শ্রীমা।
মা সারদার ভক্ত আশুতোষ মিত্র লিখেছেন যে,বলরাম বসুর কোঠারের জমিদারীতে থাকার সময় তাঁর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন, শ্রীমার তীর্থভ্রমণের প্রতি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। রামেশ্বরম যাবার কথা উঠলে তিনি বলেছিলেন, ‘ঠিক বলেচ বাবা, আমার শ্বশুরও গিয়েছিলেন আর সেখান থেকে ‘রামশিলা’ নিয়ে এসেছিলেন। এখনও কামারপুকুরে নিত্য পুজো হয়, দেখেচ তো? আমি যাব’। তারপর ঠিক হল যে শ্রীমার সঙ্গে স্বামী ধীরানন্দ, স্বামী আত্মানন্দ, রাধুর মা, (যিনি কোঠারে আসেননি। রামেশ্বরম যাওয়ার আগে মা সারদা তাকে জয়রামবাটি থেকে ডেকে পাঠান), গোলাপমা, রামের মা, নিতাইয়ের মা ও আশুতোষ মিত্র রামেশ্বরমের তীর্থে যাবেন।
এই প্রসঙ্গে মহাদেবানন্দ বলেন যে, কেদারের মা নামে একজন মহিলাভক্তও শ্রীমার সঙ্গে গিয়েছিলেন। তার তখন দীন অবস্থা, নিজেকে আড়াল করে রাখতেন। তাই তার কথা মিত্র মহাশয়ের মনে নেই। মহাদেবানন্দ জানান যে, কেদারের মার কাছে তিনি মীনাক্ষীদেবীর গল্প শুনেছেন। এছাড়া আরও শুনেছেন যে, বামেশ্বরম মন্দিরে শ্রীমা শিবলিঙ্গ দেখেই বলেছিলেন, “আহা, যেমনকার তেমনটি আছে গো।” একথা শুনে মা সারদা কি বলতে চাইছেন, গোলাপমা তা জানতে চাইলে শ্রীমা আর কিছু বললেন না।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৯: শ্রীমায়ের ভক্তের গ্রামে তীর্থদর্শন
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— সুখদর্শন ও হুড়ো
তীর্থে যাবার আগে ব্যবস্থা করার জন্য মাদ্রাজে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে চিঠি লেখা হল। সেখান থেকে উত্তর এলে মাঘমাসের শেষে সাকুল্যে আটজন মা সারদার সঙ্গে রওনা হলেন। ভদ্রক নামক স্থানে পুরুষদের জন্য মধ্যম শ্রেণির আর মহিলাদের জন্য দ্বিতীয়শ্রেণীর মাদ্রাজমেলের টিকিট কাটা হল। বলরামবাবুর সুযোগ্য পুত্র রামকৃষ্ণ বসু খুরদা রোড পর্যন্ত তাঁদের পৌঁছে দিয়ে পুরী চলে যান। খুরদা রোড পার হতেই কিছুদূরে সকলের প্রসিদ্ধ চিল্কা হ্রদ চোখে পড়ল। সকালবেলার ফুরফুরে হাওয়ায় তাঁদের রাত্রির অবসাদ দূর হয়ে গেল। এমনকি দেখা গেল বকপংক্তি রাতের আলস্য ত্যাগ করে ডানা মেলে গা ঝাড়তে ঝাড়তে হ্রদের পারে বিচরণ করছে। আরও এক ঝাঁক হয়তো অদূরের ছোট পাহাড় থেকে উড়ে আসছে। আবার নীলকণ্ঠ পাখির দল নীলাকাশে উড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির সে এক মনোরম দৃশ্য। তাই দেখে শ্রীমা বালিকার মতো আনন্দে সকলকে ডেকে দেখাতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৫: পতন আসন্ন হলেই সবার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়
দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা
নীলকণ্ঠ পাখি দেখে মা সারদা জোড়হাত করে প্রণাম করেন। বেলা প্রায় আটটার সময় গাড়ি গঞ্জাম জেলার বহরমপুর স্টেশনে পৌঁছল। সেখানে কেলনার কোম্পানির বাঙালি ম্যানেজার তাঁদের অপেক্ষায় ছিলেন। সেদিন সকলে তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেন। অপরাহ্ণে নারকেল ও কলা প্রভৃতি ফল হাতে নিয়ে গঞ্জামবাসী ভক্তরা মা সারদার দর্শন করতে আসেন। পরের দিন তাঁরা আবার সকলে মাদ্রাজ মেলে রওনা দিলেন। সন্ধ্যার সময় প্রসিদ্ধ স্বাস্থ্যাবাস ওয়ালটেয়ার পড়ল। গাড়ি থেকে পাহাড়ের গায়ে অট্টালিকাগুলো যেন একখানি ছবির মত দেখাচ্ছিল। এখানেও শ্রীমা আনন্দে বালিকার মতো সকলকে ডেকে বলতে লাগলেন, “দেখ, দেখ যেন ছবির মতন বাড়িগুলো পাহাড়ের গায়ে।”
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭০: জন্মান্তরের সুরসাধক আরডি বর্মন
সকলে সেদিন দিন ও রাত্রি গাড়িতে থেকে দুপুরে মাদ্রজে পৌঁছলেন। স্টেশনে তিনটে গাড়ি নিয়ে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ও কয়েকজন মাদ্রাজি ভক্ত অপেক্ষা করছিলেন। এখানেই মা সারদা প্রথম মোটরগাড়ি চড়লেন। তাঁরা ময়লাপুরে শ্রীবামকৃষ্ণ মঠের সামনে একখানি ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। এখানে তাঁরা একমাস ছিলেন। প্রতিদিন শ্রীমার সঙ্গে দেখা করার জন্য মাদ্রাজি ভক্তদের অতিশয় ভিড় হতে লাগল। মহিলাবিদ্যালয়ের মহিলা ও মেয়েরা এল। মহিলারা তামিল ভজন গেয়ে শোনালেন আর সঙ্গে বালিকারা বেহালা বাজিয়ে শ্রীমাকে শোনাল। আশুতোষবাবুরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় বায়ুসেবনের জন্য মা সারদাকে নিয়ে সমুদ্রতীরে যেতেন। সেখানে বসবার এবং ঘুরে বেরানোর সুবন্দোবস্ত আছে।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
একদিন এখানে প্রাচীন দুর্গ দেখা হল যেটি ভারতে ইংরেজদের স্থাপিত প্রথম দুর্গ। এই দুর্গ দেখতে গিয়েই শ্রীমা প্রথম রিক্সায় চড়েন। অন্য একদিন সমুদ্রতটে মৎস্যাগার দেখা হল। আশুতোষবাবুর কথা থেকে জানা যায়, তখনও মৎস্যাগারটি সম্পূর্ণ হয়নি। তার মধ্যেও সেখানে নানা বর্ণের ও আকারের সামুদ্রিক মাছ সংরক্ষিত করা হয়েছিল। বাকি দুদিন ট্রিপলিকেনে পার্থসারথির মন্দির ও ময়লাপুরে শিবমন্দির দর্শনে যাওয়া হল। এখানে কয়েকজন নরনারী শ্রীমার কাছে মন্ত্রদীক্ষা নেন। এঁদের মধ্যে অমৃতানন্দ নামে আমেরিকার একজন ব্রহ্মচারিও ছিলেন। আর তাঁদের কেউ কেউ স্বপ্নে ঠাকুর ও শ্রীমার দর্শন লাভ করে এসেছেন। এই বিষয়ে শ্রীমা বলেছেন, “যখন কোঠারে ও মাদ্রাজে গেলুম তখন যে আসে, সে এসেই বলে স্বপ্ন আর স্বপ্ন।”—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।