নুনিয়া দৌড়াচ্ছিল। অন্ধকারে যত জোরে দৌড়ানো যায়, সম্ভবত তার চেয়েও বেশি জোরে। এর আগে সে পালিয়েছে হোস্টেল থেকে, স্কুল থেকে, চার্চের ঘেরাটোপ থেকে, কিন্তু এত রাতে কখনও নয়। যে-পথ দিয়ে সে এর আগে বহুবার পালিয়েছে, এমনকি শাস্তি পাওয়ার পরেও পালিয়েছে, সেই পথই এত রাতে তার কাছে অজানা-অচেনা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই তাকে পালাতেই হবে। কারণ, তার সিক্সথ্ সেন্স বলছে যে, যত তাড়াতাড়ি সে যত দূর চলে যেতে পারবে, ততই তার বেঁচে থাকার কাল দীর্ঘ হবে। আর যাই হোক, এখনই সে মরতে চায় না!
আকাশে বাঁকা চাঁদ আছে। আর আছে অসংখ্য তারা। অদ্ভুত ব্যাপার গোটা জঙ্গল জুড়েই আজ কেমন নিস্তব্ধতা। ঝিঁঝিঁ পোকারাও ডাকছে না আজ! ওরা কি রোজই ডাকে, না-কি কোনও-কোনওদিন ওদেরও বিশ্রামের দিন, রেস্ট-ডে? জানে না সে। মোটামুটি রাস্তা অনুমান করে নিয়ে সে দৌড়াচ্ছে। দু’বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে গিয়ে সামলেও নিয়েছে। সবচেয়ে অসুবিধা হল, আসার সময় সে পায়ে স্লিপার বা কিছু গলিয়ে আসতে পারেনি, ফলে খালি পায়েই তাকে দৌড়াতে হচ্ছে। এই রুক্ষ কাঁকুরে মাটির ওপর দিয়ে আন্দাজে দৌড়ানো যে কী অসুবিধাজনক, তা সে হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে। মাঝে মধ্যে মুহূর্তমাত্র সময় সে থেমে দম নিচ্ছে, বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক সেই সময়ে কান পেতে শুনতে চাইছে, আর কোন পায়ের শব্দ তাকে অনুসরণ করছে কি-না। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে তার।
আকাশে বাঁকা চাঁদ আছে। আর আছে অসংখ্য তারা। অদ্ভুত ব্যাপার গোটা জঙ্গল জুড়েই আজ কেমন নিস্তব্ধতা। ঝিঁঝিঁ পোকারাও ডাকছে না আজ! ওরা কি রোজই ডাকে, না-কি কোনও-কোনওদিন ওদেরও বিশ্রামের দিন, রেস্ট-ডে? জানে না সে। মোটামুটি রাস্তা অনুমান করে নিয়ে সে দৌড়াচ্ছে। দু’বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে গিয়ে সামলেও নিয়েছে। সবচেয়ে অসুবিধা হল, আসার সময় সে পায়ে স্লিপার বা কিছু গলিয়ে আসতে পারেনি, ফলে খালি পায়েই তাকে দৌড়াতে হচ্ছে। এই রুক্ষ কাঁকুরে মাটির ওপর দিয়ে আন্দাজে দৌড়ানো যে কী অসুবিধাজনক, তা সে হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে। মাঝে মধ্যে মুহূর্তমাত্র সময় সে থেমে দম নিচ্ছে, বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক সেই সময়ে কান পেতে শুনতে চাইছে, আর কোন পায়ের শব্দ তাকে অনুসরণ করছে কি-না। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে তার।
বসন্তকাল। শীতঘুম শেষ করে কালাচ কিংবা চন্দ্রবোড়ার দল বেরিয়ে পড়েছে, ছোটখাটো ময়ালও এই জঙ্গলে আছে, তবে সংখ্যায় কম এবং কালেভদ্রে কেউ দেখতে পায়। রাতেই তাদের শিকারের সময়। একবার এদের কারও পাল্লায় পড়লে তাকে যে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে হবে না, তা সে ভালো করেই জানে। তার এখন সামনে-পিছনে দু’দিকেই বিপদ। দিনের আলোয় হলে সে এত ভয় পেত না। সাপের সঙ্গে মোকাবিলা করার শিক্ষা তার আছে। তাছাড়া গাছ বেয়ে-বেয়ে অনেকদূর অবধি সে চলে যেতে পারে, তার কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু রাতের বেলা এখনও সে অনভ্যস্ত। যদি রাতের বেলা বেরুনোর অভ্যাস তার থাকতো, তাহলে সেই দিন বুধন সেজে থাকা ছেলেটি কি আর পালাতে পারত? আর পালালেও সে তার পিছন-পিছন গিয়ে ঠিক তার পাতা-ঠিকানা জেনে আসত। আগে তার সন্দেহ হয়েছিল, কেমন যেন আচরণ, কিন্তু পরে ভেবেছিল, অসুস্থ হলে সকলেরই আচার-আচরণ পাল্টে যায়, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হেলথ্সেন্টারে যখন নকল বুধন বাধ্য হল তার আবরণ মোচন করতে, তখন দূর থেকে দেখেই সে বুঝতে পেরেছিল, এ-তার বুধনদা কখন হতে পারে না, কখন নয়! সে চোখে-চোখে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু সকলেই তাকে ভুল বোঝে। ডাক্তারবাবুও। যদিও সে জানে, মানুষটি আসতে ভালো এবং সে-কারণেই তাঁর হাতে জঙ্গলে পাওয়া সেই মোবাইলটা সে দিতে বলেছিল। যদিও সে জানে না, ঠিক কী-কী আছে সেই মোবাইলে। তারপরেও তার ধারণা, ওই মোবাইলে এমন কিছু হয়তো পাওয়া যেতে পারে, যার ফলে হয়তো কিছু অপরাধ এবং অপরাধীকে ধরা সম্ভব হবে। বিশেষ করে সাইকেল মাহাতর মতো অপরাধীকে ধরাই উচিত। সে আজও দেখেছে, সাইকেল মাহাত চার্চের কাছে ঘুরঘুর করছে। তারপর তো সন্ধ্যার সময় দেখল তিনটে অ্যাম্বুলেন্স এসে চার্চের মধ্যে ঢুকল। তারা শুনেছে, ক’দিন আগে যে দশজন ছেলে-মেয়েকে চার্চের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, তাদের কিছু ক্লিনিক্যাল চেকআপের জন্য, তাদের মধ্যে সাতজনের অবস্থা না-কি ভালো নয়। তাদের সম্ভবত ক্যানসার হয়েছে। এই হাসপাতালে ক্যানসার ডিটেক্ট করার মতো কোন ব্যবস্থা নেই এখনও, ফলে তাদের টাটানগর নিয়ে যাওয়া হতে পারে। কাছাকাছি চার্চের আর-একটি ব্রাঞ্চ আছে, সেখানেই আপাততো থাকবে এরা। যতদূর বুঝেছে সে, আজ রাতেই এই সাত জনকে এখানে থেকে স্থানান্তরিত করা হবে এবং এরা আর কোনওদিন এই চার্চে ফিরে আসতে পারবে না। ওখানেই থাকতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার, যেদিনই এমন ঘটে, সেদিনই সাইকেল মাহাতকে দেখা যায় চার্চের চৌহদ্দীতে। ফাদার তাকে খুব স্নেহ করেন, বিশ্বাস করেন সত্য, কিন্তু নুনিয়ার নিজের মনে হয়, এই বিশ্বাসের যোগ্য সাইকেল নয়।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৬: যদি হই চোরকাঁটা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে
ভ্য তাড়ানোর জন্য এটা-ওটা ভাবছে সে, কিন্তু তার কান খাড়া হয়ে আছে, কোন পদশব্দ বা আর কিছুর জন্য। আচ্ছা, লোকটি নিশ্চয়ই এতক্ষণে টের পেয়ে গিয়েছে, সে নেই। লোকটি কী করবে তাকে বিছানায় না পেয়ে? হয়তো সারা রুম খুঁজবে। যদিও রুমটা এতটাই ছোট যে এক মিনিটও লাগবে না রুমের মধ্যে কেউ নেই তা বোঝার জন্য। একটা ভাঙাচোরা কাবার্ড আছে রুমে, সেটিও খুলে দেখবে সে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেখানে তাকে পাবে না। দেখবে সামান্য কিছু জামাকাপড়, কিছু বই, জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা ডাল, পাথর ইত্যাদি আর প্রভু যিশু ও বড় ফাদারের একখানা করে ছবি। বড় ফাদারই পিতলের বাঁধানো ফ্রেমে প্রভু যিশুর ছবিটি দিয়েছিলেন তাকে। বলতে গেলে, ওইটিই তার কাছে সারাজীবনে পাওয়া একমাত্র দামি উপহার। সেসব দেখতে লোকটির আধ মিনিট লাগবে বড়জোর। লোকটি নিশ্চয়ই রাগে কাবার্ডের মালপত্র সব নীচে ফেলে দেবে! তবে আর-একটা জিনিস সে খুঁজেও পাবে না। কারণ, সে দেখতেও পাবে না। যে-রেখেছে সে, এবং যারা কাবার্ডের প্রতিটি সেলফের উপরের সঙ্গে সঙ্গে তার তলাগুলিও ভালো করে পরীক্ষা করবে, তাদেরই চোখে পড়তে পারে কেবল। একেবারে নীচের সেলফের পার্টিশনের তলার দিকে ব্রাউন সেলোটেপ দিয়ে আটকে রাখা ছোট্ট একটি পেনড্রাইভ। বড় ফাদার শেষ দিন দেখা হওয়ার সময় তাকে সেটি লুকিয়ে রাখতে বলেছিলেন। এরপর তো তাঁর অসুখ আরও বাড়োল এবং তার বড় ফাদারের কাছে যাওয়াও নতুন ফাদার বন্ধ করে দিলেন। সে জানে না কী আছে সেই পেনড্রাইভে, কিন্তু এটুকু অনুমান করতে পারে, এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু, যা এই মুহূর্তে বড় ফাদারের কাছে থাকা উচিৎ নয়। বড় ফাদার লুকিয়ে তার হাতের মুঠোয় সেটি ভরে দিয়ে খুব ফিসফিস করে বলেছিলেন, “খুব গোপনে লুকিয়ে রাখিস! কেউ যেন টের না পায় এটা তোর কাছে আছে, তাহলে ওরা তোকে মেরে ফেলে হলেও ওটা কেড়ে নিতে আসবে। যদি আমি আর না-বাঁচি তাহলে এটা যাচাই করে পুলিশের কোন বড়কর্তাকে দিস। তার আগে নয়!” একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল নতুন ফাদারের একজন বিশ্বাসভাজন। এমনিতে সে এখন ফাদারের ঘরে রাখা বুকসেলফের বই, যা সে এর আগে হাজারবার দেখেছে, সেগুলি এখন মগ্ন হয়ে দেখতে ব্যস্ত। যদিও নুনিয়া বোঝে, এ-সব লোকটির ভাণ। আসলে লোকটি কান পেতে আছে, তার সঙ্গে বড় ফাদার কী কথা বলেন, সে-সব শোনার জন্য। নতুন ফাদারের যে বড় ফাদার আর তাকে নিয়ে কী ভয়, কে জানে? সেই কারণেই যখনই সে বড় ফাদারের কাছে যেত, তখনই কোন-না-কোন লোক সঙ্গে থাকত। মুখে বলা হত, যেহেতু বড় ফাদার গুরুতরভাবে অসুস্থ, অতএব কথা বলতে গিয়ে কোন কারণে যাতে উত্তেজিত না হয়ে যান, সেই কারণে একজন ঘরের মধ্যে থাকেন। কেউ-না-কেউ না-কি সেইজন্য পালা করে চব্বিশ ঘণ্টাই বড় ফাদারের ঘরে উপস্থিত থাকেন। এর মধ্যেই কায়দা করে বড় ফাদার যেদিন পেনড্রাইভখানা দেন, সেদিনও উত্তেজনায় তার বুক ঢিপঢিপ করছিল। দ্রুত সেটা ফ্রকের তলায় ইজেরের পকেটে চালান করে দিয়েছিল সে। ওরা ভিতরে যাওয়ার সময় চেক করে ঢোকায়, বলে, যাতে কেউ কোন বাইরের খাবার লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে ফাদারকে না-খাওয়াতে পারে, তার জন্য চেকিং। তবে নুনিয়া জানে, এ-সব মিথ্যে কথা। তবে বাইরে বেরুনোর সময় আর করার দরকার মনে করে না। কারণ, বড় ফাদারের সঙ্গে তার কী কথা হচ্ছে এবং কিছু আদানপ্রদান হচ্ছে কি-না সে-তো যিনি পাহারায় থাকেন, তিনিই গিয়ে রিপোর্ট করবেন। অতএব পেনড্রাইভটা হয়তো বাইরে বের করে নিয়ে যেতে পারবে বলে ভেবেছিল নুনিয়া। করেওছিল। তারপর চার্চের অফিস থেকে কাজের অছিলায় ব্রাউন সেলোটেপ বাগিয়ে পেনড্রাইভটি লুকিয়েও রেখেছে এতকাল সঙ্গোপনে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৮: মা সারদার ‘পরকে আপন করা’
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ
আচ্ছা, হঠাৎ করে মনে হল নুনিয়ার, লোকটি যদি তাকে ধরতে না-এসে ওই পেনড্রাইভটার খোঁজেই আসে, তাহলে? তাহলে তো লোকটি বেডের কাছে এসে আগে চেক করে দেখে নিয়েছে সে ঘুমাচ্ছে কি-না। তারপর এদিক-ওদিক লণ্ডভণ্ড করে খুঁজতে থাকবে। তখন কী একবারও লোকটির মনে হবে না যে, কাবার্ডের সেলফের তলার দিকে যে-কেউ ওটা আটকে রাখতে পারে? একবার যদি মনে হয়, তাহলে নুনিয়া গিয়েছে! আর কোনওদিন বড় ফাদারের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। উনি হয়তো কিছু বলবেন না তাকে, কিন্তু বাকিরা যারা জানতে পারবে সব, তাঁরা তখন ওকে বলবেন, “একটাই সামান্য কাজ দেওয়া হয়েছে, তাও নুনিয়া পারে না!” প্রভু যিশুর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করল সে, লোকটি যেন পেনড্রাইভটি খুঁজে না পায়!
গাছগুলি দীর্ঘ প্রেতচ্ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কর্কশ শব্দ করতে করতে উড়ে গেল পেঁচা। এ-সবে ভয় পায় না নুনিয়া। সেই কোন ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে কত কী যে শিখেছিল, জেনেছিল। পেঁচার ডাক, শকুনের ছানার চিৎকার, সাপে যখন ইঁদুর ধরে তখন তাদের আওয়াজ সেভাবেই চেনা। মা বলতেন, জঙ্গলকে আর তার প্রাণিদের স্বভাব আর স্বর না চিনলে তাদের এই জন্মটাই বৃথা। জঙ্গল তাদের অন্নদাতা মা আসলে, অতএব জঙ্গলকে চিনতে-জানতে হবে, ভালোবাসতে হবে, নাহলে জঙ্গলের ঋণ শোধ না করে গেলে জঙ্গল ক্রুদ্ধ হন, অন্য জন্মে তার বদলা নেন!
গাছগুলি দীর্ঘ প্রেতচ্ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কর্কশ শব্দ করতে করতে উড়ে গেল পেঁচা। এ-সবে ভয় পায় না নুনিয়া। সেই কোন ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে কত কী যে শিখেছিল, জেনেছিল। পেঁচার ডাক, শকুনের ছানার চিৎকার, সাপে যখন ইঁদুর ধরে তখন তাদের আওয়াজ সেভাবেই চেনা। মা বলতেন, জঙ্গলকে আর তার প্রাণিদের স্বভাব আর স্বর না চিনলে তাদের এই জন্মটাই বৃথা। জঙ্গল তাদের অন্নদাতা মা আসলে, অতএব জঙ্গলকে চিনতে-জানতে হবে, ভালোবাসতে হবে, নাহলে জঙ্গলের ঋণ শোধ না করে গেলে জঙ্গল ক্রুদ্ধ হন, অন্য জন্মে তার বদলা নেন!
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৬: রাজনৈতিক পরিসরে অখ্যাতি ও সন্দেহর আবিলতা থেকে কি মুক্তি সম্ভব?
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়
তার পায়ের ধাক্কায় একখানা বড় নুড়িপাথর ছিটকে গিয়ে লাগল পাশের একটি গাছে। পায়ের আঙুলটা যেন থেঁতলে গেল বলে মনে হল নুনিয়ার। কিন্তু সে গ্রাহ্য করল না। এখন সে যেখানে এসে পড়েছে সেখানে জঙ্গলের গা ঘেঁষেই চাষের ক্ষেত। তার উপর ক্ষীণ চাঁদের আলো না এসে পৌঁছলেও তারার আলোয় কেমন একটা অপার্থিব সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে। কুয়াশার মিহিন স্তর থাকলেও তা সব কিছুকে ঢেকে দেয় নি আজ। নুনিয়া অবশ্য ক্ষেতের উপর দিয়েই দৌড়াতে পারত। কারণ, ক্ষেত এখন শস্যশূন্য। কয়েকটি ক্ষেতে অবশ্য ঝিঙে, তরমুজ ইত্যাদি লাগানো হয়েছে, কিন্তু বাদবাকি ক্ষেত ফসল কেটে নিয়ে যাওয়ার পর এখন সম্পূর্ণ ন্যাড়া। সেই পথে গেলে নুনিয়া হয়ত কিছুটা দেখতে পেত যাত্রাপথ। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই ক্ষেতের পথ ধরে নি, কারণ, ওই পথে গেলে তার আর প্রয়োজনে লুকানোর কোন জায়গাই থাকবে না। কিন্তু জঙ্গলের পথ ধরে গেলে কিছুটা হলেও সে নিরাপদ। এইজন্যই সে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে না গিয়ে এত রাতে বিপদ অনেক বেশি ঘটতে পারে জেনেও জঙ্গলের পথ ধরেছে। এখানে রাতের দিকে এখনও হিম পড়ে, তবে অনেক সহনীয়। তাও গরম লাগার কথা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে সে দরদর করে ঘামছে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন ! বুকের মধ্যে হাজার একটা হাতুড়ি যেন একসঙ্গে পিটছে কেউ!
আরও পড়ুন:
শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক
আচ্ছা, দৌড়াতে দৌড়াতে সে ভাবে, এই যে সে চলেছে, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সে? কার কাছে গিয়ে সে আশ্রয় চাইবে এখন, যে-আশ্রয় হবে নিরাপদ এবং আপাত স্বস্তির? সোজা পুলিশের কাছে যাবে? নাহ্, ওদের সে সম্পুর্ণ বিশ্বাস করে না। বিশেষ করে হোঁদলকুতকুত পুলিশ একজন আছে, তার সঙ্গে সাইকেল মাহাতর বেশ ভাব! অবশ্য বাইরে থেকে আসা ওই পুলিশআংকেলের কাছে যেতেই পারে, সে দেখেছে ইরিগেশনের বাংলোয় উঠেছে ওই আংকেল! কিন্তু নাহ্, নিজেই বাতিল করে আবার। ইরিগেশনের বাংলোয় গিয়ে শেলটার নিলে সে-কথা চার্চ কিংবা অজ্ঞাতপরিচয় সেই ট্রেসপাসারের কাছে আর অজ্ঞাত থাকবে না। চার্চ থেকে ফাদার তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠাবেন। অন্যদিকে সেই অজ্ঞাত ট্রেসপাসার আবার আক্রমণ কিংবা অপহরণের সুযোগ খুঁজবে এবং এবার যেহেতু আরও সতর্ক থাকবে, সুতরাং দ্বিতীয়বার আর ফাঁকি দিয়ে পালানো সহজ হবে না নুনিয়ার! ব্যর্থতা মানুষকে যা শেখাতে পারে, সফলতা তা নয়। অতএব লোকটা এরপর ফুলপ্রুফ প্ল্যান করেই আসবে।
কিন্তু তাহলে কোথায় যাবে সে? গ্রামে তাদের আত্মীয়স্বজন বিচ্ছিন্নভাবে থাকলেও তারা কেউই তার খবর নেয় না, আর গেলেও তাড়িয়ে দেবেন। নিজেদেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়, ওকে আশ্রয় দেবে কী? তার উপর সাইকেল মাহাত কিংবা অন্য কেউ সামান্য দু-এক বোতল মহুয়ার টাকা দিয়ে দিলেই গড়গড় করে সব বলে দেবে। নাহ্, নুনিয়াকে অন্য কোন জায়গার কথা ভাবতে হবে! ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। হ্যাঁ, এইরকম করা যেতেই পারে। আপাতত আজকের রাতের জন্য এই ব্যবস্থাই সঠিক। ওখানেই সে সবচেয়ে সেফ। সে একটু দাঁড়াল একটি গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে। কাছাকাছি কোথাও বুনো ফুল ফুটেছে। তার গন্ধ ভেসে আসছে। এত মায়াময়, গন্ধস্পর্শভরা পৃথিবীতে থেকেও মানুষ যে কেন এত হিংসা, এত দ্বিষ, এত হানাহানি, এত রক্তপাত পছন্দ করে কে জানে? একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুকের ভিতর থেকে! —চলবে।
কিন্তু তাহলে কোথায় যাবে সে? গ্রামে তাদের আত্মীয়স্বজন বিচ্ছিন্নভাবে থাকলেও তারা কেউই তার খবর নেয় না, আর গেলেও তাড়িয়ে দেবেন। নিজেদেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়, ওকে আশ্রয় দেবে কী? তার উপর সাইকেল মাহাত কিংবা অন্য কেউ সামান্য দু-এক বোতল মহুয়ার টাকা দিয়ে দিলেই গড়গড় করে সব বলে দেবে। নাহ্, নুনিয়াকে অন্য কোন জায়গার কথা ভাবতে হবে! ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। হ্যাঁ, এইরকম করা যেতেই পারে। আপাতত আজকের রাতের জন্য এই ব্যবস্থাই সঠিক। ওখানেই সে সবচেয়ে সেফ। সে একটু দাঁড়াল একটি গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে। কাছাকাছি কোথাও বুনো ফুল ফুটেছে। তার গন্ধ ভেসে আসছে। এত মায়াময়, গন্ধস্পর্শভরা পৃথিবীতে থেকেও মানুষ যে কেন এত হিংসা, এত দ্বিষ, এত হানাহানি, এত রক্তপাত পছন্দ করে কে জানে? একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুকের ভিতর থেকে! —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।