শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড।

বিয়ের ঠিক আগে কনরাড তাঁর এক খুড়তুতো ভাইকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি তাঁর বিয়ে সম্পর্কে মনের ভয় এবং সন্দেহের ওপর আলোকপাত করে।” আমি বিয়েকে ভয় পাই না। আমি তো অ্যাডভেঞ্চারাস। এ ছাড়া জেসি খুব সাধারণ দেখতে এবং সাধারণ পরিবারের মেয়ে। ও আমার বেশ প্রিয়। আর বিয়ের পরই আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি। বিয়ে করা আমার বোকামি বা সুখ যাই হোক না কেন, সেটা কেউ জানুক আমি চাই না।”

কনরাড বিয়ের দু’ সপ্তাহ আগে একটি জাহাজের নাবিকের পদে কাজ পেলেন। জেসি তো খুব খুশি। স্বামীর সঙ্গে জাহাজে ঘুরবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কনরাড সে কাজটি নিলেন না। বিয়ের পর এমন লোকের সঙ্গে সব আত্মীয় স্বজন ছেড়ে চলে যেতে জেসির ভয় ভয় করছিল। তারপর আবার হানিমুন এ গিয়ে এক কাণ্ড। কিছু লোক জেসিকে কনরাডের মেয়ে ভাবায় তো তিনি ভয়ঙ্কর ক্ষেপে গেলেন। তার ফলে আবার সেই ফিট—নার্ভাসনেস, অসুস্থতা, ভয়।
বিয়ের প্রস্তাবের সময়তেই কনরাড জানিয়েছিলেন, তিনি প্রথাগত সংসার পছন্দ করেন না। তাই জেসি যখন বিয়ের একবছর পর সন্তানসম্ভবা হলেন, তখন কনরাড খুবই বিরক্ত হলেন। এমনকি জেসির ভালোমন্দ দেখার দায়িত্বও তিনি নিলেন না। বন্ধুকে লিখলেন, “I hate babies”। উনি জেসির যত্ন এবং ভালোবাসায় ভাগ বসবে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এ বিষয়ে একটা মজার গল্প বলেছেন জেসি। ছোট্ট ছেলে বরিসকে নিয়ে ট্রেনের প্রথম শ্রেণিতে বসে কনরাড। জেসি এবং তাঁর বোন যাচ্ছেন। কনরাড ওদের থেকে বেশ দূরে বসে পেপার পড়ছেন। যেন ওদের কেউ নন। খবরের কাগজে মুখ ঢাকা। বাচ্চা তো চিল চিৎকার জুড়েছে। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। কামরা শুদ্ধু লোক অস্বস্তিতে। কনরাড সেদিকে দৃকপাত নেই। শেষে জেসির বোন কনরাডকে ডেকে ওপরের ব্যাগ থেকে যখন দুধের বোতলটা পেরে দিতে বলল তখন সমস্ত যাত্রীরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দারুণ মজা পেল। কনরাড খুবই অস্বস্তিতে পড়লেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

দ্বিতীয় সন্তান জনের যখন চার মাস, তখন তাকে নিয়ে ফ্রান্স যাচ্ছেন। ট্রেনে। উঠেই কনরাড বাচ্চার জামাকাপড়ের ব্যাগ ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিলেন। জেসি অত্যন্ত সংযত চরিত্রের। রাগের কোনও প্রকাশ ঘটালেন না। কনরাডকে বললেন, কাপড়ের ব্যাগটি যে পাবে সে বাচ্চার মৃতদেহ খুঁজবে আশেপাশে।

আসলে কনরাড তাঁর ভালোবাসায় ভাগ হওয়ার ভয়ে পেতেন। শৈশবে মাকে হারিয়েছেন। কোনও পরিবার পাননি বড় হওয়ার সময়। জেসি এ ব্যাপারটা অনুভব করতেন এবং তাঁকে মাতৃস্নেহে প্রশ্রয় দিতেন। বরিস, কনরাডের বড় ছেলে বলেছেন, তাঁর মা তাঁকে নাম ধরে ডাকতেন, আর বাবাকে ডাকতেন ‘বয়’ বলে। কনরাড জেসিকে মিসেস কনরাড বলতেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ

জেসির মাতৃসুলভ ভালোবাসার একটি ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। একবার কনরাডের প্রচণ্ড দাঁতে ব্যথা। রাতে যন্ত্রণা বাড়লে ওষুধ মেশানো জলে কুলকুচি করতে হচ্ছে একটু পর পর। বিছানায় জেসির কাঁধে মাথা কনরাড ঝিমোচ্ছেন। জেসি জলের গ্লাস হাতে ধরে আছেন। যখনই কনরাড চাইছেন জল দিচ্ছেন। জেসির চোখে ঘুম নেই। কনরাডের মুখ থেকে জল পরে ভিজছে গা। কিন্তু অতন্দ্র হয়ে তিনি সারারাত। কনরাড ঘুমালেন। সকালে উঠে বললেন, ইসস কি ভেজা বিছানায় শুয়েছি কাল!
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৩: রাজসভায় মিথিলার সঙ্গীতজ্ঞ

জেসি হয়তো কনরাডের বৌদ্ধিক জীবনের সহচরী হতে পারেননি। কিন্তু অসম্ভব যত্নে, ধৈর্যে এক চমৎকার সুখী গৃহকোণ গড়েছেন। স্বামীর খামখেয়ালিপনায় অনেকবার অনেক জায়গায় সংসার সরিয়েছেন। কনরাডের বন্ধুরা তাঁর এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ও গুণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জেসির নিজের হাঁটু দুটো প্রায় অকেজো হয়েছিল দীর্ঘদিন। কয়েকবার অপারেশন হয় এবং ঠিক হয়নি। এ ছাড়া নড়াচড়া কম হওয়ার ফলে স্থূলাঙ্গী হয়ে পরেন। কনরাড এ নিয়ে ঠাট্টা করে তার বন্ধুকে বলেন, জেসি নিজেকে কি করে আর স্লিম বলবে? জেসি বলেন, “আমি তো কোনওদিনই সুন্দরী ছিলাম না। এখনও নই।”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

জেসি যদিও সবসময়ই বাইরের জগতের কাছে কনরাডের স্বভাবের প্রশংসা করেছেন, কিন্তু তাঁর অপরিসীম ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে কনরাডের মৃত্যুর পর। স্বামীকে এক অসম্ভব স্বার্থপর মানুষ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতো স্ত্রী ছিলেন বলে বেঁচে গিয়েছেন। নইলে এক বড় বিপর্যয় হতো তার জীবনে, এমনটিই দাবি করেছেন। হয়তো হতো। হয়তো কনরাডের সৃজনশীলতার স্ফুরণ বাঁধা পেত। আবার অন্যদিকে জেসির ভালোবাসাকে ভীষণভাবে আঁকড়ে থাকতেন কনরাড। তার ভাগ কাউকে দিতে নারাজ ছিলেন।

এ ছাড়া জেসির শারীরিক অসমর্থতার কথা ভেবে কনরাড ঘরের সব আসবাবপত্রের ব্যবস্থাপনা করেছেন। দীর্ঘদিন চলাফেরায় প্রায় অসমর্থ ছিলেন জেসি। কনরাড তার খেয়াল রাখতেন। হয়তো কনরাডের ভালোবাসার ধরনটাই অমন। একই তারে বাঁধা না থাকলেও কোনও ছন্দপতন ঘটেনি তাঁদের বিবাহিত জীবনে। জেসির স্বার্থহীন ভালোবাসা কনরাডের স্বার্থপর ভালোবাসাকে সস্নেহ প্রশ্রয়েই লালন করেছে সারাটি জীবন।
*ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content