বুধবার ২৬ মার্চ, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

মিত্রসম্প্ৰাপ্তি

তারা চারজনে সেই সরোবরে ফিরে এসে সারাদিন নিজেদের মধ্যে গঠনমূলক কথাবার্তা চর্চা করতে করতে দিন কাটাতে লাগলো। মিত্রসম্প্রাপ্তির কাহিনীমালা সমাপ্ত করে বিষ্ণুশর্মা বললেন, এই কারণেই বুদ্ধিমান বিবেকী পুরুষেরা সব সময় মিত্র সংগ্রহ করেন। কারণ মিত্রশক্তি যাঁর যতো বেশি থাকে ততোই সেই রাজাই রাজমণ্ডলের মধ্যমণি হন। তাই মিত্রদের সঙ্গে কপটাচরণ করা কখনই উচিত হয়।
শেষ শ্লোকে বিষ্ণুশর্মা বলছেন—

যো মিত্রাণি করোত্যত্র, ন কৌটিল্যেন বর্ততে।
তৈঃ সমং ন পরাভূতিং সম্প্রাপ্নোতি কথঞ্চন।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ১৯৬)
প্রতিকূলতায় পরিপূর্ণ এই দুঃখময় সংসারে যে মানুষ নিয়মিত অনেক মিত্র বা বন্ধু সংগ্রহ করেন এবং তাঁদের সঙ্গে কখনও কপটতা করেন না তাঁকে কখনও কোনো শত্রু স্পর্শ করতে পারে না। পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে অর্থশাস্ত্রের যে ভাবধারা নিয়ে এই পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থটি বিষ্ণুশর্মা রচনা করেছেন, সেই অর্থশাস্ত্রে রাজা শব্দটির মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পাশাপাশি শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, পশুপালন, আমাত্য, দূত এমনকী বৈদেশিক নীতিও একাত্ম হয়ে আছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৪: মনের ইচ্ছে থাকলেই কার্যসিদ্ধি সম্ভব

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?

অর্থশাস্ত্রের রাষ্ট্র ভাবনায় কেবল প্রজাদের সুখ-শান্তি কিংবা তার বিপর্যয় নিয়েই কেবল চিন্তা করে না; রাষ্ট্র এখানে মানুষের ব্যক্তিগত স্তরেও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। সেখানে পিতার কাছে পুত্র কিংবা স্বামীর কাছে বিবাহিতা স্ত্রী বা ভাই-বোন, গুরু-শিষ্য বা সমাজের প্রতিটি মানুষ তার প্রতিবেসীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবেন সে সব কিছু নিয়েই অর্থশাস্ত্রকারেরা চিন্তা করেছেন। দরিদ্র, গর্ভবতী, সদ্যোজাত পুত্র কিংবা জারজ সন্তান, বৃদ্ধ, পঙ্গু এবং অসহায় ব্যক্তি সকলের জন্যেই চিন্তা করতে দেখা যায় কৌটিল্য প্রবর্তিত রাষ্ট্র চিন্তনে। সেখানে জন্ম থেকে শুরু করে বিবাহ, তদন্তর বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রেমিক-প্রেমিকার সম্বন্ধ, এমনকী স্ত্রী বা প্রেমিকার মন-ভুলানোর ক্ষেত্রে নীতিনিয়ম সবই আছে এবং সেই সব নীতিনিয়ম না মানলে স্থান-কাল ও পাত্র অনুযায়ী যে শাস্তি হতে পারে সে তালিকাও তিনি করেছেন। সেই সঙ্গে রাজ্য পরিচালনার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা তাঁর অর্থশাস্ত্রে আছে।
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৯: আকাশ এখনও মেঘলা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

বিশাল এই রাজত্ব যেন একটি রথের মতো; রথ যেমন একটি চাকায় চলতে পারে না, তার দুটো চাকার সহায়তা প্রয়োজন। তেমই এই রাজত্বও হলো সহায়সাধ্য। একা একা রাজত্ব চালানো যায়না। ফলে কৌটিল্য সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রের কথা গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করেছেন। সেই সপ্তাঙ্গ রাজ্যের মধ্যেই সপ্তম তথা শেষ অঙ্গ হল ‘মিত্র’বা ‘সুহৃদ্’। ‘মিত্র’ শব্দটির মধ্যে সারল্য থাকলেও ‘মিত্র’ বলতে এখানে কেবল বন্ধুসংগ্রহের উপায় নিয়েই আলোচনা করা হয়নি সেই সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। কূটনীতি বলে, কেউ কারও বন্ধুও নয়, আবার কেউ কারও শত্রুও নয়। এক রাজা যে আরেক রাজার শত্রু কিংবা মিত্রে পরিণত হন, তার কারণ হল স্বার্থ অর্থাৎ প্রয়োজন। সোজা কথায় অপার ধনসম্পদ লাভের ইচ্ছা। কিন্তু এইটাও ঠিক যে ব্যক্তির যতো বেশী অকপট বন্ধু থাকে সেই ব্যক্তি ততো নির্বিঘ্ন জীবন যাপন করে। কারণ একজন যথার্থ বন্ধু অপর বন্ধুকে সাহায্য করে নিস্বার্থভাবে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৩: সাত-সহেলি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৬: ভারতীয় পারিবারিক জীবনে স্নেহময় জ্যেষ্ঠর ভূমিকায় রামচন্দ্র কতটা আকর্ষণীয়?

মিত্রসম্প্রাপ্তির শেষে যেটা বলবার সেটা হল, এই তন্ত্রের অধিকাংশ কাহিনিতেই কিন্তু ভাগ্য কিংবা দৈবের কথা এসেছে বিভিন্ন ভাবে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে দৈব এবং পুরুষকারকে ভাগ্য রথের দু’ই চাকার সঙ্গে তুলনা করা হয়। রাজার সন্তানদেরকে বিষ্ণুশর্মা সম্ভবতঃ সেই বিষয়টিকেও নজরে রাখবার পরামর্শ দিয়েছেন প্রচ্ছন্নভাবে। সত্যি বলতে ইটালীর ধুরন্ধররাজনীতিবিদ ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ নামক বস্তুবাদী গ্রন্থের সঙ্গে এখানেই পঞ্চতন্ত্র এক অনন্য মাত্রা লাভ করে। রাজপুত্রদের তিনি শেখাতে চেয়েছিলেন যে কোনও সাফল্যের পথে ভাগ্য বিপর্যয় থাকতেই পারে। কেবল পুরুষকার বা সত্প্রচেষ্টা থাকলেই সব হয় না।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯o: মা সারদার কথায় ‘ঈশ্বর হলেন বালকস্বভাব’

সাফল্যের গতি কখনও কখনও ভাগ্যের কারণে হ্রাস হতেও পারে। কিন্তু দৈবের হাতে নিজেকে সঁপে দিলে চলবে না কখনই। পুরুষকার বা প্রচেষ্টা এবং মিত্রশক্তির হাত ধরেই সেই দৈব-দুর্বিপাক থেকে উদ্ধার পেতে হবে। তাই যথার্থ সামর্থ্য না থাকলে মিত্রশক্তির সহায় সাফল্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা। শিশু রাজপুত্রদের নবীন বুদ্ধিবৃত্তিতে তাঁদের রাজনৈতিক জীবন শুরুর প্রারম্ভেই মিত্রশক্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত করতেই এই দ্বিতীয় তন্ত্র বিষ্ণুশর্মা আলোচনা করলেন। কাক, ইঁদুর, হরিণ বা কচ্ছপ — যাদের মধ্যে মিত্রতা তৈরী হতে পারে না, গল্পের মধ্যে দিয়ে বিষ্ণুশর্মা দেখালেন এইরকম অসম-বন্ধুত্বও কেমন কার্যসিদ্ধির সহায়ক হতে পারে। তাই যেকোনো ক্ষেত্রেই যদি মিত্রপ্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দেয় তবে সযত্নে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে।—চলবে।

মিত্রসম্প্রাপ্তি নামক দ্বিতীয় তন্ত্র সমাপ্ত

* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content