বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

ত্রিপুরার রাজা এবং রাজপরিবারের লোকেরা নিজেরাও সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করেছেন। পঞ্চদশ শতকে মহারাজা ধর্ম মাণিক্য ‘রাজমালা’ রচনা করান। বলা যায়, এর মাধ্যমেই ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাদের সাহিত্য পৃষ্ঠপোষকতার সূচনা ঘটে। ত্রিপুরায় সঙ্গীত চর্চার প্রসারে পরবর্তী রাজা ধন্য মাণিক্য মিথিলা থেকে রাজ্যে কয়েকজন সঙ্গীতজ্ঞ আনিয়েছিলেন। এই ভাবে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মাণিক্য রাজাদের সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার কথা ছড়িয়ে আছে ইতিহাসে।

পূর্বতন রাজাদের মতো বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যও সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই প্রকাশিত হয় ‘শ্রীরাজমালা’। তিনি পৃথক ভাবে ‘রাজমালা’ সংক্রান্ত গবেষণা ও প্রকাশনা কার্যালয় স্হাপন করেছিলেন। ‘রবি’ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশেও রাজা পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বীরবিক্রম একজন কবি ও নাট্যকার ছিলেন। অবশ্য তাঁর সাহিত্য বিষয়ক তৎপরতা মূলত রাজপরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি হোলি বিষয়ক একটি সঙ্গীত গ্রন্হ রচনা করেছিলেন। উল্লেখ করা যায় যে,রাজ আমলে ত্রিপুরায় হোলি ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব।এই উৎসবে রাজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল।
১৯৪১ সালে বীরবিক্রমের হোলি বিষয়ক সঙ্গীত গ্রন্হ ‘হোলি’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু গ্রন্হটি প্রকাশিত হয় ফাগুয়া সংঘের নামে। এ সম্পর্কে রাজার ব্যক্তিগত সচিব দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত লিখেছেন—” হোলী গ্রন্হটি বাহির হইল ১৯৪১ সালে। লেখক ছদ্মনামে লিখিত হইয়া ফাগুয়া সংঘ কর্তৃক প্রকাশিত হইল।আগের বছর হইতেই মহারাজ বীরবিক্রম এই বইয়ের জন্য ডায়েরিতে গান লিখিয়া রাখিতেছেন।…”
বীরবিক্রমের লেখা একটি হোলি গানের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে—
“… এমন সুন্দর হোলির দিনে,
রসিক নাগর শ্যাম বিনে,
খেলিব ফাগ কাহার সনে,
আমার খেলাত হল না খেলা।”


রাজা সাহিত্য সংস্কৃতির অকৃপণ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে অনেক গুণী শিল্পী আগরতলায় রাজদরবারে এসেছেন। কিন্তু রাজা ছিলেন প্রচার বিমুখ। তাঁর সাহিত্য সংস্কৃতির তৎপরতা প্রাসাদ পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাজার লেখা গানগুলোর রসাস্বাদন করে পরবর্তীকালের সঙ্গীত রসিকরা অবাক হয়ে গেছেন গীতিকার হিসেবে রাজার প্রতিভা দেখে।তিনি ব্রজবুলিতে হোলির গান লিখেছেন—
“আজু হেরি এ নব প্রেম চমক আওয়ে।
গোপ নারী সঙ্গ হোরী খেলন যাওয়ে।।
পর নারী সঙ্গ প্রেমসে করত রঙ্গ,
রসে রসিক নাগর কো সরমন আওয়ে।।…”
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে

কাব্য ও সঙ্গীত রচনার পাশাপাশি গদ্য রচনাতেও বীরবিক্রমের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। হোলি উৎসবের প্রাচীনত্ব ও উৎস নিয়ে তিনি ‘হোলী’ গ্রন্হের অবতরণিকা অংশে পাণ্ডিত্য পূর্ণ আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন—” যখন দারুণ শীত অবসানে নীরস পল্লববিহীন তরু আবার সরস নব পল্লবে নবীন হইয়া উঠে,যখন কাননে বাগানে ফুল আবার জগতকে সুশোভিত ও সুবাসে আমোদিত করিয়া তোলে,যখন আবার কোকিল পঞ্চমে গান গায়,যখন আবার পবন মন্দ গতিতে বহিতে থাকে—যে পবন শত কুসুম-হৃদয়-বিদারিত সুগন্ধ নিজ বক্ষে বহন করে এবং যেন প্রেমিকার দেহে মৃদু আঘাতে দেশান্তরে অবস্হিত প্রেমিকের বারতা প্রেমিকার কাছে আনে ও নিদারুণ বিরহ বেদনা আবার বিরহীর প্রাণে আনয়ন করে তবুও হয়ত অনেকে বিরহ অন্তে প্রিয়ার সঙ্গে মিলনের আশা রাখে বসন্তে-সেই মধু ঋতুতে, ফাগুনের চন্দ্রমাস অবসানে বিকলাঙ্গ চন্দ্র যখন পূর্ণ চন্দ্রে পরিণত হয়—সেই দোল পূর্ণিমাতে হোলী।” এই কয়েকটি লাইন থেকেই মহারাজা বীরবিক্রমের গদ্য সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৬: যদি হই চোরকাঁটা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ

হোলি উৎসবের উৎপত্তি সংশ্লিষ্ট কিংবদন্তী বিষয়ে বীরবিক্রম এই অবতরণিকায় লিখেছেন—”হোলী উৎসবটি অতি প্রাচীন। এই চিত্ত বিনোদনকারী মহা মিলনোৎসব সম্বন্ধে সহস্রাধিক বৎসর পূর্বে বাৎস্যায়ন তাঁহার ‘কামসূত্রে’ উল্লেখ করিয়াছেন। কিম্বদন্তী আছে যে একদা অসুররাজ হিরণ্যকশিপুর ভগ্নী হোলীকা কৃষ্ণভক্ত প্রহ্লাদকে বিনাশ করিবার উদ্দেশ্যে হঠাৎ বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ করিয়া অগ্নিতে ঝম্প প্রদান করে। প্রজ্জ্বলিত হুতাশন হোলীকা এবং প্রহ্লাদকে ত্বরায় আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। ইহাতে হিরণ্যকশিপু যদিও ভগ্নীর অনিবার্য্য মৃত্যুর আশঙ্কায় দুঃখিত হইলেন তবুও প্রহ্লাদের অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের আশায় ততোধিক উৎফুল্ল হইয়া উঠিলেন। অগ্নি প্রহ্লাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করিল না। কিন্তু সেই দাবানলে হোলীকার ধ্বংস হইল।এই হোলীকার নামানুসারে ‘হোলী’ এবং নরনারীগণ পুণ্যের দ্বারা পাপের পরাজয়ের এই অবিনশ্বর স্মৃতি যুগে যুগে হোলী উৎসব দ্বারা অনুষ্ঠান করিয়া আসিতেছে।”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৫: বিরোধিতায় নয়, মৈত্রীবন্ধনেই রয়েছে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসূত্র

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়

বীরবিক্রমের সাহিত্য প্রতিভার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় উপরোক্ত রচনায়। প্রত্যন্ত এক পার্বত্য রাজ্যের রাজা ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরে ডুব দিয়ে তুলে ধরেন ভারতের উৎসব ঐতিহ্যকে।
রাজার সোনামুড়া ও উদয়পুর ভ্রমণের বিবরণীতে রয়েছে তাঁর গদ্যের আরও নিদর্শন। ‘আমার সোনামুড়া ও উদয়পুর বিভাগ পরিভ্রমণ’ নামে রাজার ডায়েরী গ্রন্হ হিসেবে প্রকাশিত হয়।রাজা লিখেছেন—”…আজ সকাল ৯টায় গোবিন্দ মাণিক্যের রাজবাড়ি দেখিতে যাই। রাজবাড়িটি একটি উচ্চ পাহাড়ে অবস্হিত, ইহার পশ্চিম দিকে গোমতী প্রবাহিত এবং অন্যদিকে খাল। ইচ্ছা করলেই গোমতীর জলে খালটি পূর্ণ করা যায়। অতএব এই রাজবাড়িতে শত্রু প্রবেশ করিতে সহজে পারে না। উদয়পুরের পুরাণ দালানের মধ্যে এই রাজবাড়িটি সকলের চেয়ে বড়।ইহার বর্তমান অবস্থা একেবারে খারাপ হয় নাই।এই রাজবাড়িটিকে রক্ষা করা উচিত মনে করি।…”

নতুন ভাবে ‘রাজমালা’র প্রকাশও বীরবিক্রমের এক উল্লেখযোগ্য কাজ। সে যুগের বিশিষ্ট পণ্ডিত তথা পদস্থ রাজকর্মচারী কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ ‘রাজমালা’র সম্পাদনা করেছিলেন যা ‘শ্রীরাজমালা’ নামে তিনটি লহরে প্রকাশিত হয় রাজার উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায়। বীরবিক্রম রাজমালা বিভাগকে পুনর্গঠন করেন। সে জন্য পৃথক অফিস করা হয়। ত্রিপুরার অতীত ইতিহাস পুনরুদ্ধার, প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে রাজা আন্তরিক প্রয়াসী ছিলেন।

ত্রৈমাসিক ‘রবি’ এবং মাসিক সাময়িকী ‘জাগরণ’ প্রকাশনার ব্যাপারেও রাজা খুব উৎসাহী ছিলেন। ১৯৪১ সালে ‘রাজমালা’ কার্য্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল কালীপ্রসন্ন সেনগুপ্তের ‘পঞ্চ-মাণিক্য’। এই গ্রন্হটিও মহারাজা বীরবিক্রমের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

রাজার লেখা সংগীত ও গদ্য সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।রাজা কিন্তু নাটকও লিখেছেন।তাঁর লেখা ঐতিহাসিক নাটক ‘জয়াবতী’ রাজধানীতে মঞ্চস্হ হয়েছিল। তদানীন্তন সময়ে রাজার লেখা নাটকটি দর্শক ও সাহিত্য সমালোচকদের উচ্চ প্রশংসা লাভ করে।রাজা যেমন গান লিখতেন, সাহিত্য চর্চা করতেন,তেমনই এ সব ক্ষেত্রে ছিল তাঁর এক ধারাবাহিক পৃষ্ঠপোষকতা। তাঁর রাজত্বকালে অনেক গুণী শিল্পী আগরতলায় এসেছেন। এনায়েত খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, মজফর খাঁ, মুন্না খাঁ প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায় এ ক্ষেত্রে। মণিপুরী নৃত্যের অঙ্গনেও ত্রিপুরার খ্যাতি লাভ ঘটে তখন। মণিপুরী নৃত্যের তালিম দেওয়ার জন্য ঠাকুর নবকুমার সিংহকে তখন আগরতলা থেকে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়েছিল। পিতা বীরেন্দ্র কিশোরের মতো চিত্রকলাতেও গভীর আগ্রহ ছিল বীরবিক্রমের। তবে সব কিছুকে যেন ছাপিয়ে যায় রাজার সাহিত্য প্রতিভা।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content