শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ইতালিতে চলে যাবার আগে ১৪ বছর বয়সে আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৯৩ )।

ছেলেবেলা থেকে আমরা প্রায় সকলেই এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি যে ঘুমে সময় নষ্ট। যত বেশি সময় ঘুমের পেছনে দেবে তত বেশি সময় জীবন চুরি করে নেবে তোমার থেকে, তোমার লক্ষ্যপূরণের সময় থেকে বিয়োজন ঘটে যাবে একটা বড় সময়ের। কিন্তু জানো কি সময়ও যাঁর কাছে জব্দ হত, নিয়মের নতুন সূত্র যাঁর হাতের মুঠোয় থাকত সেই জগৎ বিখ্যাত মানুষটি নিজেই ঘুমোতেন দিনে প্রায় দশ ঘণ্টার মতো? ঘুমের মধ্যেই নাকি এই বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন আপেক্ষিকতাবাদের সূত্র। হ্যাঁ, একদম ঠিক ধরেছ, আমরা কথা বলছি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে নিয়ে। কেবল ঘুম নয়, এছাড়াও আরও অনেক বিচিত্র অভ্যাসের মালিক ছিলেন এই আপনভোলা মানুষটি। সেসব গল্প পরে হবে, কিন্তু তার আগে জানতে হবে তার জগৎ-মাতানো বৈজ্ঞানিক কীর্তি সম্পর্কিত কিছু কথা।

১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির উলম উরটেমবার্গ শহরে জন্ম বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর। তাঁর পিতা ছিলেন একটি তড়িৎ রাসায়নিক কারখানার কর্মকর্তা। ১৮৯৫ সালে তিনি এবং তাঁর পরিবার সুইজারল্যান্ডে চলে যান এবং তার পরের বছরই জার্মানির নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। ১৯০০ সালে জ্যুরিখের ফেডারেল পলিটেকনিক স্কুল থেকে একাডেমিক শিক্ষা ডিপ্লোমা অর্জন করেন অ্যালবার্ট। জার্মানিতে আর কখনও ফেরা সম্ভবপর হয়নি তাঁর। ১৯৩৩ সালে তিনি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন সেবছরই জার্মানির ক্ষমতায় অ্যাডলফ হিটলার। জার্মান সাম্রাজ্য তখন অ্যাডলফ হিটলারের স্বৈরাচারী শাসনের ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত। নাৎসিবাহিনীর জাতীয়তাবাদী আগ্রাসনের কবলে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন তখন একাধিক ইহুদি জাতির মানুষজন, যাঁরা পারছেন তাঁরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। কেবলমাত্র ইহুদি হওয়ার কারণেই আইনস্টাইনের আর জার্মানিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। প্রাথমিকভাবে সংগ্রামের সঙ্গে জীবন আরম্ভ হলেও ১৯০২ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত বার্নের সুইজারল্যান্ডের পেটেন্ট অফিসে পেটেন্ট পরীক্ষক হিসেবে তিনি কাজ করার সুযোগ পান।

পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর যুগান্তকারী বিভিন্ন গবেষণাকার্য এবং আবিষ্কার সমৃদ্ধ করেছে আমাদের। পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান হল, আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব, যা বলবিজ্ঞান ও তড়িচ্চৌম্বকত্বকে একীভূত করেছিল এবং আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব, যা অসম গতির ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে একটি নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তার অন্যান্য অবদানের মধ্যে রয়েছে আপেক্ষিকতাভিত্তিক বিশ্বতত্ত্ব, কৈশিক ক্রিয়া, ক্রান্তিক উপলবৎ বর্ণময়তা, পরিসংখ্যানিক বলবিজ্ঞান ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান। কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে তিনি অণুর ব্রাউনীয় গতির যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এ ছাড়াও আণবিক ক্রান্তিকের সম্ভাব্যতা, এক-আণবিক গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব, নিম্ন বিকিরণ ঘনত্বে আলোর তাপীয় ধর্ম, একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্বের ধারণাও প্রথম তাঁর কাছ থেকেই আমরা পাই। ভবিষ্যৎ জীবনটুকু আমেরিকার নাগিরকত্ব গ্রহণ করে সেখানেই থেকে যান অ্যালবার্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে আগে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি রুজভেল্টকে জার্মান পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং আমেরিকাকেও একই ধরনের গবেষণা শুরুর তাগিদ দেন। তার এই চিঠির মাধ্যমেই ম্যানহাটন প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়। আইনস্টাইন মিত্রবাহিনীকে সমর্থন করলেও পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। পরে ব্রিটিশ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদের কথা তুলে ধরেন তিনি এবং রাসেল। রাসেল-আইনস্টাইন ইশতেহার রচনা করেন। ১৯৫৫ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

নিজ অফিসে আইনস্টাইন, বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২০)।

আইনস্টাইন তাঁর সারাজীবনে ৩০০টিরও অধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র এবং ১৫০টির বেশি বিজ্ঞান-বহির্ভূত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। ১৯৯৯ সালে টাইম সাময়িকী আইনস্টাইনকে ‘শতাব্দীর সেরা ব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করে। ইউজিন উইগনার তাঁকে তাঁর সমসাময়িকদের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন যে ‘জেনসি ভন নিউম্যানের চেয়ে আইনস্টাইনের বোধশক্তি আরও বেশি প্রখর ছিল। তার চিন্তাশক্তি নিউম্যানের চেয়ে অধিক ভেদ্য এবং বাস্তবিক ছিল।’

বিশ্বখ্যাত এই বৈজ্ঞানিক কিন্তু ছিলেন একাধিক অদ্ভুত সব অভ্যাসের অধিকারী। প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১০ ঘণ্টা ঘুমোতেন তিনি। ঘুমের মধ্যেই নাকি সমাধান কর ফেলতেন একের পর এক জটিল বৈজ্ঞানিক সমস্যার। স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন প্রিন্সটনে কাজ করার সময় প্রায় আড়াই কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতেন তিনি। বৈজ্ঞানিক হিসেবে তাঁকে সবাই চেনে কিন্তু কেউ জানে কি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন একজন অসম্ভব ভালো ভায়োলিন বাদক ছিলেন? ভায়োলিন বাজাতে যেমন ভালোবাসতেন তেমনই তাঁর বক্তব্য ছিল, ক্ল্যাসিকাল মিউজিক কর্টিসল হরমোনের মাত্রা কমিয়ে মনকে চাপমুক্ত রাখতে সাহায্য করে, তাই এই অভ্যাস তিনি জারি রেখেছেন আজীবন। স্প্যাগেটি খেতে দারুণ ভালোবাসতেন অ্যালবার্ট। কেবল ভালোলাগার জন্যই নয়, তাঁর মতে সারা শরীরের ২০ শতাংশ এনার্জি প্রয়োজন মস্তিষ্কের আর, স্প্যাগেটির কার্বোহাইড্রেট মস্তিষ্কের জন্য যথার্থ এনার্জির উৎস হিসাবে কাজ করতে পারে। সারাজীবন কখনও মোজা পরেননি, কারণ মোজা পরে নাকি তিনি আরামবোধ করতেন না। দয়ালু, নরম মনের এই মানুষটি জীবনের শেষের দিকে আমিষভোজন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর কারণস্বরূপ ১৯৫৩ সালে বন্ধু ম্যাক্স ক্যারিয়েলকে চিঠিতে লিখে জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখনই প্রাণীর মাংস খেতাম, ভিতরে ভিতরে একটা অপরাধবোধ জাগত।’

পৃথিবী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে চেনে তাঁর একগুচ্ছ অবিস্মরণীয় বৈজ্ঞানিক কীর্তির মাধ্যমে, কিন্তু মানুষের স্বভাবেই যে নিহিত থাকে তাঁর প্রতিভার সূত্র সেকথা আরও একবার প্রমাণিত হয়ে যায় এই মানুষটির জীবন ধারার দিকে একবার ভালোভাবে তাকালে। সৃষ্টির ইতিহাসে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে ততদিন তাঁর কীর্তি বেঁচে থাকবে তাঁর একাধিক অবিস্মরণীয় আবিষ্কারকার্যের মধ্যে দিয়ে, আর ততদিনই আমরা তাঁকে স্মরণ করব, মুগ্ধ, চমৎকৃত হব, মাথানত করব তাঁর অভাবনীয় মেধাশক্তির সামনে।

Skip to content