মা সারদা।
মা সারদার ভাইজি নলিনীর শুচিবাই প্রায় সকলেরই জানা আছে। এর জন্য তিনি শ্বশুরঘরও করতে পারেননি। নলিনীর এক একদিন বাই এমন মাত্রা ছাড়ায় যে বাড়ির সকলকে অস্থির করে তোলে। কেউ বলে যে, আজ নলিনী তার পিসিমা সারদার কাছ থেকে বড় কিছু একটা চাইবে, তাই এরকম মতলব করেছে। একদিন শীতকালের সন্ধেবেলায় নলিনী বাইরে থেকে এসে তার পিসিমাকে কান্নার সুরে বলল যে, সে কোন ময়লা জিনিস ছুঁয়ে ফেলেছে। এখন শীতের ঠান্ডায় পুকুরে স্নান করতে পারবে না, তাই নিজের ঘরেও যেতে পারবে না। আর এইজন্য আজ রাতে তাকে না খেয়ে থাকতে হবে। শোওয়াও যাবে না, বারান্দায় বসেই সারা রাত কাটাতে হবে।
শ্রীমা তাকে অনেক বোঝালেন যে গঙ্গাজল স্পর্শ করলে বা কাপড় ছেড়ে হাত, পা ধুয়ে এলেই হল। নলিনী সেকথা কিছুতেই মানল না। দুঃখ করে অভিমানে নিজের ঘরের বারান্দায় বসে রইল যেন সব দোষ শ্রীমার। শ্রীমা তাকে অনেকবার ডাকলেন, বাড়ির সকলেও অনেক বোঝালেন। কিন্তু নলিনী উঠল না, কেবল চোখের জল ফেলতে লাগল। সকলে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল। আর নলিনীর প্রতি বিরক্ত হয়ে তারা শ্রীমাকে অনুরোধ করে গেল তিনি যেন আর নলিনীর জন্য কষ্ট না করেন। তাকে বারবার না ডেকে একটু শিক্ষা দেওয়া ভাল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন
এদিকে নলিনীর অভিমান বাড়তে লাগল। এবার সে উঁচুস্বরে কেঁদে বিলাপ করতে লাগল। সংসারে তাকে কেউ দেখার নেই। স্বামীর ঘরে তার স্থান হল না। বাবার ঘরে এলেও, বাবার দ্বিতীয় সংসারে সৎমা আছে। শুধু পিসিমাই তাকে স্থান দিয়েছেন। তাই সকলে তাকে হিংসে করে বলে এখানে থাকাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। খানিক চুপ করে থেকে আবার বলে ওঠে, ‘দুঃখে দুঃখেই আমার জীবন যাবে’। বাড়ি এখন নিস্তব্ধ, সবাই ঘুমোচ্ছে। মা সারদা উঠে মধুর স্বরে ডাকতে লাগলেন, ‘নলিনী, আয় মা, কেন বারান্দায় শুয়ে কষ্ট পাচ্ছিস। হাত, পা ধুয়ে খেয়ে ঘরে শুবি চল’। যাদের তখনও ঘুম আসেনি, সেই করুণ, মধুর ডাক তারাও শুনতে পেল।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৩: প্রফুল্লময়ী— একটি বইয়ের লেখক এবং একটি জীবন ভরা ডিপ্রেশন
শ্রীমাও দুঃখ করে বলতে লাগলেন, ‘আহা, নলিনী ছেলেমানুষ, বুদ্ধি কম, তাই রাগ করে কষ্ট পায়। আর সবাই তার উপরে বিরক্ত হয়’। এই কথা শ্রীমা বারবার বলতে লাগলেন। একথা শুনে স্বামী সারদেশানন্দ ভেবে অবাক হলেন যে, তাঁরা যখন অন্যের উপর রাগ করেন, তখন সবাই ভাবে ইচ্ছে করেই বিরক্ত করার জন্য জেনে বুঝে এমন করা হচ্ছে। কিন্তু শ্রীমা বলছেন যে, সে বুঝতে পারে না। তার বুদ্ধি কম, তার কি দোষ। বুদ্ধিহীন অবোধ শিশুর উপর কেউ কি রাগ করে? তিনি নলিনীর কাছে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন। নলিনীরও দুঃখ দূর হল, সে কাপড় ছেড়ে খেয়ে ঘরে শুতে গেল। শ্রীমার মনও প্রসন্ন হল। শ্রীমার সঙ্গে এইরকম ঘটনা বহুবার ঘটেছে আর তিনি সব শান্তভাবে সহ্য করেছেন।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
শ্রীমার ছোট ভাজ নিজে রেঁধে নিজের ঘরে খান। তার কিছু ভাগে পাওয়া ধানজমি আছে। এছাড়া সিংহবাহিনী মন্দিরের আয়ের কিছু অংশও আছে। সব মিলিয়ে তার চলে যায়। সে বিধবার কঠোর জীবন যাপন করে। তার মেয়ে রাধু আর জামাই শ্রীমার সংসারেই খান। তবে ছোট বউও সাধ্যমতো তাঁদের রেঁধে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। তার রাধুকে নিয়ে শ্রীমার সঙ্গে ঝগড়া লেগেই আছে। শ্রীমা কখনও বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘নিয়ে যা তোর মেয়েকে’। তখন সে পালিয়ে আসে। কারণ, সে জানে যে মেয়েও তার কাছে আসবে না, আর এলেও তার খাওয়াবার সঙ্গতি নেই। রাধুর গর্ভধারিণীর প্রতি যে টান নেই, এমন নয়, যদিও সে মাকে ‘নেড়িমা’ বলে ডাকে। রাধুর মার মাথার কিছুটা নেড়া। নেড়িমার প্রতি বিরক্ত হয়ে রাধু তার মাকে কখনও তাড়ায়। পাগলী মামি তখন চোখের জল ফেলেন। বারবার পিছন ফিরে তাকিয়ে চলে আসেন।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৭: যুগধর্মের সমর্থনহীন ধর্মচিন্তার স্থান কোথায়?
রাধু যখন শ্বশুর বাড়ি যায়, তখন তাকে দেখার জন্য কাতর হয়ে সর্বদা জয়রামবাটি আর তিন মাইল দূরে জামাইয়ের বাড়ি তাজপুরে যাতায়াত করতে থাকেন। তার মনে দুঃখ হয়, যখন দেখেন সোনার চাঁদ ছেলেরা সব সংসার ছেড়ে মা সারদার কাছে এসে দীক্ষা নেয়। কখনও পাগলী মামি ছেলেদের সামনে দুঃখ চাপতে না পেরে প্রকাশ্যেই শ্রীমাকে বলে ফেলেন, ‘তোমাদের মাই তো গর্ভধারিণী মার কাছ থেকে ছেলেদের কেড়ে নেয়। আর সাধু করে ঘরবাড়ি ছাড়ায়’। মা সারদা শুনে মৃদু হাসেন। শ্রীমার কাছে শুধু ছেলেরাই যে আসে, তা নয়। মেয়েরাও আসে। তরুণী, যুবতী, শিক্ষিতা, বিধবা সব ধরণের মেয়েরাই আসে।
তবে সেসময়ের রক্ষণশীল সমাজের কাছে তা অসহ্য ছিল। তাঁদের কাছে এসব সমাজে উচ্ছূঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া বলে মনে হত। শ্রীমাও কারো মনে যাতে আঘাত না লাগে, তাই সাবধানে থাকতেন। কোনো প্রকার সামাজিক ও পারিবারিক ব্যাঘাত ঘটুক, তা তিনি চাইতেন না। তবে তাঁর স্নেহের আকর্ষণ মানুষকে সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছে, তাই তারা আর ঘরে থাকতে পারেনি। প্রকৃত ভক্তকে তো কেউ বাধা দিতে পারে না। শ্রীমার কল্যাণে তাদের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়।—চলবে।
তবে সেসময়ের রক্ষণশীল সমাজের কাছে তা অসহ্য ছিল। তাঁদের কাছে এসব সমাজে উচ্ছূঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া বলে মনে হত। শ্রীমাও কারো মনে যাতে আঘাত না লাগে, তাই সাবধানে থাকতেন। কোনো প্রকার সামাজিক ও পারিবারিক ব্যাঘাত ঘটুক, তা তিনি চাইতেন না। তবে তাঁর স্নেহের আকর্ষণ মানুষকে সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছে, তাই তারা আর ঘরে থাকতে পারেনি। প্রকৃত ভক্তকে তো কেউ বাধা দিতে পারে না। শ্রীমার কল্যাণে তাদের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।