মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

 

কাকোলূকীযম্‌

বায়সরাজ মেঘবর্ণের কথা শুনে সচিবেরা সকলে বললেন, হে রাজন্‌! আপনি যথার্থই প্রশ্ন করেছেন। শাস্ত্রে বলে, কিছু কিছু পরিস্থিতি আসে যখন রাজা পরমর্শ না চাইলেও মন্ত্রীদের যেচে পরামর্শ দেওয়া উচিত। এমনকি সেই পরামর্শ রাজার পছন্দও হতে পারে আবার অপছন্দও হতে পারে। তাও অপ্রিয় সত্যি মন্ত্রীদের বলা উচিত নিজের স্বার্থে এবং রাজ্যের স্বার্থে। আবার রাজা পরামর্শ চাইলেও, কেবল রাজার বিরাগভাজন হবে বলে, যে মন্ত্রী সঠিক পরামর্শটা অপ্রিয় সত্যের মতো রাজাকে নিবেদন করেন না, সে মন্ত্রী আসলে রাজার প্রিয়বাদী শত্রু ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব হে রাজন্‌! এই জন্যই একান্তে সকলে মিলে আমাদের এখন পরামর্শ করা উচিত এবং ঠিক কী কারণে তারা আমাদের সঙ্গে এমন শত্রুতা করছে সেটাই প্রথমে বিচার করা প্রয়োজন। তবেই একমাত্র আমরা তাদেরকে নিগ্রহ করতে পারবো, সমস্যার সমাধান তখনই একমাত্র হবে।

রাজা সভামধ্যে মন্ত্রীদের থেকে মন্ত্রণা চাইলেও মন্ত্রণা যে গোপনে বা একান্তে করা প্রয়োজন সচিবেরা তা রাজাকে স্মরণে করিয়ে দিলেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বিনয়াধিকারের একাদশ প্রকরণে মন্ত্রাধিকার নিয়ে দীর্ঘ এক বর্ণনা আছে। সেখানে স্পষ্ট ভাষায় কৌটিল্য একজন শাসককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বলেছেন, যে কোনও কাজ করবার আগে মন্ত্রণা করা প্রয়োজন—মন্ত্রপূর্বাঃ সর্বারম্ভাঃ। আচার্য কৌটিল্যের পরামর্শ হল, মন্ত্রণার স্থানটিকেও অত্যন্ত সুরক্ষিত করতে হবে। চারিদিক আবদ্ধ কোনও একটি স্থানেই মন্ত্রণা করা উচিত, যেখান থেকে কথাবর্তার শব্দ বাইয়ে বেরোবা না। এমনকি তিনি এইটাও নিশ্চিত করতে বলেছেন, যে সেই মন্ত্রণাকক্ষ যেন কাক-পক্ষীদেরও দৃষ্টির অন্তরালে থাকে। কারণ এমন শোনা যায় যে শুক-শারিকারাও রাজার মন্ত্রণা প্রকাশ করে দিতে পারে, কারণ তার মানুষের কথা শুনে নকল করতে পারে। কুকুর বা ওই ধরণের মনুষ্যেতর প্রাণীদের সম্পর্কেও কৌটিল্য সাবধান করেছেন, কারণ তারাও নাকি অসংলগ্ন আচরণের মাধ্যমে মন্ত্রণা ফাঁস করে দিতে পারে। আর যে ব্যক্তি মন্ত্রণা প্রকাশ করবে, কৌটিল্যের মতে, তাকে দ্বিধাহীনভাবে উচ্ছেদ করতে হবে —উচ্ছিদ্যেত মন্ত্রভেদী। সে শাসকের যতোই প্রিয় হোন না কেন মৃত্যুদণ্ড ব্যতিত অন্য কোনও বিকল্প কৌটিল্য সেই মন্ত্রভেদকারী ব্যক্তির জন্য রাখেননি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৬: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৪: ‘মহেশ্বরের অনন্ত ধৈর্য’

বায়সরাজ মেঘবর্ণ তখন উজ্জীবী, সঞ্জীবী, অনুজীবী, প্রজীবী এবং চিরঞ্জীবী নামক পাঁচ মন্ত্রীদেরকে গোপনে এক এক করে জিজ্ঞাসা করলেন। এঁনারা প্রত্যেকেই বংশপরম্পরায় মন্ত্রীত্বপদ অলঙ্করণ করে আসছেন কয়েক প্রজন্ম ধরে এবং রাজপরিবারের সমৃদ্ধিতেও বংশপরম্পরায় এঁদের যোগদান অবিস্মরণীয়। তাই এঁদের প্রত্যেকের অভিমত রাজার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভেবেই বায়সরাজ মেঘবর্ণ একান্তে মন্ত্রণাকক্ষে মন্ত্রণা শুরু করলেন।

তাঁদের মধ্যে উজ্জীবীকেই প্রথম রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভদ্র! এবং স্থিতে কিং মন্যতে ভবান্‌?”—হে ভদ্র! এই অবস্থায় আমাদের কি করা উচিত এ বিষয়ে আপনি কি মনে করেন?

উজ্জীবী দ্বিধাহীন ভাষায় স্পষ্ট করে বললেন, ‘রাজন্‌! বলবতা সহ বিগ্রহো ন কার্যঃ। যতঃ স বলবান্‌ কালপ্রহর্তা চ তস্মাত্সন্ধেযঃ।’ —হে রাজন্‌! বলবান প্রতিপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা করা বা যুদ্ধ করার কোনও মানে হয় না। বরং হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সে যে কেবল বলবান তা-ই নয়, ঠিক সময় বুঝে আঘাত হানতেও সে ওস্তাদ। সে জানে কোন সময়ে আমরা দুর্বল। তাই রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সে আমাদেরকে আঘাত করে। ফলে আমার অভিমত হয় এইরকম শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে সন্ধি করে নেওয়াটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। কূটনীতি শাস্ত্রও বলে, যে রাজা বলবান শত্রুর সামনে নত হয়ে প্রথমে তার সঙ্গে সন্ধি করে নেয় আর পরে শক্তিসঞ্চয় করে সময় মতো তাকে আঘাত করে, তার সম্পদ কখনও তাকে ছেড়ে যায় না, যেমন নদীর ধারা কখনও স্রোতের বিপরীতে গমন করে না।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৭: পাতি সরালি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১২: অপারেশন অপহরণ

বহুযুদ্ধজয়ী কোনও সজ্জন ও ধার্মিক ব্যক্তি, যিনি সত্যকেই একমাত্র ধন বলে জীবনে মেনেছেন, তিনি যদি বিজিগীষু রাজার শত্রু হয়ে যান তবে তার সঙ্গে সন্ধি করে নেওয়াটাই একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তার উপর তিনি যদি বহু ভ্রাতৃধনে ধনী হন, তাহলে তো কথাই নেই। এমনকি প্রাণ নাশের সম্ভাবনা উপস্থিত হলেও শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করে নেওয়াটাকেও বুদ্ধিমানের কাজ বলেই পণ্ডিতেরা উল্লেখ করেছেন। কারণ প্রাণ রক্ষা পেলে পরে সবকিছুই রক্ষা পায়, কিন্তু প্রাণই যদি না থাকে তাহলে কোনও পুরুষার্থই সিদ্ধ হবে না—“প্রাণৈঃ সংরক্ষিতৈঃ সর্বং যতো ভবতি রক্ষিতম্‌”।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১০: বনবাসী রামের নিরাসক্ত ভাবমূর্তির অন্তরালে, ভাবি রামরাজ্যের স্রষ্টা দক্ষ প্রশাসক রাম

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে আনুমানিক পঞ্চম শতকে রচিত কালিদাসের “রঘুবংশ” (৪/৩৫) মহাকাব্যে যেখানে রঘুর দিগ্বিজয়ের কথা বলা হয়েছে সেখানে সুহ্ম-দেশীয়দের উল্লেখ আছে। সম্ভবতঃ বঙ্গপ্রদেশের রাঢ় অঞ্চলের অবস্থিত কোনো এক জনপদই হলো এই সুহ্ম-দেশ। মহাকবি লিখেছেন, বেতসলতা অর্থাৎ বেতগাছ যেমন অবনত হয়ে নদীর স্রোতের বেগ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে, সুহ্মদেশীয় লোকেরাও তেমনই অবনত হয়ে উদ্ধত-উচ্ছেদকারী সেই রঘুর হাত থেকে নিজেদের আত্মরক্ষা করেছিল। কালিদাসের এই উক্তির মধ্যে সুহ্মদেশীয়দের লোক-প্রকৃতি সম্বন্ধে কোনও ইঙ্গিত আছে কিনা বলা শক্ত, কারণ টীকাকার মল্লিনাথ বৈতসীবৃত্তি সম্বন্ধে এ প্রসঙ্গে কৌটিল্যের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছেন, “বলীযসাভিযুক্তো দুর্বলঃ সর্বত্রানুপ্রণতো বেতসধর্মমাতিষ্ঠেৎ”। অর্থাৎ শক্তিশালী ব্যক্তির সামনে দুর্বল ব্যক্তির সর্বদা নম্রতা প্রদর্শন করা উচিত; তার উচিত বেতের মতো নমনীয় স্বভাব গ্রহণ করা। বেতলতা যেমন ঝড়ে বা নদীর স্রোতে হেলে পড়ে কিন্তু ভাঙে না— সেইরকম নমনীয় ও আত্মরক্ষামূলক আচরণই তার জন্য শ্রেয়। সুহ্মেরা রঘুর থেকে রক্ষা পেতেই এইরকম বৈতসীবৃত্তি অবলম্বন করেছিলেন, না কি, রঘুর অপেক্ষায় তারা দুর্বল ছিলেন বলেই জনগণ এই উপায় নিয়েছিলেন সেটা বলা শক্ত।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৪: ঠাট্টা করলে যে বুঝতে পারত, ঠিক সময়ে হাসতে পারত

উজ্জীবীর মতে, মানুষ বৈতসীবৃত্তি বা বিনম্র আচরণের দ্বারা জীবনে বহু কিছুই অর্জন করতে পারে; কিন্তু শুরুতেই সর্পবৃত্তি অবলম্বণ করলে, অর্থাৎ কথায় কথায় ফোঁস করে ফণা মেলে ধরলে অধিকাংশ সময়েই মৃত্যুই তার ভাগ্যে জোটে। তাই কচ্ছপের মতন নিজের সব অঙ্গগুলোকে সঙ্কোচন করে আবরণের মধ্যে রেখে বাইরের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে পরে সময় মতো সর্পবৃত্তি অবলম্বণ করে ফোঁস করলে সঠিক ফল পাওয়া যায়। তাই আসন্ন যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিলে সামনীতির প্রয়োগ করে তা শান্ত করবার উপায় চিন্তা করা উচিত। যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়াটাও কিন্তু যুদ্ধেরই একটি অংশ। কারণ যুদ্ধে বিজয় পাওয়া কিন্তু অনিশ্চিত, তাই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে শুরুতেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। নীতিশাস্ত্রেও এইরকম কোনো উদাহরণ দেওয়া হয়নি যে নিজের থেকে বলবানের সঙ্গে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, কারণ মেঘ কখনই বায়ুর গতির প্রতিকূলে ভেসে যেতে পারে না, বায়ুর অনুকূল পথেই তাকে চলতে হয়। তাই বলবান শত্রুর সঙ্গে বিবাদে না গিয়ে সামনীতি অবলম্বন করে সন্ধি করাটাই শ্রেয়।

উজ্জীবী এইভাবে সন্ধির সপক্ষে সামনীতি প্রয়োগের পরামর্শ দিলেন।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content