বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। ছবি: সংগৃহীত।

কাগজে কাঁপাহাতে লেখা লম্বা একটি ইংরিজি চিঠি । যিনি লিখেছেন তিনি লিখিত জবানবন্দির আইনগত দিকটা বোঝেন। ঝরঝরে ইংরেজি ভাষায় গোটা গোটা অক্ষরে কালির কলমের লিখেছেন নিজের নামঠিকানা, ফোন নম্বর, কাকে লিখছেন তাঁর নাম, ঠিকানা। নিজের পাসপোর্ট নম্বর লিখেছেন আইনগত আইডেন্টিফিকেশন-এর জন্য। তিনি লিখেছেন, সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে কোনওরকম মানসিক শারীরিক জোরাজুরি ছাড়াই তিনি এই স্বীকারোক্তি লিখছেন। তার শারীরিক অবস্থা যথেষ্ট অবনতি হয়েছে এবং মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই সত্য স্বীকার করে তিনি দায়মুক্ত হতে চান।

দিল্লিতে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি প্রাইভেট নার্সিংহোমে তাঁর বোন সুজাতা দত্ত (বিয়ের আগের পদবী ছিল বসু রায়) যিনি তরুণকান্তি দত্তের স্ত্রী, ০৫/১২/১৯৬৮ তারিখে একটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করেন। তাঁর বোন একটি পুত্রসন্তান চেয়েছিলেন। বোনের সেই অসম্ভব অনুরোধ রাখতে ওই নার্সিংহোমে সেইদিন সেইসময়ে হওয়া একটি সদ্যোজাত পুত্রসন্তানের সঙ্গে সকলের অলক্ষ্যে এই মৃত কন্যাসন্তানকে বদল করা হয়। পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এই কাজের জন্য এবং বার্থ সার্টিফিকেটের প্রয়োজনীয় বদল ঘটাতে সেই নার্সিংহোমকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। গত প্রায় পাঁচ বছর আগে এই নার্সিংহোমের মালিক এবং পরিচিত ডাক্তার মারা গিয়েছেন। নার্সিংহোমটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনও নথিতে এই ঘটনার উল্লেখ নেই।
আজ এই স্বীকারোক্তি না দিলেও হয়ত কোনও ক্ষতি হতো না। কিন্তু পরবর্তীকালে আমি জানতে পেরেছি, পুত্র সন্তানলাভের পিছনের আসল কারণ ছিল আমার বোন সুজাতার পারিবারিক সম্পত্তির লোভ। কোনও এক ভণ্ড তান্ত্রিকের বুজরুকিতে বিশ্বাস করে সুজাতার মনে হয়েছিল তাঁর গর্ভের পুত্রসন্তান এই পারিবারিক ব্যবসার একমাত্র উত্তরাধিকার হবে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুকদেব রায়ের মনে হয়েছিল, এই ভয়ংকর মিথ্যা গোপন করে এই চক্রান্তের একজন সাহায্যকারী হয়ে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে না। তিনি এই ভয়ঙ্কর কঠিন সত্য স্বীকার করে মৃত্যুর আগে দায়মুক্ত হতে চান। সেই অজানা পুত্রসন্তানের মায়ের অভিশাপ থেকে মুক্তি চান। এই প্রায়শ্চিত্ত করার আগে তাই তিনি মা ভবতারিণীর কাছে অনুমতি চাইতে গিয়েছিলেন। নিচে নামসহ সই করা- অপরাধী শুকদেব বসু রায়।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি

বসুন্ধরা এবং…, ৩য় খণ্ড, পর্ব-৪৮: স্বীকারোক্তি

সুজাতার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তরুণকান্তি চিঠিটা নিজের হাতে ধরে রাখলেন। এই প্রথম সকলের সামনে সুজাতা ছুটে এসে তরুণকান্তির হুইলচেয়ারের সামনে তার পা ধরে তাকে অনুনয় করতে লাগলেন—
—লক্ষীটি আমার কথা শোনো! আমি স্বীকার করছি আমি সব দোষ করেছি। যা শাস্তি পাওনা সেটা আমাকে দাও! আমার দোষে তুমি!
—সুজাতা তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। ঠিক এই কারণেই তুমি কলকাতায় না থেকে সন্তান জন্মের সময় দিল্লি চলে গিয়েছিলে!

এই ঘরে ঢোকার প্রথম থেকেই প্রণয়ের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। তরুণকান্তির এই কথা শোনার পর প্রণয়কান্তি আচমকা তরুণকান্তির হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নিল—
—দেখি কী আছে এই চিঠিতে!
সুজাতা চিৎকার করে উঠলেন। তাড়াহুড়ো করে প্রণয়কে বাধা দিতে গিয়ে হুইলচেয়ারের চাকায় পা জড়িয়ে গিয়ে মুখ থুবড়ে পুরো শরীরের ভার নিয়ে মেঝের ওপর পড়ে গেলেন। নাকমুখ থেকে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগল। সুরঙ্গমা আর বাবলি ছুটে গিয়ে সুজাতাকে সোজা করে শোয়াতে গিয়ে দেখলেন সুজাতার জ্ঞান নেই। বিনয়কান্তির চিকিৎসার জন্য পুরো মেডিকেল টিম বাড়িতেই ছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সুজাতাকে নার্সিংহোমে পাঠানো হল।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪২: রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি দিয়েছিলেন রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৪: আশ্রমের আনন্দময় পিকনিক

সন্ধেবেলা বাবলি আর প্রণয়কান্তি মায়ের কাছে দেখা করতে এল। দুজনেই বাইরে যাবার পোশাকে তৈরি হয়ে এসেছে।
—তোরা কি নার্সিংহোম যাচ্ছিস? সানন্দা ফোন করেছিল এখনও জ্ঞান ফেরেনি।
—বসুন্ধরা ভিলার পেশেন্ট বেলভিউ নার্সিংহোম স্পেশাল কেয়ার নেবে।
—হ্যাঁ কিন্তু এখন গিয়ে আর… বরং কাল সকালে।
—কাল সকালে আমরা থাকব না সেজমা!

প্রণয়ের কথা শুনে আমার মা সুরঙ্গমা অবাক।
—আমরা মানে কোথায় যাচ্ছিস তোরা!
প্রণয় উত্তর না দিয়ে বাবলির দিকে তাকাল, বাবলি মাথা নামিয়ে নিল।
—আমরা আজই বসুন্ধরা ভিলা ছেড়ে চলে যাচ্ছি সেজমা!
—বাবলি! কী পাগলের মতো কথা বলছিস? কোথায় যাচ্ছিস? কেন যাচ্ছিস?
বাবলি উত্তর না দিয়ে মাথা নামিয়ে থাকল, প্রণয় পকেট থেকে চিঠিটা দেখিয়ে বলল—
—তরুণকান্তি দত্তের কাছে নিশ্চয়ই এর কপি থাকবে। পরে ধীরে সুস্থে তোমরা পড়ে নিও! এককথায় বললে, আমার শরীরে বসুন্ধরা ভিলার রক্ত নেই আমি এই বংশের কেউ নই। সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে তরুণবাবুর স্ত্রী সুজাতা দত্ত আমাকে আমার আসল মায়ের থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছিলেন। ঠিক সেই কারণেই বসুন্ধরা ভিলার অন্যান্যদের মতো আমি সভ্য ভদ্র হয়ে উঠিনি।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

আমার মা সুরঙ্গমা এই বিনীত অথচ দৃঢ় প্রণয়কান্তিকে চেনেন না। মা স্তম্ভিত হয়ে প্রণয়ের কথা শুনছিলেন।
—বাবলিকে আমি অনেক বোঝালাম। লিগ্যালি খাতায়পত্রে তরুণকান্তি দত্তের উত্তরাধিকার সে। বিয়ের পর থেকে আমি ওর সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। তবু ও আমার সঙ্গেই বসুন্ধরা ভিলা ছেড়ে যেতে চাইছে। বাবলি তুমি আর সেজ্জেঠু না থাকলে আমি তো আজ জেলেই থাকতাম। আমি তার চেয়ে খারাপ কিছু থাকবো না। কিন্তু বাবলির অনেক কষ্ট হবে।

সুরঙ্গমার দুচোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে যায়।
—বাবির সঙ্গে দেখা করেছিস বাবলি!
—না সেজমা, বাবির সামনে গেলে আমি দূর্বল হয়ে পড়বো। ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি রেখে গিয়েছি। প্রণয়ের যেখানে অস্তিত্ব নেই সেখানে।
আমার অস্তিত্ব কী করে থাকবে?
—এই সন্ধেবেলা বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবি তোরা ?
—অরুণাভকে ফোন করেছিলাম, ও দিল্লি গিয়েছে ওর মার কাছে। ওর ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকারের কাছে চাবি আছে। ও ফোন করে বলে
দিয়েছে। দুদিন ওর ফ্ল্যাটে থাকবো তারপর দেখি…

প্রথমে প্রণয় তারপর বাবলি নিচু হয়ে সুরঙ্গমাকে প্রণাম করতে সুরঙ্গমা নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। দু’জনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
—তোদের দুজনকে আটকাবার ক্ষমতা আজ ঈশ্বর আমাকে দেননি।
বাবলি একটা ছোট চাবির ব্যাগ দিয়ে বলল—
—সেজমা ওই ঘর আর দুটো আলমারির চাবি তোমার কাছে রাখো। পরে সময় মতো বাবিকে দিয়ে দিও। আমাদের দুটো ব্যাগে সামান্য কিছু জামাকাপড় আর কিছু নিজেদের একাডেমিক কাগজপত্র নিয়ে নিয়েছি। এখানকার চেকবুক ক্যাশটাকা জুয়েলারি সব আলমারির লকারে আছে। ওগুলো আর আমাদের নয়। আমার মায়ের দেওয়া গয়না সঙ্গে নিয়েছি।
—আমি আর বাবলি এবার এলাম সেজমা! সেজ্জেঠুকে ফেস করতে পারবো না। এ বাড়িতে এই একটা মানুষ কিছু বললে আমি মুখে ওপর না বলতে পারব না। তুমি প্লিজ সেজ্জেঠুকে বুঝিয়ে বলো! হ্যাঁ, তুমি একটু গেটে বলে দেবে, যে যদি একটা ট্যাক্সি আমাদের ডেকে দেয়। বাবলির দেওয়া ওই চাবির ব্যাগের মধ্যেই আমার গাড়ির চাবিটাও রয়েছে। আমার গাড়িও তো কোম্পানির নামেই কেনা তাই কাগজপত্রের কোনও সমস্যা হবে না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৪: দশরথপুত্র ভরত, এক ব্যতিক্রমী চরিত্র, বর্তমানের নিরিখে এক বিরলতম প্রজাতি

মুলো খেতে আপত্তি নেই, তা হলে তার পাতার কী দোষ করল? এই শাকের কত পুষ্টিগুণ জানেন?

কলকাতায় সেদিন যেন বড্ড তাড়াতাড়ি রাত নেমে এল। সুরঙ্গমা অবিরল জলে ভরে যাওয়া ঝাপসা চোখে তাঁর ঘরের জানলা থেকে দেখলেন। বসুন্ধরা ভিলার সব থেকে দুর্বিনীত কলঙ্কিত চরিত্র প্রণয়কান্তি মাথা উঁচু করে তার স্ত্রী বাবলিকে নিয়ে ড্রাইভওয়ে দিয়ে গেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। দু’জনের হাতেই দুটো ট্রলি ব্যাগ। সিকিউরিটির লোক ছুটে এসে ব্যাগ নিতে গেলে প্রণয় বাধা দিল। মেনগেট খুলে তারা হলুদ ট্যাক্সিকে ভিতরে ঢোকাতে গেলে তাতেও বাধা দিল প্রণয়। গেট টপকে বোধহয় শেষ বারের মতো একবার বসুন্ধরা ভিলার দিকে ফিরে তাকালো প্রণয়কান্তি আর বাবলি। তারপর ওরা ট্যাক্সিতে উঠে বসল। —চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।/strong>
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content