। বাইকটা কেউ চুরি করে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছে পরে নিয়ে যাবে বলে। এটাই তো ঘটনা। তা এখানে এত সময় নষ্ট না করে আমরা তো অন্যত্র যেতে পারি!
সুদীপ্ত অভিষেকের উদ্দেশে বলল, “স্যার, একটা খটকা যাচ্ছে না!”
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১০: পর্ব-১০: কী উপহার সাজিয়ে দিলে…

পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা

অভিষেক অবাক হলেন। এই আজকালকার ছেলে-ছোকরারা যারা এই লাইনে আসছে, তারা সবাই নিজেদের ব্যোমকেশ বক্সী, কিরীটী রায় কিংবা ফেলুদা বলে মনে করে। কাজে বেলায় অষ্টরম্ভা। এই রকম তদন্ত করে করে তাঁর মাথার চুল সব ঝরে গেল। এরা খটকা শেখাতে এসেছে ? মনে মনে ভয়ানক ক্রুদ্ধ হলেও মুখে কিছু বললেন না অভিষেক। ছেলেটা চটে গেলে তাঁরই ক্ষতি। তাহলে আবার তাঁকে পরিশ্রম করে এখন কালাদেওর রহস্য ভেদ করতে হবে। কী দরকার? তাঁর নব্বই কেজির নধর শরীরটা এই সমস্ত বাজে চিন্তায় নষ্ট হোক তা তিনি কোনমতেই চান না। ফলে মনের বিরক্তি মনেই গোপন রেখে বললেন, “কিসের খটকা হে?”
সুদীপ্ত বলল, “বাইকটা ওরা পুরানা মোকামের এই জঙ্গলে লুকিয়ে রাখল ঠিক আছে। কিন্তু যে বা যারা এই ঘটনাটা ঘটালো, সে বা তারা কি তবে তবে বাইরের লোক ?”
“মানে ?”
“স্থানীয় লোক হলে তারা পুরানা মোকামের জঙ্গল এড়িয়ে চলত। তার উপর যদি ধরে নেই সন্ধ্যে নামার সময় ঘটনাটা ঘটেছে, তারপর এই একেবারে বিপরীত দিকে বাইকটা এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তাতে তো দুটি জিনিস স্পষ্ট হয়।”
“যেমন ?”
“যেমন এক নম্বর খটকা, যে কালাদেও কিংবা আর কেউ ভিকটিমের লাশের উপর ঝুঁকে পড়ে তাঁর মুণ্ড চিবুচ্ছিল, সে ঘটনাটা ঘটার অনেক পরে এসেছে। কারণ, বাস দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে সরে পড়েছে পাশের জঙ্গলের মধ্যে। তার পক্ষে বাইকটা লুকানো এককথায় অসম্ভব। তাছাড়া বাসে উপস্থিত কেউই কোন বাইক বা আর কোন গাড়ির আওয়াজ শোনেনি তারপর। আমি জিজ্ঞাসা করে দেখেছি। অতএব আগেই বাইকটি স্থানান্তরিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে এই ঘটনা কোন একজন আততায়ীর পক্ষে ঘটানো কোয়াইট ইম্পসেবল! সংঘটিত অপরাধ হতে পারে সেক্ষেত্রে। দ্বিতীয় খটকা, স্থানীয় লোক ঘটনাটির সঙ্গে যুক্ত থাকলে তারা অন্য জঙ্গলে গিয়ে বাইকটা লুকাতো। কিংবা সোজা বাইক চালিয়ে পাশের রাজ্যে পৌঁছে যেতে পারত। এখানে তেলের ট্যাংক খালি করে বাইকটি সকলের চোখের সামনে ফেলে অর্ধ-লুকানো অবস্থায় রেখে যেত না। তৃতীয় খটকা, এই জঙ্গলে যেখানে দিনের বেলাতেই সংস্কারবশত মানুষজনের আনাগোনা কম, সেখানে প্রায় সন্ধে নামার পরে কেউ বাইক চালিয়ে এখানে এসে বাইক লুকিয়ে রেখে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারে, সেটাই তো আমাকে অবাক করেছে স্যার। বাইরের লোক, যে এই জঙ্গলের ব্যাপারে প্রচলিত মিথ জানে না, তার পক্ষে এটা সম্ভব হলেও হতে পারে। কিন্তু স্থানীয়দের পক্ষে এটা অসম্ভব। অতএব আমার মতে এই ঘটনার সঙ্গে বাইরের যোগ থাকা অসম্ভব নয়!”
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৮: পার্ক, ইট, এঞ্জয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?

অভিষেক চমৎকৃত হলেন। ছেলেটার এলেম আছে। লম্বা রেসের ঘোড়া। অনেকদূর যাবে। মুখে বললেন, “হুম! বুঝলাম।”
“স্যার! যদি কিছু মনে না করেন আমাদের এক্ষুনি কালকের সেই অকুস্থলে যাওয়া প্রয়োজন। ফরেন্সিক টিমকে নিয়ে। সেখানে নিশ্চয়ই অনেক সূত্র পড়ে আছে, যা কাল রাতের বেলা দেখা সম্ভব হয়নি। আবার খালি চোখে দেখা না-ও যেতে পারে, এমন কোন সূত্র থাকাও অসম্ভব নয়।”
“তাহলে কী করতে বল এখন ?”
“ওখানেই যেতে হবে আগে। আপনি ফরেন্সিক এক্সপার্টকে ফোন করুন!”
“কিন্তু আজ যে ওই রিসর্টের পার্টির থানায় আসার কথা। ওরা সনাক্ত করবে না ওই কী যেন নাম, হ্যাঁ অর্কের লাশ কি না। তার কী হবে?”
“সনাক্ত পরে করলেও হবে স্যার। আগে সূত্র পেতে হবে। ওই জিনিসটা দেরি হয়ে গেলে ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে। লাশ তো ভ্যানিশ হবে না!”
অভিষেক তাঁর পকেট থেকে মোবাইল বার করলেন। তারপর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। এতগুলি মিসড্‌ কল! কে করেছে? দেখলেন, পিশাচ পাহাড় রিসর্টের ম্যানেজার কাপাডিয়া একাই করেছেন দশবার ফোন, থানা থেকেও দু’বার ফোন এসেছে। কিছু বিপদ-আপদ হল না তো? তিনি প্রথমে কাপাডিয়াকে করবেন বলেও করলেন না। আগে থানা থেকে কেন ফোন এসেছে তিনি জানুন, তারপর শালা কাপাডিয়ার বাচ্ছাকে ফোন করবেন।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content