
সাইকেল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। এতদিন ধরে এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাফল্যের সঙ্গে করে এসে শেষে যে এই পচা শামুকে পা কাটবে, তা সে কখন স্বপ্নেও ভাবেনি। আন্ডারএস্টিমেট করেছিল নুনিয়াকে। কিন্তু হারামজাদী মেয়েটি তার চেয়েও চালাক এবং খতরনাক।
সাইকেলের সামনে এখন বস। ঘরের মধ্যে মৃদু জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। বাইরে ঠান্ডা থাকলেও ঘরের ভিতরটা যথেষ্ট গরম, তার কারণ বস ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলেছিল। এখন অবশ্য আগুন নিভে গেছে, তবে ঘরটা সেই যে গরম হয়েছিল, তেমনই গরম আছে। এই বাংলার কোনও প্রান্তে কেউ ফায়ারপ্লেস ব্যবহার করে না, এক দার্জিলিং ছাড়া, কিন্তু বসের সাহেবি চলন, ফায়ারপ্লেসের ব্যবস্থা যখন আছে, তাহলে কেন তাতে আগুন জ্বালানো হবে না, এই হল তাঁর যুক্তি। অনেকদিন আগে যখন এই বাড়িটা তৈরি হয়, তখন একদল সাহেবসুবো এখানে থাকতেন, তাঁডের মনে এবং হৃদয়ে ছিল ফেলে আসা ঘর-বাড়ির কথা, ঠাণ্ডার কথা; তখন অবশ্য এ-অঞ্চলে নিশ্চয়ই আরও শীত পড়ত। ফলে হয়তো তেমন ঠান্ডা পড়লে ফায়ারপ্লেসের দরকারও পড়ত। কিন্তু এখন ঠান্ডা দিন-দিন কমছে। বিশেষ করে বাংলার এই পশ্চিমাঞ্চলে অন্তত ফায়ারপ্লেস জ্বালবার প্রয়োজন পড়ে না এখন। কিন্তু বসের খেয়াল।
সাইকেলের সামনে এখন বস। ঘরের মধ্যে মৃদু জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। বাইরে ঠান্ডা থাকলেও ঘরের ভিতরটা যথেষ্ট গরম, তার কারণ বস ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলেছিল। এখন অবশ্য আগুন নিভে গেছে, তবে ঘরটা সেই যে গরম হয়েছিল, তেমনই গরম আছে। এই বাংলার কোনও প্রান্তে কেউ ফায়ারপ্লেস ব্যবহার করে না, এক দার্জিলিং ছাড়া, কিন্তু বসের সাহেবি চলন, ফায়ারপ্লেসের ব্যবস্থা যখন আছে, তাহলে কেন তাতে আগুন জ্বালানো হবে না, এই হল তাঁর যুক্তি। অনেকদিন আগে যখন এই বাড়িটা তৈরি হয়, তখন একদল সাহেবসুবো এখানে থাকতেন, তাঁডের মনে এবং হৃদয়ে ছিল ফেলে আসা ঘর-বাড়ির কথা, ঠাণ্ডার কথা; তখন অবশ্য এ-অঞ্চলে নিশ্চয়ই আরও শীত পড়ত। ফলে হয়তো তেমন ঠান্ডা পড়লে ফায়ারপ্লেসের দরকারও পড়ত। কিন্তু এখন ঠান্ডা দিন-দিন কমছে। বিশেষ করে বাংলার এই পশ্চিমাঞ্চলে অন্তত ফায়ারপ্লেস জ্বালবার প্রয়োজন পড়ে না এখন। কিন্তু বসের খেয়াল।
এই খেয়ালের জন্যই এখন মাশুল গুণছে সাইকেল। নুনিয়াকে অবিলম্বে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করতে হবে—এই ছিল নির্দেশ। আপাতত, যে-কোনও একটি অ্যাম্ব্যুলেন্সে তুলে এই রাজ্যের সীমানা পার করলেই কেল্লাফতে। ওপারে ব্যবস্থা আছে, চিন্তার কিছু নেই। ঠিক একইরকম লোগো দেওয়া একইরকম অ্যাম্ব্যুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে ওপারে। গায়ে তার ও-রাজ্যের নম্বরপ্লেট লাগানো। অতএব জিজ্ঞাসা এবং ঝামেলা কম। তাছাড়া পুলিশ বিভাগের মধ্যেই কাজের জন্য খুশি করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। অতএব একবার ও-রাজ্যের সীমানায় ঢুকতে পারার অপেক্ষা। এ-রাজ্যের পুলিশগুলির মধ্যে একটি শ্রেণি রাম বদমাশ ! হাজার, লক্ষ, কোটি দিলেও তারা ইমান বেচবে না। কিন্তু কিছু জন আছে এখনও যারা সাইকেলের মতো খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টের মর্ম বোঝে। তারা যদি দু’হাতে না নিতো, তাহলে সাইকেলকে এ-সব ধান্দা ছেড়ে অন্য ফিকির খুঁজতে হতো। আজকেও সেইরকম ব্যবস্থা করা ছিল। ও-রাজ্যে আগেই খবর চলে যায়, অতএব সতর্কতার সঙ্গে, স্বাভাবিকতার সঙ্গে হাশিল হয়ে যায় কামকাজ! সাইকেলের দায়িত্ব ছিল কেবল নির্বিঘ্নে রাজ্যের সীমানা পার করে দেওয়া। কিন্তু এবারে সে পারল না। এমন নয় যে, বাকি যাদের চালান করার কথা, তাদের সে রওনা করিয়ে দেয়নি। এখানে বেশিক্ষণ গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখলে ভোরের দিকে রাজ্যের সীমানায় পৌঁছাতে পারবে না। চোরাচালান, অপরাধ বেশি বলে এখানে বর্ডারে চেকপোস্ট আছে। গাড়ির মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারা থেকে নাকাচেকিং—সবই হয় সেই চেকপোস্টে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের

আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই?
আগে এ-সবের বালাই ছিল না। কামধান্দাও গড়গড়িয়ে চলত, কিন্তু নতুন সরকার আসার পর কড়াকড়ি বেড়ে গেছে। এমন নয় যে, নতুন সরকার সে-সব বন্ধ করার পক্ষে। তারা এই সমস্ত অসামাজিক কাজকে প্রশ্রয় দিতেই চায়, যতদিন পর্যন্ত তাদের মনোমতো লেভি তারা আদায় করতে পারছে। কিন্তু দিনের দিন তাদের খাঁই বেড়েই চলেছে। পার্টিকে দাও, লোকাল চুনোপুঁটি নেতাদের দাও, পুলিশকে দাও—এত জনকে দিতে দিতে লাভের গুড় যে পিঁপড়েয় খাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আবার কাউকে না-ঠেকিয়েও এই-সমস্ত কাজ নির্বিঘ্নে করা অসম্ভব। ধরা পড়লে যাবজ্জীবন কিংবা ফাঁসিও হতে পারে। কিন্তু ধরা না পড়লে বিন্দাস! এক-একটি বডি থেকে কি কম জিনিস বেচবার মতো পাওয়া যায়। আর সমস্তই সতেজ, অল্পবয়স্ক, জীবিত বডি। হাসপাতালের নির্দিষ্ট রিপোর্ট ছাড়া অ্যাম্ব্যুলেন্সে পেশেন্ট তোলা হয় না। অনেকদিক দেখতে হয়, ভাবতে হয়।
প্রথমত, পেশেন্ট খাতায়-কলমে গুরুতর অসুস্থ থাকলেও আসলে তাকে সুস্থ এবং বিপদন্মুক্ত হতে হয় ; তা না-হলে বডিপার্টস-এর দাম পাওয়া যায় না ভালো। ও-দিকের হাসপাতালে যেদিন অপারেশন থাকে, তার আগের দিন এখান থেকে একজন-না-একজনকে পাঠাতেই হয়। আর পরপর অনেকগুলি অপারেশন থাকলে সেই মতো একাধিক জনকে পাঠানো হয় রাতের অন্ধকারে। সকলেই যাদের ব্যাপারে জানে, ক্রিটিক্যাল কেস, বাঁচবে কী মরবে, তার কোনও ঠিক নেই। অতএব তারা না-ফিরে এলেও কেউ তাদের কথা জিজ্ঞাসা করে না।
প্রথমত, পেশেন্ট খাতায়-কলমে গুরুতর অসুস্থ থাকলেও আসলে তাকে সুস্থ এবং বিপদন্মুক্ত হতে হয় ; তা না-হলে বডিপার্টস-এর দাম পাওয়া যায় না ভালো। ও-দিকের হাসপাতালে যেদিন অপারেশন থাকে, তার আগের দিন এখান থেকে একজন-না-একজনকে পাঠাতেই হয়। আর পরপর অনেকগুলি অপারেশন থাকলে সেই মতো একাধিক জনকে পাঠানো হয় রাতের অন্ধকারে। সকলেই যাদের ব্যাপারে জানে, ক্রিটিক্যাল কেস, বাঁচবে কী মরবে, তার কোনও ঠিক নেই। অতএব তারা না-ফিরে এলেও কেউ তাদের কথা জিজ্ঞাসা করে না।
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা/৫
এদিকে সকলে যখন অন্যরকম ভাবছে, পাঠানো পেশেন্টস্রা তখন কেউ শুয়ে আছে গোপন কেবিনে, কেউ শুয়ে আছে আর একটি অপারেশন টেবিলে, যেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের একটি দল জীবিত পেশেন্টকে ইথারাইজড করে তার ফুসফুস, কিডনি, হার্টস, চোখ ইত্যাদি এবং অবশেষে তার ত্বক সংগ্রহ করছেন অন্যের দেহে প্রতিস্থাপনের জন্য। সেইসব দেহ অবশ্য গরীবগুর্বো মানুষের দেহ নয়; সাহেবসুবো কিংবা কোন শেখ বা আমীর মানুষের, যাঁদের বাঁচার খুব শখ। কেউ হয়তো শেষ যৌবনে বিবাহ করলেন, কেউ হয়তো বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন বলে হার্ট বদলাতে চান—নানা জনের হাজার এক বায়নাক্কা। তাদের বায়নাক্কা মেটানোর জন্য যত টাকা লাগে তারা দিতে ইচ্ছুক। সাইকেলরাও নিতে ইচ্ছুক। তা-না-হলে এই এতবড় বিজিনেস প্রোপোজাল তারা লুফে নেয়? আজকাল একটা হার্ট, কিংবা একটি বা দু’টি কিডনি বেচতে পারলে লোকে আমীর-ওমরাহ্ বনে যাচ্ছে, আর এখানে তো সতেজ বডির কোন অভাব নেই, আসতেই আছে, আর এরাও বেচতেই আছে। সারা দেশে অনেকগুলি ব্রাঞ্চ আছে, সেখানে আছে হাসপাতাল।
মূলত আদিবাসী কিংবা দরিদ্রশ্রেণির বসবাস যেখানে বেশি, অথচ তাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা সম্পর্কে সরকার উদাসীন, সেখানেই রয়েছে এক-একেকটা হাসপাতাল। আছে অনাথআশ্রম। আর সেইসমস্ত আশ্রম, হাসপাতাল থেকে দরকার মতো ব্লাডগ্রুপ ইত্যাদি মিলিয়ে চলে আসে মেইন ব্রাঞ্চে। যদিও সব হাসপাতালেই এই জাতীয় অপারেশনের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু খুব ইমারজেন্সি না হলে মেইন ব্রাঞ্চেই করা হয় এ-জাতীয় অপারেশন। সেই মর্মেই গ্রহীতার সঙ্গে ডিল ফাইনাল করা হয়। আজ নেই-নেই করে পাঁচ বছর এই কাজে বসের সহায়ক হিসেবে সাইকেল কাজ করছে, কিন্তু এত বড় ব্লাণ্ডার কখন করেনি। তার পাঠানো লোকের হাত ফস্কে চিড়িয়া পালিয়ে গেল, এই ব্যাপারটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই।
মূলত আদিবাসী কিংবা দরিদ্রশ্রেণির বসবাস যেখানে বেশি, অথচ তাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা সম্পর্কে সরকার উদাসীন, সেখানেই রয়েছে এক-একেকটা হাসপাতাল। আছে অনাথআশ্রম। আর সেইসমস্ত আশ্রম, হাসপাতাল থেকে দরকার মতো ব্লাডগ্রুপ ইত্যাদি মিলিয়ে চলে আসে মেইন ব্রাঞ্চে। যদিও সব হাসপাতালেই এই জাতীয় অপারেশনের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু খুব ইমারজেন্সি না হলে মেইন ব্রাঞ্চেই করা হয় এ-জাতীয় অপারেশন। সেই মর্মেই গ্রহীতার সঙ্গে ডিল ফাইনাল করা হয়। আজ নেই-নেই করে পাঁচ বছর এই কাজে বসের সহায়ক হিসেবে সাইকেল কাজ করছে, কিন্তু এত বড় ব্লাণ্ডার কখন করেনি। তার পাঠানো লোকের হাত ফস্কে চিড়িয়া পালিয়ে গেল, এই ব্যাপারটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৬: এক সন্ধ্যায় মা সারদার বলা ভূতের গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’
পারছে না বস-ও। হিমশীতল গলায় তার দিকে ক্রুর চক্ষু হেনে বলেছে, “তাহলে কচ্ছপের কাছে খরগোশ আবার হেরে গেল?”
খরগোশ? কচ্ছপ? কী বলছে কী বস এ-সব? মাথাটা গেছে না-কি নুনিয়াকে হারিয়ে? বেকুবের মতো সাইকেল মাথা চুলকে জজ্ঞাসা করে, “আইজ্ঞা? কী বলছেন ছ্যার? খরগুশ কুথা দেখলেন?”
“আমার সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছে!” ঠান্ডা গলায় বস বলেন, “নিজেকে খুব চটপটে, চালাক-চতুর বলে তোমার অহংকার ছিল না সাইকেল? একজন অল্পবয়সী বিচ্ছু মেয়ের কাছে তাহলে হেরেই গেলে সেই খরগোষ আর কচ্ছপের লড়াইয়ের গল্পের মতো?”
“কোন্ গল্প ছ্যার?” বেকুবের মতো আবারও জিজ্ঞাসা করে সাইকেল।
“ও হো! তুমি তো আবার প্রাইমারি ফেল। তোমার বুদ্ধি বোধহয় ঈশপ্স ফেবল অবধি পৌঁছয়নি!” বসের গলায় ব্যঙ্গের সুর।
মাথা নিচু করে থাকে সাইকেল। এইসময় কথার পিঠে কিছু কথা বলতে গেলেই বিপদ।
বস বললেন, “যাই হোক, পরে শুনো সে গল্প। আপাতত তোমার কাজ হল আজ রাতের মধ্যেই নুনিয়াকে খুঁজে বের করা। নাহলে কাল কী হবে বুঝতেই পারছ?”
সাইকেলের বুকের মধ্যে ঠান্ডা রক্তস্রোত বয়ে যায় যেন। সে মিনমিন করে বলল, “আপনি না বললেও আমি খুঁজতাম ছ্যার। কিন্তু নেই-নেই করে পিশাচপাহাড়ে কম মানুষ বাস কর্যেি না। আজ রাতের মধ্যেই নুনিয়াকে কীভাবে খোঁজা সম্ভব?”
“বুদ্ধি থাকলে সম্ভব সবই। সবার বাড়িতে তুমি খুঁজবে কেন? নুনিয়া কি সবার বাড়িতে যেত কিংবা সবার সঙ্গেই তার সুখ্যাতি ছিল? আগে চৌহদ্দিটা ভালো করে খুঁজে এসেছ?”
“আজ্ঞে সমস্তই ছুঁজেছি। হাসপাতাল তন্ন-তন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু সে যেন বিলকুল উবে গিয়েছে!”
“কেউ তো ওইভাবে উবে যায় না, নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধা হয়েছে কিংবা আর কেউ…”
“আর কেউ আমাদের রাস্তার কাঁটা হয়্যে লাই ছার! না-হলে এতদিনে সে আমাদের ছেড়ে কথা কইত না!”
“সকলেই সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করে সাইকেল। তুমি-আমি সকলেই। যাই হোক, নুনিয়াকে খুঁজে বার করার জন্য সব্বার বাড়ির মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারতে হবে না। আগে খোঁজ নাও নুনিয়া কাদের কাদের বাড়িতে বেশি যাতায়াত করত। কাকেই বা পছন্দ করত বেশি। তারপর সেই-সেই বাড়িগুলিকে টার্গেট করলেই আমার মন বলছে নুনিয়া ধরা পড়বে।”
“সে নুনিয়ার কম বাড়ি যাতায়াত আছে না-কি? কিন্তু তারা সবাই এত রাতে নুনিয়া উপস্থিত হলেই দরজা খুলে আশ্রয় দেবে এমন ভাববেন না ছ্যার!”
“তাহলে তো আরও সহজ হয়ে গেল ব্যাপারটা! যারা-যারা এত রাতে নুনিয়া উপস্থিত হলে আশ্রয় দিতে পারে, তাদের লিস্ট বানাও। আরও ছোট হয়ে যাবে লিস্ট। দেখো নুনিয়ার পক্ষে রাতারাতি অন্য কোথাও চলে যাওয়া সম্ভব নয়। হয় সে জঙ্গলেই কোথাও লুকিয়ে আছে, নয়তো কারুর শেলটারে! ওকে খুঁজে পাওয়াটা এখন আগের চেয়ে বেশি জরুরি! ও যদি পুলিশের কাছে পৌঁছে যায় এবং বলে যে, ওর পিছনে ফেউ লেগেছে, তাহলে কিন্তু আমাদেরই বিপদ। আমি ভাবতে পারছি না তুমি সাইকেল মাহাতো, কীভাবে এত ক্যালাস একটা কাজ করতে পারো?”
“আইজ্ঞা ছ্যার, আমি বুঝতে পারিনি, শালী এত শয়তান কা বাচ্চা আছে!”
“অন্যকেও স্বীকার করতে শেখো সাইকেল, অন্যকেও একটু সম্মান দিতে শেখো। সবসময় ভেবে যেও না, তুমি সকলের সেরা, ফলে তুমিই প্রতিবার জিতবে। হারটাও দরকার, তাতে জিতের খিদে তৈরি হয়। যাই হোক, তোমার মাথার উপর দিয়ে যে যাচ্ছে কথাগুলি, তা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। অতএব চুপ করে যাওয়াই ভালো। এখন যাও, যেমনটা বললাম, তেমনভাবে কাজে লেগে পড়ো! দেখো, এবার যেন ভুল না হয়! তাহলে কিন্তু…” কথা শেষ করলেন না বস। কিন্তু সাইকেল বুঝে গিয়েছে তাতেই, কী বলতে চেয়েছেন বস।
খরগোশ? কচ্ছপ? কী বলছে কী বস এ-সব? মাথাটা গেছে না-কি নুনিয়াকে হারিয়ে? বেকুবের মতো সাইকেল মাথা চুলকে জজ্ঞাসা করে, “আইজ্ঞা? কী বলছেন ছ্যার? খরগুশ কুথা দেখলেন?”
“আমার সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছে!” ঠান্ডা গলায় বস বলেন, “নিজেকে খুব চটপটে, চালাক-চতুর বলে তোমার অহংকার ছিল না সাইকেল? একজন অল্পবয়সী বিচ্ছু মেয়ের কাছে তাহলে হেরেই গেলে সেই খরগোষ আর কচ্ছপের লড়াইয়ের গল্পের মতো?”
“কোন্ গল্প ছ্যার?” বেকুবের মতো আবারও জিজ্ঞাসা করে সাইকেল।
“ও হো! তুমি তো আবার প্রাইমারি ফেল। তোমার বুদ্ধি বোধহয় ঈশপ্স ফেবল অবধি পৌঁছয়নি!” বসের গলায় ব্যঙ্গের সুর।
মাথা নিচু করে থাকে সাইকেল। এইসময় কথার পিঠে কিছু কথা বলতে গেলেই বিপদ।
বস বললেন, “যাই হোক, পরে শুনো সে গল্প। আপাতত তোমার কাজ হল আজ রাতের মধ্যেই নুনিয়াকে খুঁজে বের করা। নাহলে কাল কী হবে বুঝতেই পারছ?”
সাইকেলের বুকের মধ্যে ঠান্ডা রক্তস্রোত বয়ে যায় যেন। সে মিনমিন করে বলল, “আপনি না বললেও আমি খুঁজতাম ছ্যার। কিন্তু নেই-নেই করে পিশাচপাহাড়ে কম মানুষ বাস কর্যেি না। আজ রাতের মধ্যেই নুনিয়াকে কীভাবে খোঁজা সম্ভব?”
“বুদ্ধি থাকলে সম্ভব সবই। সবার বাড়িতে তুমি খুঁজবে কেন? নুনিয়া কি সবার বাড়িতে যেত কিংবা সবার সঙ্গেই তার সুখ্যাতি ছিল? আগে চৌহদ্দিটা ভালো করে খুঁজে এসেছ?”
“আজ্ঞে সমস্তই ছুঁজেছি। হাসপাতাল তন্ন-তন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু সে যেন বিলকুল উবে গিয়েছে!”
“কেউ তো ওইভাবে উবে যায় না, নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধা হয়েছে কিংবা আর কেউ…”
“আর কেউ আমাদের রাস্তার কাঁটা হয়্যে লাই ছার! না-হলে এতদিনে সে আমাদের ছেড়ে কথা কইত না!”
“সকলেই সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করে সাইকেল। তুমি-আমি সকলেই। যাই হোক, নুনিয়াকে খুঁজে বার করার জন্য সব্বার বাড়ির মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারতে হবে না। আগে খোঁজ নাও নুনিয়া কাদের কাদের বাড়িতে বেশি যাতায়াত করত। কাকেই বা পছন্দ করত বেশি। তারপর সেই-সেই বাড়িগুলিকে টার্গেট করলেই আমার মন বলছে নুনিয়া ধরা পড়বে।”
“সে নুনিয়ার কম বাড়ি যাতায়াত আছে না-কি? কিন্তু তারা সবাই এত রাতে নুনিয়া উপস্থিত হলেই দরজা খুলে আশ্রয় দেবে এমন ভাববেন না ছ্যার!”
“তাহলে তো আরও সহজ হয়ে গেল ব্যাপারটা! যারা-যারা এত রাতে নুনিয়া উপস্থিত হলে আশ্রয় দিতে পারে, তাদের লিস্ট বানাও। আরও ছোট হয়ে যাবে লিস্ট। দেখো নুনিয়ার পক্ষে রাতারাতি অন্য কোথাও চলে যাওয়া সম্ভব নয়। হয় সে জঙ্গলেই কোথাও লুকিয়ে আছে, নয়তো কারুর শেলটারে! ওকে খুঁজে পাওয়াটা এখন আগের চেয়ে বেশি জরুরি! ও যদি পুলিশের কাছে পৌঁছে যায় এবং বলে যে, ওর পিছনে ফেউ লেগেছে, তাহলে কিন্তু আমাদেরই বিপদ। আমি ভাবতে পারছি না তুমি সাইকেল মাহাতো, কীভাবে এত ক্যালাস একটা কাজ করতে পারো?”
“আইজ্ঞা ছ্যার, আমি বুঝতে পারিনি, শালী এত শয়তান কা বাচ্চা আছে!”
“অন্যকেও স্বীকার করতে শেখো সাইকেল, অন্যকেও একটু সম্মান দিতে শেখো। সবসময় ভেবে যেও না, তুমি সকলের সেরা, ফলে তুমিই প্রতিবার জিতবে। হারটাও দরকার, তাতে জিতের খিদে তৈরি হয়। যাই হোক, তোমার মাথার উপর দিয়ে যে যাচ্ছে কথাগুলি, তা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। অতএব চুপ করে যাওয়াই ভালো। এখন যাও, যেমনটা বললাম, তেমনভাবে কাজে লেগে পড়ো! দেখো, এবার যেন ভুল না হয়! তাহলে কিন্তু…” কথা শেষ করলেন না বস। কিন্তু সাইকেল বুঝে গিয়েছে তাতেই, কী বলতে চেয়েছেন বস।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ
সে তাড়াতাড়ি বলল, “এবারেও কোন ভুল ছিল না ছ্যার। আমি দুপুর থেকে ওকে চোখে-চোখে রেখেছিলাম ছ্যার। যদি দেখতাম জঙ্গলে-মঙ্গুলে দাপাইন বেড়াচ্ছে, তাহলে শালীকে ওইখান থেকেই গাপ্ করে দিতাম! কিন্তু আজ সে গেলই না বাইরে। সারাদিন যেন কী ভাবছে, কী চিন্তা করছে, এমন দশা। দমে খচ্চড় মেয়েটো তো! সন্ধ্যের পর যখন মেয়েটো হোস্টেলে ঢুকল, হোস্টেলের দরজা বন্ধ হয়ে গেল তখন ছ্যার আমি নজর উঠাইন্ছি। কিন্তু কী করে যে উ টের পেয়ে গেল, এখনও বুঝতে লারছি!”
“বেশি বুঝে কাজ নেই। যা করবে, তাড়াতাড়ি কর। আমাদের হাতে একটুও সময় নেই! আজ ভোর হওয়ার আগেই ওকে খুঁজে পেতে হবে শুধু নয়, তুলে আনতে হবে। কীভাবে আনবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। তবে নুনিয়াকে মোটেই বলতে যেও না যে তুমি কিংবা আমিই তুলে আনতে যাবতীয় ব্যবস্থাপত্তর করেছিলাম, তাহলে আর কেউ বাঁচবো না!”
“আমি বেশি লেখাপড়া করে পাশ দিই নি ছ্যার সত্যি কথা, কিন্তু একেবারে গণ্ডমূর্খ তো লয়! মেয়েটোকে পেলে একেবারে ধরে আপনার পায়ের উপর ফেলে দেবো ছ্যার। দেখবেন!”
“আচ্ছা, আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে। আর বেশি বড়াই করো না। যাও, খোঁজো!”
চলে যেতে গিয়েও সাইকেল পিছন ফেরে, “ছ্যার, আমার মনে হচ্ছে ও যে-যে জায়গায় যেতে পারে, তার মধ্যে থানা, আমার আত্মীয় মানে বুধনের বাড়ি আর হেলথ্সেন্টারের ডাক্তারবাবু আছেন। আগে ওই জায়গাগুলি খুঁজবো!”
“সে খুঁজতে হলে তুমি জাহান্নামে খোঁজো। আমার পেলেই হল। তা সে ডাক্তারের কাছেই থাক আর যেখানেই থাক!”
“ঠিক আছে ছ্যার! আমি আসি!”
“এসো, কিন্তু দেখো যেন এবারেও কচ্ছপের কাছে নির্বোধ খরগোশ হারে কি-না!” —চলবে।
“বেশি বুঝে কাজ নেই। যা করবে, তাড়াতাড়ি কর। আমাদের হাতে একটুও সময় নেই! আজ ভোর হওয়ার আগেই ওকে খুঁজে পেতে হবে শুধু নয়, তুলে আনতে হবে। কীভাবে আনবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। তবে নুনিয়াকে মোটেই বলতে যেও না যে তুমি কিংবা আমিই তুলে আনতে যাবতীয় ব্যবস্থাপত্তর করেছিলাম, তাহলে আর কেউ বাঁচবো না!”
“আমি বেশি লেখাপড়া করে পাশ দিই নি ছ্যার সত্যি কথা, কিন্তু একেবারে গণ্ডমূর্খ তো লয়! মেয়েটোকে পেলে একেবারে ধরে আপনার পায়ের উপর ফেলে দেবো ছ্যার। দেখবেন!”
“আচ্ছা, আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে। আর বেশি বড়াই করো না। যাও, খোঁজো!”
চলে যেতে গিয়েও সাইকেল পিছন ফেরে, “ছ্যার, আমার মনে হচ্ছে ও যে-যে জায়গায় যেতে পারে, তার মধ্যে থানা, আমার আত্মীয় মানে বুধনের বাড়ি আর হেলথ্সেন্টারের ডাক্তারবাবু আছেন। আগে ওই জায়গাগুলি খুঁজবো!”
“সে খুঁজতে হলে তুমি জাহান্নামে খোঁজো। আমার পেলেই হল। তা সে ডাক্তারের কাছেই থাক আর যেখানেই থাক!”
“ঠিক আছে ছ্যার! আমি আসি!”
“এসো, কিন্তু দেখো যেন এবারেও কচ্ছপের কাছে নির্বোধ খরগোশ হারে কি-না!” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।