সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

“নাসিরুদ্দিন তার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের দেখা পেয়ে ভারী খুশি। বললে, বন্ধু, চলো পাড়া বেড়িয়ে আসি।

লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার এই মামুলি পোশাক চলবে না, বললে জামাল সাহেব। নাসিরুদ্দিন তাকে একটি বাহারের পোশাক ধার দিলে।

প্রথম বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন গৃহকর্তাকে বললে, ইনি হলেন আমার বিশিষ্ট বন্ধু জামাল সাহেব। এঁর পোশাটা আসলে আমার।

দেখা সেরে বাইরে বেরিয়ে এসে জামাল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমার কেমনতরো আক্কেল হে! পোশাকটা যে তোমার সেটা কি না বললেই চলত না?

পরের বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, জামাল সাহেব আমার পুরনো বন্ধু। ইনি যে পোশাকটা পরেছেন সেটা কিন্তু ওঁর নিজেরই।

জামাল সাহেব আবার খাপ্পা। বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, মিথ্যে কথাটা কে বলতে বলেছিল তোমায়?

কেন? বললে নাসিরুদ্দিন, তুমি যেমন চাইলে তেমনই তো বললাম।

না, বললেন জামালসাহেব, পোশাকের কথাটা না বললেই ভালো।

তিন নম্বর বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, আমার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি যে পোশাটা পরেছেন সেটার কথা অবিশ্যি না বলাই ভাল।”

নমস্কার। আমি নাসিরুদ্দিন নই। হতেও চাই না মশাই।
আমার কাজকর্ম দেখে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। ভাবতে পারেন, এত ক্যাবলা মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে বাড়ি চিনে ফেরে কী করে? আজ্ঞে, আমিও যে তেমন করি না সেটা জোর দিয়ে বলতে পারি না। শুনেছি, নামজাদা লোকজন অঙ্ক কষে কষে বাড়ির বাড়ির ঠিকানা ভোলে, দিব্যি অন্যের বাড়ি সেঁধিয়ে জাঁকিয়ে বসে জলখাবার আনার হুকুম দেয়। একটু বাজার করে আসি বলে, কতো লোক যে আর বাড়ি ফেরে না তার হিসেব রাখেন? আমার ক্যাবলামি বয়সের সঙ্গে ত্রৈরাশিক আর দ্বিঘাতের সমীকরণের ব্যস্তনুপাতিক হারে সাড়ে চার শতাংশ সুদে বাড়ছে। হিসেব চাইবেন না মশাই। আমার ঠাকুরদাদার বাবার বয়স এখন দুশো ঊনপঞ্চাশ দশমিক সাড়ে সতেরো পোয়া। আমার বয়স অনেক বেড়ে কমে এখন সাতে ঠেকেছে। বাবার মতো হতে ইচ্ছে করে ভাবছেন? মোটেই না। নিজের মতো হতেই ইচ্ছে করে না মশাই। আপনি বাঁচলে বাপের নাম নাকি। আমার এই ‘আপনি’ যে কতো তার হিসেব আমার আর ঠাহর হয় না যে। যখন ছোট ছিলাম তখন এক, যখন বড় হলাম তখন আরেক, যখন আবার ছোট হয়ে বনসাই হলাম তখন আরেক। কোনটা নেব কোনটা ছাড়ব তা ঠিক করা আমার সাধ্যির বাইরে। দাঁড়ান, দাঁড়ান, কী বলছেন? আমাকে চেনা লাগছে? নাম কি আমার? এই রে! আমিও এখুনিই এটাই বলব ভাবছিলাম। জানেন কি, আমার নাম কি? আমার মনে পড়ছে না যে!

আসলে, মানে সব-ই ‘আসল’, কিন্তু তার মধ্যে যেটা আরও সরেস, সেটা হল, রাস্তায় বেরোলেই সব লোককেই আমার খুব চেনা মনে হয়, কেন বলুন তো! এই যেমন আমাকে এখন আপনার চেনা মনে হচ্ছে।

একদিন কী হয়েছে… কি হয়েছিল বলুন তো? কী বলছেন, আপনি জানবেন কি করে? তো তার আমি কি জানি। আপনার ব্যাপার আপনার। আমার ব্যাপার আমার। কেনাকাটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, দেখাশোনাও। আমি শুধু দেখাতে পারি, বলতে পারি, আপনার নাম আমি জানবো কী করে, আশ্চর্য!

কি বলছেন? আপনি নাম জানতে চাইলেন কখন? এইতো। এইমাত্র চেয়েছেন। আমি কি আপনার মতো ক্যাবলা নাকি যে….

ও দাদা! ও দাদা! দাঁড়ান, প্লিজ। আচ্ছা, দাঁড়াতে হবে না। বসুন। ওই তো ইটের পাঁজাটা আছে। ওতেই বসুন। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও বসছি। আরে কেউ কিচ্ছু বলবে না। বসুন তো।

তো হ্যাঁ দাদা, আমার নামটা বলতে পারবেন? আচ্ছা আচ্ছা, থাক বাদ দিন। যা বলছিলাম, যখন ছোট ছিলাম বুঝলেন, তখন এমন ছোট ছিলাম না। তখন একে একে তিন করতাম, বাবা কষে চড়িয়ে আবার অঙ্ক কষাতেন। এখন এমন ছোট হয়েছি যে, একে একে এগারো করি। তারপর সেটা ভাগ করে সাড়ে পাঁচ, তার থেকে অর্ধেক বাদ দিয়ে যা থাকে তাকে ভেঙে আড়াই খানা বাদ দিয়ে দিই। তারপর, ওই আড়াই নিয়ে… যাক গে, ছোটবেলায় বাবার মতো বড় হবো এমন আশা থাকে বটে, তবে বড় হয়ে আমরা দাদা হই বুঝলেন ভাইটি। কী? আপনাকে “দাদা” বলেছি? তো কী… এখন আমিই দাদা। বেশি ঝামেলা করলে কানের গোড়ায় এমন দেবো দুটো…কানপুর কেন, কানাডা কী কানসাস কিংবা কানহাইয়াপুরম্ গেলেও সে কান খুঁজে পাবেন না, খুঁজে পাবেন না কাকটাকেও, সে ক্রোয়েশিয়া যান কী কাউয়ার চর… কী বলছেন? বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে? তো সে আপনার বাড়ি, আপনি বুঝবেন। আমার বাড়ি নিয়ে আপনার কীসের মাথাব্যথা? কী? পাগল আপনি, আমার পা গোল হবে কেন, দিব্যি লম্বা লম্বা, টেনে দৌড় দিলে আমার সঙ্গে পারবেন না দাদা এই বলে দিলাম।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৭: আমি শুধুই উদাস, জলজ্যান্ত লাশ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৩: নহবতবাড়ির ‘এতটুকু বাসা’

দাদা বলছি কেন? তো আঙ্কল বললে খুশি হবেন, নাকি কাকা বলবো। আরে রাগ করেন কেন মশাই, নামে কী আসে যায়, আপনার নাম….কী যেন? যাঃ, সেটাই তো জানা হয়নি, তকাই বলেই ডাকছি। তো তকাইবাবু, আপনি কোন ক্লাসে পড়েন… আহা, চটেন কেন, আপনি তকাই নন? আপনার বাবা তাহলে তকাই। কি? আপনার বাবাকে বলে দেবেন, আপনি কী বলবেন মশাই, আমি আপনার গার্জেন কল করলাম। এই এখন দুটো বেজে দু’মিনিট ষাট সেকেন্ড… এর পর আপনি বাবা না আনলে ডাবল গার্জেন কল। তখন… আরে না না রামো…কে আপনার ঠাকুরদাকে খুঁজতে গেছে…. বাবার সঙ্গে আপনি, আপনার সঙ্গে বাবা আসবেন, ব্যস, সিম্পল। পিতা পুত্রেন সহ গচ্ছতি।

কি বলছেন? রাঁচির টিকিট সস্তা? তো কিনুন না, যতগুলো ইচ্ছা কিনুন। সবান্ধবে ঘুরে আসুন। দেখুন মশাই, আমি এখন রাঁচি যেতে পারবো না। এখানে আমার বিস্তর কাজ যে! না না না, আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না… কী যেন… ও, মিস্টার… মিস্টার কিমার! সে আমাকে কিমা করুন, মারুন বা রাখুন। আমাকে মরা হাতি দিলেও রাঁচি যাবো না।

কি বলছেন? আমাকে এভাবে বাইরে ছেড়ে রাখা ঠিক নয়? এই ব্যাটা! কে আমাকে বাঁধবে রে! খামচে নিয়ে তোর নাক নাগাসাকি তে পাঠিয়ে দেবো রে উল্লুক! রাঁচির যদি দরকার পড়ে তো রাঁচি আমার কাছে আসবে, আমি যাবো কেন?

এই, আসুন তো, অনেক সময় আপনাকে দিয়েছি, দু’মিনিট বলে বসালেন, তারপর আর ছাড়ার নাম নেই! কি? আমি এই পাঁজাতে আপনাকে বসিয়েছি? আমার তো তা মনে হয় না। আপনি নিজে বসেছেন, মাথা আপনার, শরীর আপনার, হাত-পা এমনকী… যাক, সব আপনার, তো আমি কী করে বসাই?
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৮: চোখিধানির জগৎখানি

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪২: গুণমুগ্ধ দিলীপ কুমার তাঁর ছবিতে বিনা পরিশ্রমিকেই অভিনয় প্রস্তাব দিয়েছিলেন

তার চেয়ে একটা গল্প শুনুন। আরে শুনুন না। বেতালের মতো কোয়েশ্চন-আনসার সেশন করব না। আপনার মাথা ফাটানোর ইচ্ছা আমার নেই। থাকলে সেই কখন গাঁট্টা দিয়ে… যাকগে.. এক রাজা ছিল। তার অনেক রানি ছিল। তারপর সেই রাজা একটা হরিণ তাড়া করে ধরতে পারল না। তারপর সেই দুঃখে একটা হরিণী ধরল। তার নাম শকুন্তলা। রামচন্দ্রের কাছে হরিণ ধরা দেয়নি। সে ছিল মায়া হরিণ। এদিকে সেই রাজার সোনার হরিণ চাই। তো হরিণী ধরা দিল। তারপর কী হল, রাজা বলল, কী মুশকিল! এসব হরিণ-টরিণ আমি ধরিনি। গেট লস্ট। তারপর আবার রাজার মনে পড়ল ধরিণ ধরার কথা। সেই রাজা তখন বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে লাগল। তো এই রাজা সাগর-টাগর নিয়ে পুরো পৃথিবীর ফুলটাইমার স্টাফ ছিল। স্বর্গে তখন পার্টটাইম করতো। একদিন স্বর্গে গিয়ে… কী বলছেন? শুনবেন না! শুনতে হবে না।

জেনে রাখুন এই গপ্পো যে লিখেছে সে নিজের বসা ডালেই কুড়ুল দিত। আজ্ঞে হ্যাঁ, নইলে আর বলে, রতনে রতন চেনে। আগে নিজে চেপে বসতে শেখো, তারপর না হয় কোথাকার কোন পাগলা হরিদাস পালকে রামগিরি না যদুগিরি কোথায় যেন নির্বাসন দেবে। হুঁ। পাগল কি আর গাছে ফলে! কোথায় খাবে দাবে দিব্যি টাকডুমাডুম আখের গোছাবে তা নয়, নাকের জল, চোখের জল, জিভের জল, ঘেমে নেয়ে জল সব এক করে দিচ্ছে। ছোঃ ছোঃ। আরে ও দাদা, ভাই রে, কী হল, কী বলছো? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি দায়ী? ধুর ব্যাটা! ওসব চালাকি চলছে না আমার কাছে… আমি হলাম… কী নাম যেন আমার?
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১২: স্বপ্নাদেশের দেবী ভবানী

যত মত, তত পথ, পর্ব-৬: ঈশ্বরলাভ ক’রে / শুদ্ধাভক্তি লাভ ক’রে সংসারে থাকা—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

কী মুশকিল, কোনটা যে আমার আর কোনটা যে বাবার সে আর মনে থাকে না, আমরা তো আর সকলেই “তকাই” নই তোমাদের মতো। প্লিজ আণ্ডারস্ট্যাণ্ড…. ওয়ানস আপন এ টাইম… ওকী! কানে আঙুল দিচ্ছো কেন? ওরে, আমার চেয়ে আপন আর পাবি না ভাইটি। এই কথা আমায় বলেছিল মঙলাহাটির শ্যামাদাস, বলেছিল, “ওহে কেবলরাম বাটপাড়িয়া, শোনো তোমায় এক কথা বলি”…. আরে অ্যাই, পালাস ক্যানো? আরে এটা আমার নাম নয়, বোস, বোস বলছি। নইলে মেরে না তোর… আচ্ছা, জল খাবি বলছিস? আমাকে কি বিশুর হোটেল পেয়েছিস, যে গিয়ে বসলেই দু’গ্লাস জল ভোগ চড়িয়ে যাবে। এতো ক্যাবলা ক্যানো? পৃথিবীর তিন ভাগ-ই তো জল, যেমন খুশি খাও না দাদা, আমাকে জ্বালানো কেন। আমি এবার উঠবো। আর সময় দিতে পারবো না বাপু।

তো, আপনার নামটা তো জানা হলো না মশাই! দিনকাল ভালো নয়। চারদিকে টকটক গন্ধ আর গুমোট। নাম কি বলছেন? নাসিরুদ্দিন? বললেই হল আর কী! আম আর আমড়ায় এক হয় নাকি! নাসিরুদ্দিনকে আমি চিনি না বুঝি, এই তো গতকাল দুটো সরেস জলপাই দিয়ে গেল। আর তুমি বলছো তুমি নাকি নাসিরুদ্দিন। তার চেয়ে বলো না তোমার তকাই নামটা পছন্দ নয়। একটা এফিডেবিট করো, আর ব্যাস হয়ে যাও যা হতে চাও। কী হবে বলো। আচ্ছা, তুমিই তবে কেবলরাম বাটপাড়িয়া। এবার বুঝেছি কেন এতো কিন্তু কিন্তু ভাব তোমার। তোমার তো জেলে থাকার কথা হে। এখানে কী করছো। দাঁড়াও তোমার মজা দেখাচ্ছি। ও কী! অমন কাঁপছো কেন তালপাতার মতো। মৃগী আছে নাকি? ওই মরবি নাকি? তাহলে দাঁড়া দাঁড়া। আমাকে আগে যেতে দে। নইলে ঐ দূরের বাদাবনটা দেখছিস, হ্যাঁ ওখানে চলে যা। আরে অ্যাই ক্যাবলা, যাচ্ছিস কোথায়? যাবার আগে আমার নামটা বলে যা বাপু! লক্ষ্মী ভাইটি! অমন করে না!! —চলবে।

ঋণ স্বীকার:
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প: সত্যজিৎ রায়
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content