বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

আর্য ফিরে এসেছে—এই কথাটা চাউর হতে দেরি হয়নি রিসর্টে। রিসেপশনিস্ট তাকে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছে, রিসর্টের অন্যান্য কর্মচারীরাও তাকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়েছে। বেলার দিকে না-হয়ে আর্য যদি রাতের বেলা কিংবা সন্ধ্যের পরও ফিরে আসত, তাহলে একেবারে হুলুস্থুল পড়ে যেত। কালাদেওর কাণ্ডকারখানার পরে সকলেই তাকে তখন ভূত বলে ভাবত। কারণ, ইতিমধ্যেই এই কথাটা কীভাবে যেন ছড়িয়ে পড়েছিল যে, দিন কয়েক আগে রাস্তায় যে আধখাওয়া লাশটি পাওয়া গিয়েছিল, সেটা আর্যর। বেশ কয়েকদিন সে না-ফেরায় সকলে কথাটাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিল। ফলে তার ফিরে আসাটা সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত এবং অভাবনীয়।

রিসর্টের কর্মচারীরা সকলেই একবার এসে উঁকি মেরে দেখে গিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সে আর অনিল একই রুম শেয়ার করত। কিন্তু পুলিশ সেই রুমটা বর্তমানে সিল করে দিয়ে গিয়েছে, ফলে কাপাডিয়াকে তার জন্য আর-একটি পৃথক রুমের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। যদিও পিশাচপাহাড় রিসর্ট এখন ফাঁকাই প্রায়। তারা আর ওই নতুন কাপল ছাড়া বাকিদের বুকিং ক্যানসেল করা হয়েছে। কাপাডিয়া সকলকে বলে দিয়েছেন, মালিকের যা মতিগতি বুঝতে পারলাম, এই সমস্ত ঝুটঝামেলার জন্য তিনি হয়তো আর এই রিসর্ট রাখবেন না। বেচে দেবেন জমি-সহ। নতুন মালিক কী করবেন, কাকে রাখবেন আর কাকে ফেলবেন, তা তিনিই জানেন। ফলে সব্বাইকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, এখন থেকেই অন্যত্র কাজের সন্ধান করতে হবে। পেলে চলে যাওয়াই শ্রেয়।
সিঙ্গলরুম পেয়ে আর্য যেমন খুশি, অনিলের মৃত্যু তাকে তেমনই ব্যথিত করেছে। অনিল অন্যরকম ছিল। এখানে তার আসাই হত না, যদি অনিল না-থাকত। আগের সম্পর্ক যা-ছিল ছিল, তার উপর একসঙ্গে দু-দিন এক রুমে কাটিয়ে আলাদা একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এমন অনেক কথা অনিল শেয়ার করেছে, যা আগে সে-কখনও করেনি। জানতও না আর্য। সে-সব কথা সকলকে বলার নয়। নেশার ঘোরে না থাকলে অনিল সে-সব কথা তাকেও বলত বলে মনে করে না আর্য। কিন্তু কথাগুলি খুব জরুরি। এই কথাগুলি বেচেও সে বড়লোক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সে অপেক্ষায় বিশ্বাসী। ধৈর্য্যং রহু ধৈর্য্যং রাই… !

তাকে দেখে অরণ্য ও অঞ্জনদার প্রতিক্রিয়া ছিল দেখবার মতো। অঞ্জনদাই খুলেছিল দরজা, আর খুলেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল।
“তু…তু…তুমি?”
আর্য ম্লান হেসেছিল। “হ্যাঁ আমি, ফিরে এলাম অঞ্জনদা!”
“ফিরে এলাম মানে? কোথায় ছিলে এই ক’দিন?” দরজায় দাঁড়িয়েই তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল অঞ্জন।
“কে এসেছে অঞ্জন?” অরণ্য ভিতর থেকে জিজ্ঞাসা করেছিল।
তখনই দরজা থেকে সরে গিয়ে অরণ্যকে দেখবার সুযোগ করে দিয়েছিল অঞ্জন।
“তুই?” তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল অরণ্য।
“হ্যাঁ, আমি!” ক্লান্ত-বিধ্বস্ত আর্য উত্তর দিল। “ভিতরে ঢুকতে দেবে না?”
ওরা হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। আর্য ভিতরে ঢুকে ধপ করে বসে পড়েছিল। তার চোখ বসে গেছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
“কোথায় ছিলি তুই? ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না কেন?” অরণ্য প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।
“একটু জল!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৫: সত্যব্রত সকাশে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৩: দুই মহর্ষির দ্বন্দ্বে কি ‘ইতি ও নেতি’র বিরোধেরই প্রতিফলন?

অঞ্জন তাড়াতাড়ি জলের বোতল এগিয়ে দিল। ঢকঢক করে জলটা পুরো শেষ করে দিল আর্য। ওর খিদে পেয়েছিল। কিন্তু তার আগেও তাকে ফ্রেশ হতে হবে। আর ঘুমাতে হবে। কিন্তু লবিতেই সে শুনে এসেছে, এখানে কী ঘটে গিয়েছে এবং তা-ও ঘটেছে আজকে ভোরে। সে আশঙ্কা করেছিল আগেই যে এই রকম কিছু একটা ঘটতে পারে। অঞ্জনের কথাগুলি অঞ্জন যদি আর-কাউকে নেশার ঘোরে বলে ফেলে, তাহলে সমস্যা বাড়বে এটা নিয়ে সে নিঃসন্দেহ ছিল। হয়তো সে-জন্যই প্রাণ দিতে হল তাকে। সবাই কালাদেও বলছে, কিন্তু তার মনে হচ্ছে আততায়ী আর যেই হোক কালাদেও নয়। অথচ সমস্যা হচ্ছে, অঞ্জন নেশার ঘোরে অনেক কথা বললেও নাম বলেনি। তার সূত্রগুলি এক জায়গায় করলে দু’-একটি নাম মনে ভেসে ওঠে। হয়তো তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আততায়ী! কিংবা… !

আচ্ছা, অঞ্জন কি মৃত্যুর আগে বলে দিয়েছিল যে, সে অনেক কথা তাকে বলে গেছে। তা হলে তারও বিপদ। কিন্তু, আর্য ভাবল, নেশার ঘোরে অনিল যে অনেক কথা তাকে বলে ফেলেছে, সে-কথা কি সে মনে রেখেছে ? মনে না-রাখাটাই স্বাভাবিক।
অরণ্য জিজ্ঞাসা করল, “রিসর্টে ঢুকতে কেউ দেখেছে?”
“সবাই দেখেছে। রিসেপশনিস্ট প্রশ্ন করলেন, তারপর কাপাডিয়া এলেন, কর্মচারীরাও এসে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে গিয়েছে। তোমরা যে ভেবেছিলে আমি মরে গেছি, আজ না-কি আমার লাশ সনাক্ত করার জন্য তোমাদের মর্গে যাওয়ার কথা ছি-সে-কথাও কাপাডিয়া বলেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, অনিল যে আর আমাদের মধ্যে নেই, সেই মর্মান্তিক কথাটাও বলেছেন। আমি ভাবতে পারছি না কিছু। মাত্র দু-চারদিন, তার মধ্যেই এত কিছু ঘটে গেল?”
“সে-কথা তো আমরা তোমাকেও বলতে পারি। অঞ্জনের বাইক নিয়ে তুমি সেই যে স্কুপ-নিউজ না-কি ফ্রিল্যান্সিং করতে গেলে, আর তো কোন পাত্তাই নেই তোমার!”
অঞ্জন বলল, “তার আগে বল, আমার বাইক ঠিকভাবে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছ তো?”
“না অঞ্জনদা!” মাথা নীচু করল আর্য, “সেটাই খুব লজ্জাজনক ব্যাপার! তোমার বাইকটা চুরি গিয়েছে! আমি লোকাল থানায় ডায়েরি করেছি, কিন্তু তারা কতদূর কী করতে পারবে, আমি জানি না!”
“ডায়েরি করতে যে সামান্য ইনফরমেশনটুকু দিতে হয়, সেটা তুমি পেলে কোথায় ?” অঞ্জন রাগত ভাবেই জিজ্ঞাসা করল। আর্যকে সে বাইকটা দিতেই চায়নি। কিন্তু উন্মেষা এমন করল। আর ওকে না করতে পারে না সে। এটাই সমস্যা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়

“আমি জেনারেল ডায়েরি করেছি। তোমার বাইকের নাম্বারটা মুখস্থ ছিল। মানে মুখস্থ করে নিয়েছিলাম অঞ্জনদা। আসলে আমি ওখানে রাতে যেখানে স্টে করেছিলাম, সেখানেই লক করে রাখা ছিল। কিন্তু সেই অবস্থাতেই যে চুরি হয়ে যাবে, আমি ভাবিনি!” মাথা নীচু করেই জবাব দিল আর্য।
“তুমি ছিলে কোথায়?” অরণ্য জিজ্ঞাসা করল।
“ঈশ্বরীপ্রসাদ বলে একজনের বাড়িতে। ওর বাবা স্থানীয় একটি মন্দিরের পূজারি। ঈশ্বরীপ্রসাদও বাবার ব্যবসায় নেমে পড়েছে। এ-অঞ্চলে ব্রাহ্মণদের বাস কম, আর ঈশ্বরী খাঁটি বিহারী ব্রাহ্মণ। ফলে তার চাদিদা গ্রামাঞ্চলে কম নয়!”
“কিসের মন্দির?” অরণ্য জিজ্ঞাসা করল।
“কালাদেওর!”
“হোয়াট দ্য হেল! আমার বাইক হারিয়ে এসেছ, আর এখন কালাদেও-টেওর মতো রাবিশ সব বিষয় নিয়ে গল্প করতে বসেছ? উন্মেষার কথা শুনে তোমায় বাইক না-দিকেই হত! কিন্তু সে তো শুনবে না। তুমি না-কি ভবিষ্যতের একজন প্রতিভাবান কবি-সাংবাদিক। মেয়েদের এই হাতিঘোড়া রাজাউজির মার্কা কথাবার্তা শুনলেই মাথা গরম হয়ে যায় আমার। এত লাখ টাকার বাইক! কী মরতে যে ওই বাইক নিয়ে এই ট্যুরে আসার কথা ভেবেছিলাম কে জানে। পুরো টাকাটা আমার লশ হয়ে গেল!”
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

অরণ্য বলল, “অঞ্জন, পুলিশ তো বলেছে, পুরানা মোকামের জঙ্গল না-কী যেন, তার কাছে একটা দামি বাইক উদ্ধার করেছে। আমাদের তো সেটা দেখতে যাওয়ার কথাও ছিল। যদিও তাতে পাশের রাজ্যের নাম্বারপ্লেট বসানো ছিল, কিন্তু তাদের অনুমান, সেটা পরে করা হয়েছে। নকল। বাইকটা পাশের রাজ্যে নিয়ে গিয়ে সামান্য ভোল বদলে বেচে দেওয়ার মতলবে ছিল চোরেরা। কোন কারণে তা আর হয় নি। কিছু একটার জন্য ভয় পেয়ে তারা জঙ্গলের ধারে রাস্তার একেবারে পাশেই সেটা ফেলে পালিয়েছে। যদি দেখা যায়, সেটা তোমার বাইক, তাহলে সামান্য পুলিশি ঝামেলার পর সেটা পেতে কতক্ষণ?”
“কেস কীভাবে চলে তুমি জানো? তা-ও আবার একটা-আধটা নয়, তিন-তিনটে মার্ডার কেস। তার মাঝখানে একটা চোরাই বাইক এসে পড়লেও তার গতি তোমাদের ভাষায় ‘মায়ের ভোগে”! ও-বাইক যখন উদ্ধার হবে, তখন আর চালানোর অবস্থায় থাকবে না! হোয়াট দ্য হেল য্যু আর!” শেষের কথাটা আর্যকে বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল অঞ্জন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

“ওর কথায় কিছু মনে করিস না। আসলে অত দামি বাইক, মাথা খারাপ তো হবেই !” অরণ্য সান্ত্বনা দিল।
আর্য বলল, “নাহ্, অঞ্জনদার কথায় কিছু মনে করিনি। ওই বাইকটা আমার হলে আর কেউ হারিয়ে ফেললে আমি ওর চেয়ে বেশি রিঅ্যাক্ট করতাম। আমার খারাপ লাগছে। এই ক’দিন আমি কীভাবে ফিরে আসব, কীভাবে মুখ দেখাব সেই কথা ভেবেই নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু না-এসেই বা কোথায় যাব? ফিরতে তো হলই সেই। মুখোমুখি হতে হল সেই!”
“তুই তো একটা ফোন করবি? ফোনটা স্যুইচড্ অফ বলছিল!”
“ফোনটাও তো চুরি হয়ে গিয়েছে?”
“মানে?” অবাক গলায় বলে উঠল অরণ্য, “তার মানে তুই বলতে চাস যে, কেবল তুই ছাড়া বাকি সব চুরি হয়ে গিয়েছে?”
“আমার মাথার কাছে ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাটির বাড়ি। জানালা খোলা ছিল। ওখানে কোন ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ফলে জানালা না-খুলে রেখে শোওয়াও মুশকিল। যারা বাইক চুরি করতে এসেছিল, তারা হয়ত এদিক-ওদিক নজর দেওয়ার সময় মোবাইলটা দেখতে পায় আর তুলে নেয়। আমিও বুঝতে পারিনি। সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরতে হয়েছিল স্কুল নিউজ করার আশায়। বিছানায় শুয়েছি কী মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়েছি। মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। পরের দিন অ্যালার্ম বাজেনি। ঈশ্বরীপ্রসাদ আমাকে ঘুম থেকে না তুললে আমি হয়ত আরও দেরিতে উঠতাম!”
“তুই ওর ফোন থেকে তো একটা ফোন করে জানাতে পারতিস!”
“আমার কারুর নাম্বার মুখস্থ ছিল না!”
“তোর বাড়ির নাম্বারও না? মাসিমাকে জানাসনি কেন?”
মাথা নীচু করল আর্য। ‘আসলে অঞ্জনদার অত দামি বাইকটা হারিয়ে মেজাজ এত খিঁচড়ে ছিল যে, কিচ্ছু ভালো লাগছিল না!”
অরণ্য নিজের ফোন এগিয়ে দিল। বলল, “এক্ষুনি মাসিমাকে ফোন করে জানা যে, তুই ভালো আছিস আর ফিরে এসেছিস!” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content