বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

 

বাথটাব (পর্ব-১৭, শেষ)

ধৃতিমান একেবারেই নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু তার বারবার মনে হচ্ছিল এত সফল একজন পেশাদার ডাক্তারবাবুর সমস্ত ব্যক্তিগত নথিপত্র এইভাবে কেউ হাতিয়ে নিতে পারে না। এই ডিজিটাল যুগে কেউ আর প্রিন্ট আউট রাখেন না। এখন সকলে ডিজিটাল নথি সংরক্ষণ করেন। ধরে নেওয়া যেতে পারে ডাক্তার সুরজিৎ ব্যানার্জির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সেই নথি নয়তো ল্যাপটপে থাকবে নয়তো থাকবে তার হার্ড ড্রাইভে। নথির হাত বদল হওয়ার সম্ভাবনা একমাত্র ল্যাপটপ অন্য কেউ ব্যবহার করলে কিংবা তা খারাপ হলে। এক্ষেত্রে হতেই পারে যে এত সফল একজন ডাক্তারের পরিবারে ল্যাপটপ নিশ্চয়ই একটা নেই। তাই অন্য কারো সেই একই ল্যাপটপ ব্যবহার করার সম্ভাবনা কম। তাহলে ল্যাপটপ খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাটাই গুরুত্ব পাচ্ছে।
শ্রেয়া গাড়ি নিয়ে অফিস চলে আসার পর একা একা রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে ধৃতিমানের মাথায় এইসব ঘুরছিল। তাই প্রাথমিক প্রশ্নগুলোর পরে এই প্রশ্নটাই তার মাথায় প্রথম এসেছিল। আর এটাই যে লক্ষ্যভেদ করবে সেটা ধৃতিমান আঁচ করতে পারেনি।
এই কথাগুলোর পরেই ডক্টর ব্যানার্জি ভয়ংকরভাবে মুষড়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। ধৃতিমান এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল জলটুকু খেয়ে হঠাৎ যেন মনস্থির করে ডাক্তার ব্যানার্জি বললেন।
—মিস্টার চৌধুরী আমি স্টেটমেন্ট দিতে চাই।
—কিসের স্টেটমেন্ট?
—মার্ডারার’স স্টেটমেন্ট
চমকে উঠল ধৃতিমান। হঠাৎ এই মানসিক বদলের কারণটা কী হতে পারে?
—আপনি কি বলছেন তার মানেটা জানেন?
—আমার বয়স ৬৫ আমি একজন পেশাদার ডাক্তার। আমি যা বলছি ভেবেচিন্তে পরিণতি জেনেই বলছি।
—ডক্টর ব্যানার্জি আমি একজন সত্যানুসন্ধানী হবার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিয়েটিভ কাজের সঙ্গে যুক্ত।সিনেমার চিত্রনাট্য বা মঞ্চনাটক লেখা এবং নির্দেশনার সুবাদে আমি মনস্তত্ত্বটা খুব ভালো না হলেও অল্পস্বল্প বুঝি। আমার কাছে এই ইনফরমেশন পাবার আগে পর্যন্ত আপনার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আপনার কথাবার্তায় কোথাও কৌশিকীকে খুন করার কোনরকম দায় বা আতঙ্ক স্পষ্ট হয়নি। এখনও হচ্ছে না! সমস্যাটা হচ্ছে আমরা সকলে অনেকটা বদলে গিয়েছি। ৫০বছর আগের মত অবিবাহিতের সন্তান হলেআজকাল আমরা খুব একটা চমকে উঠি না। কোনও অসহায় মহিলা এই লজ্জায় আগের মতো আত্মহত্যা করে কলঙ্ক থেকে বাঁচার চেষ্টা করে না। সুতরাং এই কারণে না আপনি কৌশিকীকে খুন করবার ঝুঁকি নেবেন, না কৌশিকী হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করবে। তাহলে এর মধ্যে এমন কেউ আছেন যার এই খুনটা করার পেছনে আপনার এবং কৌশিকী দু’জনের ওপর প্রতিশোধনেবার মোটিফ থাকবে। আমার অনুমান ভুল না হলে আততায়ী একজন পুরুষমানুষ। কমবয়সী। আমরা ইতিমধ্যেকৌশিকীর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেছি, আপনার সঙ্গে ছাড়া আর কোন অ্যাফেয়ারের রেফারেন্স পাইনি।
—আমি এসিপি রণজয় রায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই
—সে আপনি বলতেই পারেন! কিন্তু চেষ্টা করলেও আপনি কাউকে আড়াল করতে পারবেন না!
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৬৪: বাথটাব/১৬

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৭: ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহর্ষি পেলেন চরম দুঃসংবাদ

ধৃতিমান ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সরাসরি ডিসিডিডি ভৈরব চক্রবর্তীকে হোয়াটসঅ্যাপ কল করল। ধৃতিমান তাঁকে বুঝিয়ে বলল সে ঠিক কী সন্দেহ করছে। এও বলল এখন সে রনজয় রায়ের সঙ্গে কোন সংঘাতে যেতে চায় না । যেভাবে এই খুনের প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়েছিল সেভাবেই রণজয়ের সঙ্গে মিলেমিশে একসঙ্গে সে এই তদন্ত শেষ করতে চায়। তখন শ্রেয়া ছুটিতে ছিলেন এখন সে-ও তাঁদের সঙ্গে তদন্তে যোগ দিক।

এসিপি রনজয় রায় একজন সফল পুলিশ অফিসার। ভৈরব চক্রবর্তী হোয়াটসঅ্যাপ কলে সরাসরি রনজয় সঙ্গে কথা বললেন। রণজয় পরিস্থিতিটা দ্বিতীয়বার ভেবে দেখল। এটা সত্যিই যে ধৃতিমান তাদের অতীতে বহু তদন্তে সাহায্য করেছে। এই তদন্তেও সে সাহায্যই করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারলে সেটা গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সাফল্য হবে। কারো একার সাফল্য হিসেবে কোথাও প্রচার হবে না। বরং পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন অফিসার হিসেবে মিডিয়ার সামনে রণজয় থাকবে, ধৃতিমান নয়। রণজয় কথা দিল সে শ্রেয়া ও ধৃতিমান দুজনের সঙ্গেই কো-ওর্ডিনেট করে কাজ করবে।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৬: ‘রাজর্ষি’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটক

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া

এরপর কলকাতা পুলিশের জিপও ভ্যান সহ কাহিনির পাত্র-পাত্রীদের আমরা দেখলাম লাউডাউন স্ট্রিটের ডাঃ সুরজিত ব্যানার্জির বিলাসবহুল কমপ্লেক্সের সুবিশাল ফ্ল্যাটে। এত পুলিশ একসঙ্গে দেখে এই প্রথম ডাঃ সুরজিৎ ব্যানার্জীর ছেলে অঙ্কুশ ব্যানার্জি হতভম্ব হয়ে গেল।ছুটে এসেছেন ডক্টর সুরজিৎ ব্যানার্জির স্ত্রী অদ্রিজা ব্যানার্জি। সঙ্গে পুরুষ ও মহিলা কনস্টেবলদের নির্দেশ দেওয়া হল তাঁদের দুজনকে চেয়ারে বসিয়ে রাখার। শুরু হল তল্লাশি। ফ্ল্যাটের সমস্ত মোবাইল ল্যাপটপ হার্ডড্রাইভ পেনড্রাইভ বাজেয়াপ্ত করা হল। ধৃতিমানের নির্দেশে প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করলেও অঙ্কুশ পাসওয়ার্ড দিয়ে তার নিজের এবং তার বাবার ল্যাপটপ খুলে দিতে বাধ্য হলো। সঙ্গে থাকা আইটি সেলের অফিসার লুকিয়ে রাখা ফোল্ডারের মধ্যে থেকে সমস্ত প্রমাণ উদ্ধার করলেন। মায়ের সামনে জেরার মুখে চেন্নাইতে মেডিকেল ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র সুরজিৎ এবং অদ্রিজা ব্যানার্জির একমাত্র সন্তান অঙ্কুশ স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, যে বাবার এই অস্বাভাবিক অবৈধ সম্পর্ক সে মেনে নিতে পারেনি। তাই অনেক হিসেব করে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ঘুমের ওষুধ ইঞ্জেক্ট করে কৌশিকীর শরীর বাথটবে বসিয়ে দিয়ে নিখুঁতভাবে হাতের শিরা কেটে দেয়। হ্যাঁ ধৃতিমানের প্রতিটি অনুমান সত্যি।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী

প্রথমদিন থেকে এসে নিজের চেহারা লুকিয়ে সে কৌশিকীকে রেইকি করেছে। বাবাকে হোটেলে আসতে সে দেখেছে। গ্যাসবেলুন দিয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা ব্লক করার পরিকল্পনা করেছে। কৌশিকীর ব্যাগ থেকে ক্রেডিট কার্ড নিয়ে এক্সেস কার্ড বদল সে করেছে। সারা ঘরে কোথাও কোনো প্রমাণ ছিল না। শুধু ইনজেকশনের ছোট্ট তুলোর টুকরো তাড়াহুড়ো হয়ে কোথায় পড়েছে সেটা খেয়াল করতে পারেনি। সময় অল্প ছিল তাই সেই তুলোর টুকরো বের করাটা হয়তো ঝুঁকি হয়ে যেতো। আর শুধু কৌশিকীকে খুন করেই সে থামেনি ইউটিউবারকে দিয়ে তার বাবার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল অঙ্কুশ ব্যানার্জি। বাবার ল্যাপটপে ইচ্ছে করে সমস্যা করে দেয় যাতে বাবাকে ল্যাপটপ চালানোর জন্যে হেল্প নিতে হ, আর চেক করে দেখার নাম করে সব ডকুমেন্ট হাতিয়ে নেয়। যাঁরা খুব একটা ওয়াকিবহাল নন তাঁরা ভাবেন মেলে পাসয়ার্ড দেওয়া মানেই নিশ্চিন্ত! ডাক্তার ব্যানার্জি ভাবতেই পারেননি তাঁর সব গোপনতথ্য এভাবে প্রকাশ হয়ে পড়বে। তার বাবাকে যখন পুলিশ নিয়ে যায় তখন অঙ্কুশ নিশ্চিত হয়েছিল বাবা এই খুনের দায় এড়াতে পারবেন নাবা পুলিশ তাঁর হদিশ কিছুতেই পাবে না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৭: পাঞ্চালীকে আশীর্বাদ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন গান্ধারী

হয়ত পেত না কিন্তু ধৃতিমানের সামনে এত কিছুর পরেও অন্ধ পুত্রস্নেহে ছেলে অঙ্কুশকে খুনের দায় থেকে বাঁচাবার জন্যে নিজেকে খুনি প্রমাণের চেষ্টা করতে গিয়েনিজে ধরা পড়ে গেলেন। আর ডাঃ ব্যানার্জি তাঁর ছেলের মতো লম্বা নন।পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল অঙ্কুশ!
এই কেসের পরে মফিজুলের মতোই এসিপি রণজয় রায়ের সঙ্গে সত্যানুসন্ধানী চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে গেল।রণজয় স্বীকার করেছিলেন যে তাঁর অঙ্কুশকে দেখার পর সন্দেহ হয়নি। —চলবে।
 

গুগলি: পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content