শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


স্কেচ: লেখক।

লালু, কালু, লালি আর ভুলি কী করে যেন জানতে পেরেছে মানুষরা আগস্ট মাসে তাদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করেছে। দিন যদিও এল, দীনতা কাটল না। কৈ! হাড়টাও তো জুটল না! যদিও বিশ্ব ভৌ ভৌ দিবস। তবুও এই দিন দুপেয়েরা হটডগ খেতে খেতে ‘চিল’ করে। এই তো সেদিন, সামনের ফ্ল্যাটে, মাছ বেচতে এসেছিল। লালু লাজুক মুখ করে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে। তখনই চারতলা থেকে কে যেন ‘চিলে মাছ নিয়ে গেল’ বলে হাঁউমাউ করে উঠল। এরপর মহা গণ্ডগোল। চিল উড়ে গিয়েছে। লালু খানিক ঠ্যাঙার বাড়ি খেল।

গেল আশ্বিনেই লালুর চারটে বাচ্চা হয়েছে। দুপেয়েগুলো ওই চিলটাকে তার বাচ্চা বলছে কেন সেটা ভেবেই লালু অবাক হয়। তার সঙ্গে চিলের কী সম্পর্ক? তার ওপর এইটা যদি চিল হয়, তাহলে হটডগ খেতে খেতে মানুষের পো’য়েরা যে চিল করে সেও কি এমন চোর নাকি? চোখে চোখে রাখতে হবে ব্যাপারটা। পাড়ায় চুরি হচ্ছে খুব। এই সেদিন ভুলি লেজ মেলে রাস্তায় একটু আরাম করছে।
চারপাশ দিয়ে ভোঁ ভোঁ করে রিকশা ছুটছে, ভুলিকে দেখে একটুও সামলে চলছে না, এমন বেহায়া। তো, ভুলিও দেখে রাখছে তার লেজে কোনও টাচ লাগছে কী না। এই সময় পাশের বাড়ি থেকে একটা ঠোঙা পড়ল, কী আছে দেখার জন্য ভুলো যেই এগিয়েছে, ওমনি বেপাড়ার কালু ওস্তাদ সেটা মুখে নিয়ে দৌড়। কালু কোথায় যেন ঘাপটি মেরে ছিল। এরপর পাড়ায় তুলকালাম।

অশ্বত্থতলার পাঁচ নম্বর বাইলেনের সারমেয় কল্যাণ সমিতির জেনারেল বডি মিটিং বসল। ট্রেসপাসার্স প্রিভেনশন অ্যাক্ট খুলে বোঁচা ভুলু আর কোলোমানিক প্রথমে বেশ লেকচার দিল। বাকি সকলেই যে যার মত জানাতে লাগল। এতে বেশ খানিক কোন্দল হল। মন্টুর চা দোকান থেকে কালু ভুলুদের ঠাকুরদাদার বত্রিশ পুরুষকে লক্ষ্য করে কারা যেন শাসাতে লাগল। তখন মিটিং-এ আবার নতুন একটা রেজোলিউশন আর নিন্দা প্রস্তাব নেওয়া হল কুত্সার বিরুদ্ধে। শেষে চার নম্বর গলি থেকে ‘আতু আতু’ ডাক শুনে মিটিং ভেঙে গেল। ওখানে ভুলু, লালু, ভৌ, ঘেউ সকলে ডিনার করে। ডিনার দিয়ে তাদের ডেকে চলেছে লীলা বৌদি।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১১: মশ্যা রে তুঁহু মম শ্যাম-সমান

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৮: রাজবাড়িই রাজনগরের নারীর উন্মুক্ত আকাশ

ওদিকে মোড়ের মাথায় গোবিন্দ হোটেল বন্ধ করার আগে লালি, ভুলি, জলি, বনিদের ডাকতে লাগল। ওরা মিটিংয়ের শেষ লাইনে বসে হেসে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছিল। ডাক শুনেই কান খাড়া করে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিল। পিছনে দৌড় দিল গনশা আর কাতু। শেষে আর কজনেই বসে রইল। সেক্রেটারি আর প্রেসিডেন্ট সবার আগেই দৌড় দিয়েছে।

এইসময় ডিনার না পেয়ে হাবলা দুটো লেড়ু বিস্কুট চিবোতে চিবোতে এসে বসল। ভুলি বসে ঢুলছিল। ভুলির গা ঘেঁষে বসে হাবলা দুটো হাঁচল, একটা হাই তুলে নিজেই সাফাই গেয়ে বলল, ঠান্ডা লেগে গিয়েছে বুঝলি, পরশুর বৃষ্টিতে, একটু চা পেলে ভালো হতো। ভুলি চোখ সরু করে বলল, হাউ! আমার কি চা দোকান আছে? হাবলা বলল, চটিস ক্যানো? তুই যেখানে চটি চিবোতে যাস, ওই যে রে, হরেনের চা দোকানে, ওখানে তোর বেশ খাতির তো! গেলে খানিকটা দেবে না?
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

মিটিং ভেঙে গিয়েছে। পাড়ার কবি ট্যাঁপা ওস্তাদ মোড়ের রোলের দোকানে চড়ে দুপুরে লেখা কাব্যটা একটু জোরে শোনাচ্ছে। উল্টো দিকের বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে রকি লেজ নাড়ছে দূরে নাইট ওয়াকে বের হওয়া টাইগারকে দেখে। ট্যাঁপা কবিকে পাত্তা সে দেয় না। টাইগারের পিছনে ডিনার-ফেরত কালু লালুর দল। ওদের দলটা ক্রমে গলির বাঁকে হারিয়ে গেল। পাড়ার ওস্তাদ কালোয়াত ঘোঁতনা বিড়ির দোকানের নিচে থেকে বেরিয়ে এসে গলা খাঁকরিয়ে রাগ রজনীতে রেওয়াজ শুরু করল। আশেপাশের বাড়ি থেকে দুমদাম জানলা বন্ধ হওয়ার শব্দ… রাত বাড়ে।

বিশু মাতাল ভুলির হাত ধরে প্রথমে বিড়বিড় করে কী সব বলে, তারপর ভুলিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। তারপর চলে যায়। গায়ক ঘোঁতনা গান থামায় না, আজ সুর খুলছে ভালো। দুপুরে হরির হোটেলের বাসি তরকারিটা হেব্বি ছিল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৪: ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে কোচস্থাপত্যের অন্যতম কীর্তি দেওতাপাড়া শিব মন্দির

ক্লাবের মধ্যের চৌকো ছিমছাম যন্ত্রটা থেকে মানুষের গলা ভেসে আসে, কে যেন গদগদ হয়ে বলছে “আজ বিশ্ব সারমেয় দিবস, সকাল থেকেই পাড়ার মোড়ে মোড়ে, ডগ শো’তে, টক শো’তে নানা মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান চলছে”… বাইরে শুয়ে ভুলো অবাক হয়, তারপর হাসে, বাক্সটার মাথা খারাপ নিশ্চয়ই, না হলে ভিতরের লোকটা এসব ভুল বকছে কেন! এরাই তো হ্যাংলা কুকুরের পেটে ঘি ভাত সহ্য না হওয়ার আনন্দে ডগমগ করে।

ক্লাব বন্ধ করে কাকুরা চলে যায়। ঘোঁতনার গান থেমে গিয়েছে। ট্যাঁপা ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃষ্টি নেমেছে। অনেক রাত। ক্লাবের দরজা খুলে একটা সিড়িঙ্গে লোক কথা বলা বাক্সটা নিয়ে পা টিপে টিপে চলে গেল। লোকটা খানিক আগে ঢুকেছিল দরজায় ম্যাজিক করে। ভুলো দেখেছিল। ভেবেছিল, বমাল সমেত ধরবে। এখন দেখল লোকটা ওই বাক্স নিয়ে সটকাচ্ছে। যাকগে! আপদ যাচ্ছে। ভুলো পিছন ফিরে শুয়ে পড়ে। তার লেজটা নড়তে থাকে কেবল।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content