বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


না, ইউটিউবার ছেলেটি আর কোনও ক্লু পায়নি। ওর ভালো নাম দেবাশিস কুণ্ডু। ইউটিউবানন্দ নামে কন্টেন্ট বানায়। তাকে বুঝিয়ে বলে আসা হয়েছে, তার কোনও ভয় নেই। কিন্তু আবার এই নিয়ে নতুন কোনও নির্দেশ এলে সে যেন শ্রেয়া বা ধৃতিমানকে জানায়। আর পুলিশের সঙ্গে তাঁর এই যোগাযোগ পুরোপুরি ‘অফ দ্য রেকর্ড’, তাই সে এই বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। ফেরার রাস্তায় একটাই প্রশ্ন ধৃতিমানের মনের মধ্যে খচখচ করছে, শ্রেয়ার দিকে তাকাতে সেও ধৃতিমানের দিকে তাকালো।
—এত বড় স্কুপটা চেপে গেল কেন?
—কিন্তু আরও একটা বড় প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছে? ডাঃ সুরজিৎ ব্যানার্জির এই সব পারসোনাল ডিটেলসের ডিটেইলস কালপ্রিট পেল কী করে?
—আইডিয়া! আপনাকে এখনই অফিসে আসতে হবে।
—গেলাম তারপর!
—ডাঃ ব্যানার্জিকে জেরা করতে হবে!
—কিন্তু কী করে? এসিপি রণজয় রায় আমাকে অ্যালাও করবেন কেন? আর আমি জেরা করলে আপনি করতে পারবেন না কেন?
—ধৃতিমান হায়ার আর্কিতে অফিসে আমি রণজয় রায়ের জুনিয়র!
—আমিই বা কি সিনিয়র শ্রেয়া?
—আপনার স্ট্যাটাসটা অ্যাট পার! এক মিনিট, আপনি এই কেসে কি করে অ্যাসাইন্ড হলেন?
—চক্রবর্তী সাহেব ফোনে জানালেন! আপনি মায়ের চিকিৎসার জন্য চেন্নাইতে ছিলেন।
—রাইট! আমি চেন্নাইতে চক্রবর্তী সাহেব জার্মানিতে। আপনি গেলেন নিউটাউনের হোটেলে, কে আপনার সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করলেন?
—এসিপি রণজয় রায়!
—এক্সেলেন্ট! আপনাকে অপছন্দ করেন তবুও কার ইন্সট্রাকশনে এসিপি রণজয় রায় সেটা করলেন?
—ডিসি ডিডি? …না উনি বিদেশে, টেকনিক্যালি অন লিভ। উনি সেটা করবেন না!
—কারেক্ট! করাবেন! কাকে দিয়ে করাবেন?
—জয়েন্ট সিপি ক্রাইম? নাকি ….কমিশনার?
—জয়েন্ট সিপি ক্রাইম তো স্যারের কাজ দেখছেন! তাই, নাকিটাই সঠিক! তাহলে এবারেরও একই চাল! ঘোড়ার আড়াই পা দিয়েই এই কেসটা প্রথম থেকে এটেন্ড করছেন বলে আপনি একবার প্রাইম সাসপেক্টকে ইন্টারোগেট করলে ভালো হয়! কোনও আনেক্সপ্লোর্ড ক্লু বেরিয়ে আসতে পারে! আচ্ছা এখন হিটলারের দেশে ক’টা বাজে? মাঝরাত নয়তো?
—নানা এখানে দুপুর তিনটে মানে জার্মানিতে সকাল সাড়ে দশটা!
গাড়িতে অফিসে পৌঁছবার আগেই ফোনে ফোনে শ্রেয়া সব ব্যবস্থা সেরে রাখল। চক্রবর্তী সাহেব সিপি সাহেবের কথা বলে ডাঃ সুরজিৎ ব্যানার্জিকে ধৃতিমানের জেরার ব্যবস্থা করে দিলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৯: বালিকাভাব মা সারদার

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে

যে কোনও অফিসের ক্ষেত্রেই যখন অনেক উপরের কর্তাদের দিয়ে কোনও কাজ করিয়ে নেওয়া হয়, তখন নিচের লোকেরা কিছুতেই খুশি হতে পারে না। এক্ষেত্রে তার অন্যথা হল না। ধৃতিমানকে শ্রেয়া অফিসের একটু আগে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে শুনিয়ে বলল—
—সরি মিস্টার চৌধুরী! হাতে একদম সময় নেই। এখুনি আমাকে অফিসে ঢুকতে হবে। আপনি আপনার কাজ সেরে চলে আসুন।
ধৃতিমান বুঝলো শ্রেয়া ইচ্ছে করে একসঙ্গে অফিসে ঢোকাটা অ্যাভয়েড করতে চাইছে। চাইছে যে ধৃতিমান পরে অফিসে ঢুকুক।
—গাড়িটা কি পাঠিয়ে দেব?
ধৃতিমান ইঙ্গিত বুঝে উত্তর দিল—
—না না, একটুখানি রাস্তা আমি চলে যাব।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৭: পাঞ্চালীকে আশীর্বাদ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন গান্ধারী

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৭: ভাগ নুনিয়া, ভাগ

শ্রেয়া অফিসে পা দিয়েই বুঝে গেল লালবাজারের নির্দেশ এসে পৌঁছেছে এবং খুব স্বাভাবিকভাবে তার প্রতিক্রিয়া সুখকর নয়। তাঁর গ্রেফতার করা আসামিকে গোয়েন্দা ধৃতিমান চৌধুরী জেরা করবেন, ব্যাপারটার রণজয় রায়ের মোটেই পছন্দ হয়নি। জয়েন সিপি ক্রাইমের কাছে এসিপি রণজয় রায় যথেষ্ট উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তারপরেও নির্দেশ মানতে হবে, তাই এসিপি সাহেব অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। শ্রেয়া বুঝল, এটাই আদর্শ সময়, যতক্ষণ রণজয় রায় মাথাগরম করে অফিসের বাইরে থাকবেন ততক্ষণে আসল উদ্দেশ্যে ধৃতিমান পৌঁছে যাবে।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৪: ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাগণ সর্বদা সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে গিয়েছেন

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ

ইন্টারোগেশন রুমে ঢুকে ধৃতিমান এতটুকু সময় খরচ না করে ডাঃ সুরজিৎ ব্যানার্জিকে বলল—
—ডাঃ ব্যানার্জি আমি জানি আপনি এই খুনের সঙ্গে জড়িত নন! কিন্তু সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স আপনাকে খুনের সঙ্গে জড়িয়ে দিচ্ছে। কৌশিকীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে আপনার যে সম্মানহানি হয়েছে, সেটা তো হতই! কিন্তু যেখুন আপনি করেননি তাতে জড়িয়ে গিয়ে সারা জীবনসাজা খাটার তো কোনও মানে হয় না।
ডাঃ সুরজিৎ ব্যানার্জি চুপ করে টেবিলে হাত রেখে মাথা নিচু করে বসেছিলেন।
—আপনি বলতেই পারেন যে, আপনি আপনার উকিল ছাড়া আমার সঙ্গে কোনও কথা বলবেন না সেটা একেবারেই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে যে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করব সেগুলো অত্যন্ত গোপনীয়, সেখানে তৃতীয় কোনও ব্যক্তিকে বিশ্বাস করাটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এ বার প্রশ্ন হল যে, আমাকে বিশ্বাস করবেন কেন?

প্রথমত: আমি একজন গোয়েন্দা হিসেবে প্রথম দিন থেকে এই কেসটা দেখছি। আমার কাছে আততায়ীর একটা আবছা চেহারা আছে, যেটা আপনার সঙ্গে মেলে না।

দ্বিতীয়ত: এই খুনটা করতে গেলে যে শারীরিক সক্ষমতা ও দ্রুততা লাগে সেটা আপনার নেই।

তৃতীয়ত: যদি সত্যি সত্যি আপনার খুন করার ইচ্ছে থাকতো তাহলে আপনি কৌশিকীর সঙ্গে কথা বলতে হোটেলরুমে যেতেন না।

চতুর্থত: আপনি খুব সহজে মিফেপ্রিস্টোন আর মিসোপ্রোস্টল কম্বিনেশন দিয়ে মেডিসিন্যাল অ্যাবোরশন করাতে পারতেন। অবাঞ্ছিত প্রেগনেন্সিতে এবরশন জরুরি সেটা বোঝার মতো বয়স বা অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কৌশিকী হয়েছিল।

পঞ্চমত: এ সবের পরেও খুনটা করলে আপনি এত সহজে বাড়ি থেকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতেন না। আসলে কৌশিকীর সঙ্গে আপনার বিদেশ ভ্রমণের সমস্ত খুঁটিনাটি ইউটিউব চ্যানেলে মাধ্যমে সোশ্যালমিডিয়ায় ভাইরাল হবার পর আপনি খুব কোণঠাসা হয়ে গিয়েছেন। সেখান থেকে বেরোনোর জন্য আপনি পুলিশের কাছে সারেন্ডার করেছেন। এখন আপনাকে সাহায্য করায় আমার স্বার্থ কী? একজন পেশাদার হিসেবে আমি ভুল মানুষকে খুনি হিসেবে জেলে ভরে দিয়ে জেনে বুঝে আততায়ীর কাছে হার স্বীকার করতে পারব না। আমি চাই আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করুন!
আরও পড়ুন:

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়

—বলুন কী জানতে চান?
-কৌশিকী কি আপনাকে হোটেল রুমে ওর শরীরে সন্তানসম্ভাবনার কথা জানাবার জন্য ডেকেছিল?
ডাঃ ব্যানার্জি সম্মতি জানালেন।
—আর?
—আমার কাছে অনেক টাকা চেয়েছিল!
—এটা কি এখানে জেরায় বলেছেন?
—না! কেন?
—কারণ এটাও খুনের মোটিফ হতে পারে আপনার বিরুদ্ধে যাবে! আপনি কী বলেছিলেন!
—আমি ওকে ঠকাতে চাইনি, বলেছিলাম প্রেগনেন্সির ব্যাপারটা সামলে নিয়ে উই উইল সেটল! বাট কৌশিকী ওয়াজ…
—বুঝলাম! এ বার একেবারে একটা অন্য প্রসঙ্গ। আপনি ল্যাপটপ ইউজ করেন?
—হ্যাঁ
— ভেরি রিসেন্টলি আপনার ল্যাপটপে প্রবলেম হয়েছিল? অ্যাম আই রাইট?
ডাঃ ব্যানার্জি যেন চমকে উঠলেন। ওর কিছু মনে পড়ে গেল অস্থির হয়ে বছর পঁয়ষট্টির ডাঃ সুরজিৎ ব্যানার্জি বারবার নিজের হাতটা টেবিলে ঠুকতে লাগলেন। —চলবে।

কৌশিকি দত্তগুপ্ত হত্যারহস্য: পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content