বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

কেবিনের বাইরে থমথমে মুখে বসে ছিল শাক্য। মালাকার, সুদীপ্ত এরাও আছেন। আরও দু’জন পুলিশ রয়েছে কেবিনের বাইরে। কিছুক্ষণ আগে পাভেলের অপারেশন করা হয়েছে। মাথার পিছনে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। অনেকখানি রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় তার অবস্থা অতি সঙ্কটজনক। চার বোতল রক্ত দিতে হয়েছে তাকে। শাক্য নিজের ব্লাডগ্রুপ ও-নেগেটিভ, ফলে সে ইউনিভার্সাল ডোনার। এক্ষেত্রে তার রক্ত দিতে কোনও সমস্যা ছিল না। সে নিজে থেকেই দু-বোতল রক্ত দিয়েছে। বাকিটা চার্চের হাসপাতালের ব্লাড-ব্যাংক থেকে দেওয়া গিয়েছে।

সদরে খবর পাঠানো হয়েছে, পুলিশ সুপার নিজে আসছেন। সঙ্গে মেডিকেল টিম। অবস্থা মোটের উপর একটু ইমপ্রুভ করলেই শাক্যকে প্রথমে সদরের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে কিংবা সরাসরি কলকাতায় শিফট্‌ করা হবে। এর জন্য প্রয়োজনে গ্রিন করিডোর করে নিয়ে যাওয়া হবে তাকে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ফোন করে খবর নিয়েছেন। একেজি ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর নিচ্ছেন। তাঁর নিজেরও একটি দায় বর্তায়। কালাদেও কাণ্ডের সুরাহা করার জন্য মাস দুই-তিন আগে তিনিই তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং পরে পরামর্শ করে ফিল্ড-স্টাডির জন্য পরিচয় গোপন করে পাভেল আসে। শাক্য হালে এসেছে। আসলে তার হাতে একটা বড় কেস এসে পড়েছিল, নাহলে সে হয়তো আরও আগে এসে পৌঁছাত। এখন আফসোস করছে সে মনে মনে, আরও আগে যদি এসে পৌঁছাত তাহলে আততায়ীরা এত বেপরোয়া হয়ে উঠত না।
পাভেলের ঘটনায় শাক্যর সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে যে, কালাদেওর নাম করে এক বা একাধিক সংগঠিত অপরাধী এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পার্শ্ববর্তী রাজ্যের বর্ডার এলাকা হওয়ার জন্য এই অঞ্চল এমনিতেই অপরাধীদের হটস্পট। তবে এতকাল লুকিয়ে-চুরিয়ে হত, বছরখানেক হল কোন অজ্ঞাত কারণে তারা অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তা না হলে এত বেপরোয়া হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। এলাকা দখলের লড়াই হতে পারে, যদিও তাহলে রিসর্টে অনিল-হত্যার বিষয়টি কিছুটা ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়। কিন্তু কালাদেও যে এই সমস্ত ঘটনার পিছনে নেই, সে-ব্যাপারে শাক্য ক্রমশই নিশ্চিত হচ্ছে। এখন সবার আগে একটাই চাওয়া, পাভেলের সেরে ওঠা। আর যাই হয়ে যাক, পাভেলকে কিছুতেই মরে যেতে দেওয়া যাবে না।

কাল থেকে শাক্য খায়নি কিছু, যেখানে উঠেছে, সেখানেও যায়নি। বাকিরা নিজের নিজের কোয়ার্টারে গিয়েছেন, স্নান-খাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার এসেছেন। তাঁরা শাক্যকেও অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু শাক্য কারুর কোন কথা শোনেনি। কাল সন্ধ্যে থেকে আজ এই বিকেল পর্যন্ত সে হসপিটাল চত্বর ছেড়ে এক পা-ও নড়ে নি। তাও কী ভাগ্যে নুনিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে হেলথ্ সেন্টারের ডাক্তার সত্যব্রতও পাকেচক্রে এসে পড়েছিলেন, যার জন্য অতি দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা গিয়েছিল। তা না হলে পাভেলকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সম্ভব ছিল না।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫০: তুমি কি কেবলই ছবি?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৭: যাজ্ঞসেনী স্বয়ংবরা দ্রৌপদী কি শুধুই প্রতিহিংসার বাতাবরণ বিনির্মাণ করেন?

সেদিন নুনিয়াকে পাঠিয়ে শাক্য যখন পাভেলকে জড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, সেই সময় তার মনে কোন ভয় বা আশঙ্কা জাগেনি। আততায়ী হয়ত তখন আড়ালেই ছিল, নজর রাখছিল তাদের উপর, অতর্কিতে পিছন থেকে আক্রমণ করলে সেই সময় শাক্যর সত্যিই হয়ত কিছু করার ছিল না। পাভেলকে কোল থেকে নামিয়ে আতিতায়ীর সঙ্গে যুঝবার আগেই তার নিজের ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারত। কিন্তু এত কিছু তার মাথায় আসেনি। সে তখন প্রার্থনা করছিল, যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেসকিউ-টিম এসে পড়ে। পাভেলকে বাঁচাতেই হবে।

তখন মনে পড়েনি, আশেপাশে তাকিয়েও সে কিছু দেখতে পায়নি, যাতে সন্দেহ করা যায়। এক জায়গায় অবশ্য মাটি খোঁড়া ছিল। জঙ্গলে বুনো শুয়োর আছে, তাদের কীর্তি হতে পারে। আবার এমন হতে পারে, আততায়ী এখানে মাটি খুঁড়ছিল দেখে পাভেল তাকে চার্জ করে আর তারই পরিণাম এই আক্রমণ। কিন্তু গর্ত পরীক্ষা করে দেখা তখন সম্ভবপর ছিল না। ফলে শাক্য অসহায় বোধ করছিল। দ্রুত আলো নিভে আসছে। এই জঙ্গলে বুনো শুয়োর আছে, সাপখোপ আছে। নুনিয়ার দেওয়া ডালটা পাশে পড়ে আছে, কিন্তু সত্যিই যদি তেমন কেউ আসে, তাহলে এই ডাল এমন পরিস্থিতিতে কতটা ব্যবহার করা সম্ভব হবে, তা সে জানে না।
হসপিটালের বাইরে রাখা কাঠের সেকেলে বেঞ্চে বসে বসে সে ভাবছিল নুনিয়ার কথা। নুনিয়া ভাগ্যিস এই সমস্ত জঙ্গলকে হাতের তালুর মতো চেনে। তা না হলে এত দ্রুত জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সে জীবনের কাছে পৌঁছাতে পারত না।

জীবন অবশ্য আগেই কিছু আঁচ করে থানায় খবর পাঠিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছিল। নুনিয়া যখন তাকে খবর দেয়, তার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বড়বাবু, সেকেণ্ড অফিসার সুদীপ্ত টিম নিয়ে এসে পৌঁছায়। সব কথা শুনে তাঁরা আর দেরি করেননি। মালাকার নিজেই আগে চার্চের হসপিটালে ফোন করে তাদের সাহায্য চায়। তাঁরাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অ্যামব্যুলেন্স পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— কেরালি ও নোনা হাতিশুঁড়

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

ইতিমধ্যে সত্যব্রতকে নিয়ে ড্যানিয়েল হরিপদও এসে পৌঁছয়। সত্যব্রত সব কথা শুনে পুলিশি টিমের সঙ্গে জঙ্গলে ঢোকেন। তাঁর গাড়িতে সবসময়ই ফার্স্ট এইড বক্স থাকে। সেটিও স্বভাবতই কাজে এসেছিল সন্দেহ নেই। সমস্ত ঘটনা কাকতালীয় ভাবে অবিশ্বাস্যরকম দ্রুত গতিতে হয়। এ পাভেলের কপাল ছাড়া আর কিছু নয় বলেই শাক্য বিশ্বাস করে। তা না হলে, যেখানে প্রতিটা মুহূর্তই মূল্যবান, সেখানে এত দ্রুত সব ব্যবস্থা হয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল।

নুনিয়াই পথ দেখিয়ে পুলিশ টিমকে জঙ্গলের সেই নির্দিষ্ট জায়গায় কুসুমগাছের কাছে নিয়ে আসে, যেখানে শাক্য পাভেলকে নিয়ে বসে অপেক্ষা করছিল। সত্যব্রত দেরি না করে তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করে দেন। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে আগে ব্যান্ডেজ বাঁধা জরুরি ছিল। স্টেরিলাইজ না করে কিছু করা সম্ভব ছিল না। ক্ষতস্থানে সংক্রমণ হলে আহতকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়বে। যতটা সম্ভব সতর্কতার সঙ্গে সত্যব্রত তাঁর ডাক্তারের দায়িত্ব পালন করেন। ইতিমধ্যে অ্যামব্যুলেন্স পৌঁছে গিয়েছিল।

ফলে স্ট্রেচারে করে পাভেলকে সন্তর্পণে নিয়ে আসা হয় চার্চের হসপিটালে। মালাকার চেয়েছিলেন প্রথমে হেলথ্ সেন্টারে নিয়ে যেতে। কিন্তু পাভেলের অবস্থা দেখে সত্যব্রতই বারণ করলেন। বললেন, “যা অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে হেলথ্ সেন্টারে নিয়ে গিয়ে লাভ নেই। আপাতত চার্চের হসপিটালই বেস্ট। এখন যে-ধরণের ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন, তার জন্য প্রয়োজনীয় সেট-আপ হেলথ্ সেন্টারে নেই। অতএব…” কথা শেষ করলেন না সত্যব্রত। তবে সকলেই বুঝতে পারছিল তিনি কী বলতে চাইছেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

সুদীপ্ত ইতিমধ্যে চারদিক সার্চ করে দেখছিল। যেখানে মাটি খোঁড়া অবস্থায় ছিল, সেখানটা একজন পুলিশকে ডেকে হাত দিয়ে মাটি সরাতে নির্দেশ দিল সে। তখন দেখা গেল, গর্তটা যথেষ্ট গভীর এবং সেখানে কোন কিছু রাখবার চিহ্ন স্পষ্ট। কোনো বুনো শুয়োর বা অন্য জানোয়ারের পক্ষে এই ভাবে গর্ত করা সম্ভব না। সুদীপ্ত অনুমান করছিল, খুব সম্ভব বাক্স বা ওই ধরণের কিছু এর মধ্যে রাখা ছিল। অন্য কিছুও হতে পারে। কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তাহলে কী আঘাত করার পর অফিসার যখন পড়ে যান, তার পরেই সরানো হয়েছে? না-কি আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর তখনই পাওয়া সম্ভব, যখন পাভেল সুস্থ হয়ে উঠবে।

সন্ধে নেমে আসছিল। ফলে হসপিটালের অ্যাম্বুল্যান্স পাভেলকে নিয়ে যাওয়ার পরে আর কেউ থাকেনি সেখানে। পরের দিন সকালে আসা ছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না। সেক্ষেত্রে হয়তো কিছু এভিডেন্স হারিয়েও যেতে পারে। একটাই ভয়, আততায়ী যদি আবার ফিরে আসে এবং সবরকম এভিডেন্স নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু এই জঙ্গলের মধ্যে পুলিশ পোস্টিং করার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।

শাক্য অ্যামব্যুলেন্সের সঙ্গে চলে গিয়েছিল। পাভেলকে সে ছাড়তে চায়নি একেবারেই। তখন এই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো অবস্থা তার ছিল না। ফলে সে তাকিয়ে দেখলেও কিছু বলেনি। নুনিয়া একপাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে সব দেখছিল। কিন্তু হসপিটালের গাড়ি আসায় সে চঞ্চল-উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। হসপিটালের লোকজন সকলেই তাকে চেনে। আর তাকে এখানে দেখার অর্থ, ফাদারের কাছে রিপোর্ট পৌঁছে যাওয়া। সে এই সন্ধ্যের সময় হস্টেলে না ফিরে জঙ্গলে কী করছিল, এর জবাবদিহি তাকে করতেই হবে তখন। এমনিতেও তাকে নিয়ে ফাদার হতাশ। যে-কোনও দিন তাকে চার্চের হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে, তা সে অনুমান করতে পারে ভালো করেই।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

কিন্তু এখন আপাতত তার প্রয়োজন, নিজেকে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া এবং তা চুপিসাড়ে। তার দিকে কেউই তখন লক্ষ্য রাখছিল না। ভালো পুলিশ অবশ্য এক-দুবার তার দিকে তাকিয়ে দেখেছে। কিন্তু সে দেখা যেন বোবা-দৃষ্টি। সত্যব্রত তার দিকে তাকিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এখন ব্যস্ত আহত ব্যক্তিকে নিয়ে। ফলে নুনিয়া আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে গেল। এখন যত তাড়াতাড়ি তাকে হোস্টেলে পৌঁছাতে হবে। গেট বন্ধ থাকা-না-থাকা তার কাছে কোন ব্যাপার নয়। মেইন গেট দিয়ে সে আর ক’দিনই বা ঢোকে?

হসপিটালে আসার পর শাক্য আর নুনিয়াকে দেখে নি। হয়তো তার কোন অসুবিধা আছে এখানে আসার। কিন্তু যদি আসে, তাহলে অন্তত তাকে ধন্যবাদ দেবে। সে না থাকলে পাভেলের এত দ্রুত অপারেশন হওয়া সম্ভব হত না। এখন প্রতীক্ষা। পাভেলের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত সে কিছুতেই নড়বে না এখান থেকে। তারপর সে দেখে নেবে, সেই আড়ালে থাকা আততায়ীকে। খুঁজে পেতেই হবে তাকে। আড়াল থেকে যে বা যারা এই ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে, তাদের ছেড়ে দেবে না সে। যে-ভাবেই হোক এই খেলা বন্ধ করার সময় এসে গেছে। আড়ালে থাকা আততায়ীকেও বুঝে নিতে হবে যে, যা-খুশি তাই করার দিন শেষ। এটা শাক্যর চ্যালেঞ্জ! —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content