বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


রাজা বীরচন্দ্র ।

কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের (১৮২৯-৪৯ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল রাজধানী স্থানান্তর। তিনি পুরাণ হাবেলী বা পুরাণ আগরতলা থেকে রাজধানী সরিয়ে এনেছিলেন বর্তমান আগরতলায়। কৃষ্ণকিশোর সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে বাংলায় সমগ্র রাজমালাকে সংশোধিত ও পরিবর্তিত করে সংকলন করেছিলেন দুর্গামণি উজির।

এ বার আসা যাক বীরচন্দ্র মাণিক্যের (১৮৬২-৯৬ খ্রিস্টাব্দ) কথায়। ত্রিপুরার এই রাজাই প্রথম কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কবির ‘ভগ্ন হৃদয়’ কাব্য গ্ৰন্থ পাঠ করে রাজা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক ভুবনজয়ী সম্ভাবনা লক্ষ্য করেছিলেন। তারপরই কিশোর কবিকে সম্বর্ধনা জানাতে রাজা তাঁর সচিবকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। এই ভাবেই ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের। চার জন মাণিক্য রাজার রাজত্বকালের দীর্ঘ সময়ব্যাপী অটুট ছিল এই সম্পর্ক। বীরচন্দ্র সাহিত্য-সংস্কৃতির একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি রাজপরিবারের সদস্যদের সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ জুগিয়ে গিয়েছেন। রাজা নিজেও ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি। তাঁর রচিত ছয়টি কাব্যগ্ৰন্হের কথা জানা যায়। এই গ্রন্থ সমূহ হচ্ছে ‘হোরি’, ‘ঝুলন গীতি’, ‘প্রেম মরিচীকা’, ‘উচ্ছ্বাস’, ‘অকাল কুসুম’ এবং ‘সোহাগ’। বীরচন্দ্রের কাব্য সমূহ সেদিন পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
ত্রিপুরার রাজপরিবারে হোলি উৎসবের এক বিশেষ ঐতিহ্য ছিল। এক সময় রাজপুরির হোলি উৎসবে ইংরেজ সাহেবরাও অংশ গ্রহণ করেছেন। বীরচন্দ্রের রাজত্বকালে হোলি উৎসব আরও মাধুর্যময় হয়ে উঠেছিল। বৈষ্ণব ভাবাপন্ন কবি ও সুগায়ক রাজা নিজেই হোলি উৎসবের দিনে মাতোয়ারা হয়ে স্বরচিত গান গাইতেন। বীরচন্দ্রের ‘হোরি’ কাব্যগ্ৰন্থটি এ রকম ৩৪টি গানের সংকলন। বৈষ্ণব ভাবাপন্ন কবির ভক্তিভাব, রসবোধ, পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব ইত্যাদি কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন রাধার রূপ বর্ণনায় রয়েছে—
“সমান ষোড়শী সমান রূপসী
নবীন মালা সঙ্গিনী সঙ্গে
অঙ্গের আভরণ কাঁচলী বন্ধন
সমান সমান বেণী ঝুলিছে অঙ্গে।”
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৩: রাজসভায় মিথিলার সঙ্গীতজ্ঞ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

বীরচন্দ্র শ্রীমদ্ভাগবত গ্ৰন্থ প্রকাশনার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্ৰন্থটি প্রকাশেও মহারাজা অর্থ সাহায্য করেছিলেন। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত এই সুবিখ্যাত গ্ৰন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় শ্রীসেন বলেছিলেন—“…পরিশেষে গভীর কৃতজ্ঞতার সহিত জানাইতেছি, ত্রিপুরার শ্রীশ্রীমন্মহরাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য দেববর্ম্মণ বাহাদুর আমার পুস্তকের এই খন্ডের সমস্ত মুদ্রাঙ্কন ব্যয় বহন করিয়াছেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁহার দানশীলতা বঙ্গদেশ-প্রসিদ্ধ। আমার এই সামান্য পুস্তক তাঁহার পবিত্র নামের সঙ্গে সংগ্রথিত করিতে পারিয়া কৃতার্থ হইয়াছি…”। ১৯০১ সালে ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্হের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তখন বীরচন্দ্র প্রয়াত। দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র লিখেছিলেন—“… উপসংহারকালে আমি ত্রিপুরেশ্বর স্বর্গীয় মাণিক্য বাহাদুরের মৃত্যুতে গভীর পরিতাপ প্রকাশ করিতেছি। তিনি এই পুস্তকের প্রথম সংস্করণের ব্যয়ভার বহন করেছিলেন,…তাঁহার মৃত্যুশয্যার এক প্রান্তে আমার এইসামান্য পুস্তকখানি পরিদৃষ্ট হইয়াছিল..।”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের প্রতি বীরচন্দ্রের কতটা অনুরাগ ছিল উপরোক্ত লেখা থেকেই তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রকর-বীরচন্দ্র ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু সব কিছুকে যেন ছাপিয়ে যায় তাঁর সাহিত্য পৃষ্ঠপোষকতার গুণ। তিনি যেমন রবীন্দ্রনাথকে তাঁর কৈশোরকালেই আবিষ্কার করেছিলেন, তেমনই রবীন্দ্রনাথও তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আর নিঃসন্দেহে এই আকর্ষণের মূলে ছিল বীরচন্দ্রের সাহিত্য প্রীতি।

বীরচন্দ্রের পর সিংহাসনে বসেন রাধাকিশোর মাণিক্য (১৮৯৬-১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ)। পিতার মতো তিনিও ছিলেন গভীর সাহিত্যানুরাগী, পৃষ্ঠপোষক। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রাধাকিশোরের পৃষ্ঠপোষকতায় পণ্ডিত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ প্রকাশ করেছিলেন ‘শিলালিপি সংগ্ৰহ’। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু-সহ বাংলার তদানীন্তন অনেক সাহিত্য সেবীকে রাজা আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—দীনেশচন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। রাধা কিশোরের আমলে সরকারি মুখপত্র রূপে প্রকাশিত হয় ‘ত্রিপুরা স্টেট গেজেট’।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

বাংলাতে স্টেট গেজেট প্রকাশ রাধাকিশোরের এক উল্লেখযোগ্য কীর্তি। ১৯০২ সালে প্রথম বাংলা ত্রৈমাসিক হিসেবে স্টেট গেজেট বের হয়। পরের বছর তা মাসিক মুখপত্রে রূপান্তরিত হয়। গোবিন্দ মাণিক্যের আদেশে রচিত ‘বৃহন্নারদীয় পুরাণ’ পুঁথিটি রাধাকিশোরের পৃষ্ঠপোষকতায় মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সূত্রে মহারাজা রাধাকিশোর বঙ্গদেশের তদানীন্তন গুণীজনদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। ১৯০১ সালে কলকাতায় ভারত সঙ্গীত সমাজের পক্ষে রাধাকিশোরকে সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল।

পূর্ব পুরুষদের মতো মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্যও (১৯০৯-২০ খ্রিস্টাব্দ) শিল্প-সংস্কৃতির পূজারী ছিলেন। তাঁর আমলেও বাংলা ভাষা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। তদানীন্তন মন্ত্রী বাহাদুর মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্র কিশোর অফিস আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার সম্পর্কে এক সার্কুলারে জানান—“এ রাজ্যের অফিস ও আদালত সমূহের প্রচলিত ভাষা বাঙ্গালা এবং সর্ব্ববিধ রাজকার্যে আবহমানকাল হইতে বাঙ্গালা ভাষা ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। এই নিয়ম অক্ষুন্ন রাখা স্বর্গীয় মহারাজ বাহাদুরগণের অভিপ্রেত ছিল।…” বৈষ্ণব সাহিত্যের কিছু দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি পুনরায় সম্পাদনা করে প্রকাশের জন্য রাজা কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ‘রাজমালা’ পুনরায় সম্পাদনা করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বীরেন্দ্র কিশোর একজন গুণী চিত্রকর এবং গীতিকার ছিলেন। রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক বেশ কিছু সংগীত তিনি রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

পূর্বতন রাজাদের মতো বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যও (১৯২৩-৪৭ খ্রিস্টাব্দ) সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই প্রকাশিত হয় ‘শ্রীরাজমালা’। তিনি পৃথক ভাবে ‘রাজমালা’ সংক্রান্ত গবেষণা ও প্রকাশনা কার্যালয় স্হাপন করেছিলেন। ‘রবি’ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশেও রাজা পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বীরবিক্রম একজন কবি ও নাট্যকার ছিলেন। অবশ্য তাঁর সাহিত্য বিষয়ক তৎপরতা মূলত রাজপরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি হোলি বিষয়ক একটি সংগীত গ্ৰন্হ রচনা করেছিলেন। ১৯৪১ সালে তা প্রকাশিত হয়। বীরবিক্রম রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারতভাস্কর’ উপাধি দিয়েছিলেন।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content