সোমবার ২১ এপ্রিল, ২০২৫


শেষ রাতের দিকে ঘুমটা লেগে গিয়েছিল সত্যব্রতর। গাঢ় ঘুম নয়। আজ রাতের উত্তেজনার পর গাঢ় ঘুম অসম্ভব। কিছুক্ষণ আগেও জেগেই ছিলেন পুরোপুরি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালার দিকে তাকিয়েছিলেন। প্রতি মুহূর্তেই অপেক্ষা করছিলেন, কারও আসার। মোবাইল ফোনটা হাতের কাছে রেখেছেন। নাইট মোডে আছে সেটা। একটা নাম্বার এসওএস হিসেবে মাথায় রেখেছেন। কিন্তু নিজেই জানেন না, সেটা কার্যক্ষেত্রে কাজে আসবে কি-না। আজ রাতে না হোক, কাল কিংবা তার পরের দিন ওরা আসবেই এখানে নুনিয়ার খোঁজে। ওদের খপ্পর থেকে পালিয়ে এসে নুনিয়া কোথায় কোথায় যেতে পারে কিংবা লুকিয়ে থাকতে পারে, তার ম্যাপিং এতক্ষণে করে ফেলেছে ওরা নিশ্চয়ই। এখন কেবল সেই চরম মুহূর্তের অপেক্ষা।

তবে একটা ব্যাপারে তিনি আপাতত নিশ্চিন্ত যে, নুনিয়াকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলা গিয়েছে। যার সাহায্য নিয়েছেন তিনি এ-ব্যাপারে, তাঁকে এতটা ভরসা করেন বলেই অনুরোধটা করতে পেরেছিলেন। তিনি যে এক কথায় রাজি হয়ে যাবেন, এতটা আশা করেননি সত্যব্রত। তবে সাহায্যকারী নিজেও নুনিয়াকে ভালোই চেনেন বলে কাজটা করতে হয়তো রাজি হয়েছেন। নুনিয়াকে যারা একবার সঠিকভাবে চিনেছে, তারা তাকে বিপদে-আপদে আগলে রাখতেই চাইবে।

কিন্তু সমস্যাটা ঠিক তার পরেই দেখা দেবে। নুনিয়াকে যে বা যারাই অপহরণ করার চেষ্টা করুক না কেন, এর সঙ্গে যে চার্চের ভিতরের কেউ জড়িত, তাতে সন্দেহ নেই। তা না হলে, মেয়েদের হোস্টেলে রাতের বেলায় একজন মেল হুলিগানের ঢুকে পড়া সহজ নয়। কেউ না কেউ তাকে ঢুকতে সাহায্য করেছিল, হয়তো লুকিয়ে থাকতেও, আর সেই ব্যক্তি ওই হোস্টেলেই থাকেন। তাঁর কাছে নিশ্চয়ই খবর চলে গেছে যে, মিশন আনসাকসেসফুল। আর সেই খবর পেয়ে সমস্ত ব্যাপারটিকে তিনি হয়তো সত্যব্রতর মতোই ভাবছেন।

প্রথম কথা হল, নুনিয়া পালিয়ে যেখানেই যাক, তাকে খুঁজে বের করাটা এখন আরও জরুরি ওদের কাছে। তা না হলে, নুনিয়া যদি প্রকাশ্যে দিনের বেলায় চার্চে ফিরে গিয়ে সবাইকে বলে যে, কাল রাতের বেলায় তাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা হয়েছিল এবং সেই কারণেই সে রাতের বেলায় পালিয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরে অন্য জায়গায় লুকিয়ে ছিল, তাহলে গোটা এলাকায় হুলুস্থুল পড়ে যাবে। পুলিশও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। চার্চে তদন্ত শুরু হলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসবে হয়তো। অতএব যেন-তেন-প্রকারেণ তারা চাইবে যাতে নুনিয়া আর প্রকাশ্যে না বেরুতে পারে, তার আগেই হয় তাকে তুলে নিয়ে যাবে ওরা, আর নয়তো মেরেই ফেলবে একেবারে। অনেকদিন আগে একবার যে মেয়েকে গ্যাং-রেপড্‌ হতে হয়েছিল, তার শরীর ও মনের মূল্য যে ওদের কাছে কিছুই নেই, সে তো জানা কথা। নুনিয়ার জন্য চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেন সত্যব্রত। আহা! কে জীবনে কত দুঃখ আর দুর্ভোগ ভোগ করবে মেয়েটি?
আজ রাতেই তারা হন্যে হয়ে অভিযান চালাবে। সম্ভাব্য যেখানে-যেখানে মেয়েটি যেতে পারে বা লুকিয়ে থাকতে পারে, সে-সব জায়গায় খুঁজবেই তারা ওকে। আর কোনওভাবে নাগালে যদি পায়, তাহলে তাকে আর আস্ত রাখবে না তারা। এখন তাদের কাছে জীবিত নুনিয়ার চেয়ে মৃত নুনিয়া অনেক বেশি স্বস্তির। সেই চেষ্টাই করবে তারা। সত্যব্রত কি পারবেন, নুনিয়াকে এইসমস্ত নেকড়েদের হাত থেকে রক্ষা করতে?

নুনিয়াকে নিয়ে সাহায্যকারী নিজের ডেরায় ভালোভাবে পৌঁছে যাওয়ার পর একবার ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল তাঁকে। তাও ভিডিয়ো কলে। নুনিয়া সেখানে নিজের মুখেই জানিয়েছে যে, সে সেফ ফিল করছে। তাতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন তিনি। তারপর ডিলিট করে দিয়েছিলেন সেই ভিডিও কলের যাবতীয় সূত্র, এমনকি লাস্ট কলগুলিও। ওরা বুদ্ধিমান। যদি আসে, তাহলে সত্যব্রতর মোবাইল হাতে নিয়ে দেখবেই দেখবে যে, কাকে-কাকে তিনি লাস্ট ফোন করেছিলেন কিংবা কার-কার ফোন এসেছিল তাঁর কাছে। অতএব সে-ব্যাপারে আগে থেকে সতর্ক হওয়াই ভালো।

দ্বিতীয় যে-কাজটি করেছিলেন তিনি, সেটি হল গোটা ঘরে নুনিয়া আসার কোন চিহ্ন বা কিছু পড়ে আছে কি-না, সেটা চেক্‌ করা। যারা এতদূর ডেসপারেট হতে পারে, তারা যে এখানে এলে সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, তাতে সন্দেহ নেই। অতএব নুনিয়া আসার সব চিহ্ন-সূত্র চিরকালের মতো মুছে ফেলাই হবে তাঁর কাজ। বড় আলো জ্বালার উপায় নেই বেশিক্ষণ। বড়জোর একবার। বলতে পারবেন, ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে যদি চিহ্নিত করতে না পারেন, ওরা এসে যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ করে, তাহলে কতক্ষণ নুনিয়াকে বাঁচাতে পারবেন, তা তিনি জানেন না। সত্যব্রত না-হয় ওদের অত্যাচারের সামনে মুখ খুললেন না, প্রাণ অবধি দিলেন, কিন্তু তাতে কি শেষপর্যন্ত নুনিয়াকে বাঁচাতে পারবেন তিনি ? যদিও তাঁকে খুন করার মতো স্টেপ এই মুহূর্তে ওরা নেবে না, যতক্ষণ না নুনিয়াকে হাতের মধ্যে পাচ্ছে। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে জ্বেলে অতএব তিনি দেখে নিয়েছিলেন, কোনও সূত্র কিছু পড়ে আছে কি-না। যদিও প্রতি মুহূর্তেই ভয় পাচ্ছিলেন, ওদের এসে পড়ার।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১১: বিপদ যখন আসে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৪: ‘মহেশ্বরের অনন্ত ধৈর্য’

তারপর যখন নিশ্চিন্ত হয়েছেন, তখনও ওরা আসেনি দেখে একবার ভেবেছেন, তাহলে তিনি সন্দেহভাজনদের তালিকায় নেই। কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই মনে পড়ে গিয়েছিল, সাইকেল মাহাতোর সেই প্রচ্ছন্ন হুমকির কথা। চার্চে তাঁর সঙ্গে নুনিয়াকে কথা বলতে দেখে ফেলেছিল সাইকেল। জিজ্ঞাসাও করেছিল তাঁকে এ-ব্যাপারে। তখনকার মতো এটা-ওটা বলে কাটিয়ে দিলেও সত্যব্রত জানেন ধুর্ত সাইকেল সে-সব কথা বিশ্বাস করেনি মোটেই। তার মুখ দেখেই সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। ভাগ্যিস তাঁকে মোবাইল হস্তান্তরের ব্যাপারটা দেখতে পায়নি সাইকেল। তাহলে হয়তো সেখানেই একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে মোবাইলটা হস্তগত করার চেষ্টা করত। অতএব নুনিয়ার পছন্দের তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ যাওয়ার মতো কোন সম্ভাবনাই নেই।

যদিও তিনি জানেন না, সাইকেল মাহাতো এর সঙ্গে জড়িত কি-না। অন্য কেউও হতে পারে। তিনি হয়তো সাইকেলকে সেদিন দেখেছিলেন বলে তার কথাই ভাবছেন। আচ্ছা, সাইকেল কি এত বড় একটা অপারেশনের মাথা হতে পারে? এত ক্ষমতা তার? না-কি তাঁর যা সন্দেহ সেটাই সত্যি। এর পিছনে আছে ধুরন্ধর কারুর মাথা। চার্চের ফাদার আন্তোনিওর সঙ্গে কথা বলে তাঁর নিজের কেমন একটা ভালো লাগেনি। কেমন যেন একটা গা-ছাড়া ভাবে কথা বলছিলেন উনি। সত্যব্রতর আগমনে যে মোটেই খুশি হন নি তা বোঝাই যাচ্ছিল। তাঁর ব্যাপারে সাইকেল কি কিছু বলে এসেছিল ফাদারকে? সেই কারণেই কি ফাদার আন্তোনিও তাঁকে ভালোভাবে নিচ্ছিলেন না? কিন্তু ফাদারের কী স্বার্থ? না-কি ফাদার জড়িয়ে পড়েছেন সাইকেলের ফাঁদে? সে-ক্ষেত্রেও তো তাহলে সাইকেলকেই গোটা অপারেশনের পাণ্ডা বলে মনে করতে হয়। যদিও সত্যব্রত জানেন না, অপারেশনটা ঠিক কিসের! কিন্তু তাও সাইকেলকে তার পাণ্ডা ভাবতে নিজেরই অসুবিধা হচ্ছে তাঁর। অথচ এই রহস্যময় কর্মকাণ্ড, কালাদেও কিংবা নকল বুধনের গপ্পোর পিছনে কোন-না-কোন ধুরন্ধর মাথা কিংবা গ্রুপ অফ্‌ ডেভিলস্‌ আছে। সে কে? কিংবা তারা কারা?
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৬: পরাগপাখি

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ

ডাক্তার হিসেবে কখন ভাবেননি তিনি যে, এই জাতীয় চক্করে পড়বেন। বুধনের কেসটায় ইনভলভড্‌ হয়ে না-পড়লে হয়তো এতদূর এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেনও না তিনি। অবশ্য নুনিয়ার কথা শুনে তার প্রতিও একটা আন্তরিক টান অনুভব করছিলেন তিনি। নুনিয়াও তো তাঁর নিজের মেয়ে বা বোন হতে পারতো? কতই বা বয়স? যদি তা-ই হত, তাহলে কি তিনি নুনিয়াকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারতেন ? না-কি তার এই বিপদে তার পাশে দাঁড়াতেন না? এত সমস্যার মধ্যেও তাঁর নিজের হাসি পেল, তিনি কি গোয়েন্দা হয়ে উঠতে চাইছেন না-কি? কলেজ লাইফের সেই অতিনাটকীয় গোয়েন্দাদের মতো? নাহ্‌, ও-সব তাঁর ফিল্ড নয়, ও-সব তিনি পারবেন না হতে কোনদিনই।

ভাবতে-ভাবতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল তাঁর নিজেই জানেন না। হঠাৎ বাইরের দরজায় একটা আওয়াজ হতে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইলটা বালিশের পাশ থেকে নিয়ে সময় দেখলেন, তিনটে পাঁচ। বাইরের দরজার আওয়াজ কি আদতে হয়েছিল? না-কি ঘুমের ঘোরে…? প্রশ্নটা সম্পুর্ণ করার সময় পেলেন না তিনি। গোবিন্দের গলার আওয়াজ পেলেন তিনি। গোবিন্দ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁকে ডাকছিল, “ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!”
গোবিন্দ সোরেন? এত রাতে? তাহলে কি তিনি ভুল করছেন? ওরা নয়, কোনও পেশেন্ট এসেছে হয়তো। এমার্জেন্সি কেস হবে নিশ্চয়ই। নাহলে কে আর এত রাতে হেলথসেন্টারে আসবে?
উঠে পড়লেন তিনি। ডাক্তারদের জীবনে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। উঠে পড়ে গায়ে একটা আলোয়ান জড়িয়ে নিলেন। তারপর আলো জ্বেলে বাইরের দরজা খুলে দিলেন।
গোবিন্দ সোরেন দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পিছনে দুজন অচেনা লোক। একজন বয়স্ক মতো, আর একজন অল্পবয়সী যুবক। স্থানীয় নয় বলেই মনে হল। কারণ তাহলে গোবিন্দ চিনত, পরিচয় দিত। পরনের পোশাকআসাক ভদ্রস্থ গোছের। প্রৌঢ়ের হাতে একখানা চামড়ার ছোট ব্যাগ।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১০: বনবাসী রামের নিরাসক্ত ভাবমূর্তির অন্তরালে, ভাবি রামরাজ্যের স্রষ্টা দক্ষ প্রশাসক রাম

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ

সত্যব্রত যে মনে মনে ভাবছিলেন, সাইকেল মাহাতো এবং তার দলবল এসেছে হয়তো, সেটা সত্যি নয় দেখেই অবাক হলেন একটু। আশ্বস্তও হলেন। গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার গোবিন্দ? এত রাতে? কোন এমার্জেন্সি পেশেন্ট এসেছে না-কি?”
“আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, পেশেন্ট তো আসেননি, এঁরা এসেছেন। এঁরা স্থানীয় একটি রিসর্টে উঠেছেন গতকাল। বলছেন, এঁদের মধ্যে একজনের খুব শরীর খারাপ। নিয়ে আসারও উপায় নেই। আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। রিসর্টের গাড়ি এনেছেন সঙ্গে।”
সত্যব্রতর মধ্যে মুহূর্তে ডাক্তারি সত্তা জেগে উঠল। জিঘগাসা করলেন, “কার শরীর খারাপ হয়েছে? কী হয়েছে?”
প্রৌঢ় জবাব দিলেন, “আমার মেয়ের।” তারপর অল্পবয়সীর দিকে দেখিয়ে বললেন, “আমার জামাই। আমরা দু’চারদিনের জন্য এখানে এসেছিলাম একটু হাওয়াবদলের জন্য। আজকাল সশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পিশাচপাহাড়ের নাম যা ছড়িয়েছে…! তা যাক, আমরা কালকেই এখানে এসে পৌঁছেছি। আজ সন্ধে অবধিও ঠিক ছিল। ডিনারের পর মাঝরাত থেকে অসহ্য পেটে যন্ত্রণা মেয়ের। উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। এই বিদেশবিভুঁইতে কী করব ভেবে পাচ্ছি না। ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করায় বললেন, চার্চের হাসপাতালে নিয়ে যেতে, আর না-হল এই হেলথ্‌সেন্টারে আনতে। তা মিথ্যে বলব না, আমরা চার্চের হাসপাতালেই গিয়েছিলাম প্রথমে। কিন্তু সেখানে আজ এমার্জেন্সির উইং বন্ধ। যে ডাক্তারের থাকার কথা তাঁর কিছু সমস্যা হয়েছে না-কি। ফলে কাল সকালের আগে এমার্জেন্সির দরজা খুলবে না। অগত্যা এখানে এলাম। এটা-ওটা দিতে পারতাম, সঙ্গে পেটব্যথার মেডিসিন থাকেই, কিন্তু আমার মেয়ে চার মাস ক্যারি করছে। ফলে রিস্ক নিলাম না। আপনি দয়া করে চলুন, রিসর্টের গাড়ি আমরা তাকা দিয়ে হায়ার করেছি। ওই গাড়িই আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাবে ! দয়া করে না বলবেন না!” প্রৌঢ়ের গলায় কাতর আবেদন ফুটে উঠল।

যুবকটিও বলল, “হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, একমাত্র আপনিই পারেন আমার স্ত্রীকে বাঁচাতে!”
সত্যব্রতকে এত কিছু বলার দরকার ছিল না। রুগীর এমন অবস্থা শুনলে তাঁর মতো ডাক্তার রাতের নিদ্রাসুখের অজুহাতে যাবেন না, এটা হতেই পারে না। বললেন, “আরে ঠিক আছে, ওসব বলার দরকার নেই। এটা আমার প্রোফেশন এবং আমাদের ডাক্তার হিসেবে চব্বিশ ঘন্টার জন্য আপনাদের সেবার কাজে নিযুক্ত থাকতে হয়, সেই শপথ নিয়েই আমরা সকলে এই প্রোফেশনে আসি। কখন কখন কোন পরিস্থিতির জন্য কেউ হয়তো পারেন না, কিন্তু বাকিরা সবসময়েই হাত বাড়িয়েই থাকেন। আপনারা মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করুন, আমি জাস্ট পোশাকটা চেঞ্জ করে আমার মেডিক্যাল ফোলিওটা নিয়েই আসছি।
ওঁরা দুজনেই মাথা নাড়লেন। যতই এমার্জেন্সি থাক, ডাক্তারকে বাইরে বেরুনোর জন্য কাজ চলার মতো পোশাক তো পরার সময় দিতে হবে!
বেশি সময় লাগল না। কোনরকমে রেডি হয়ে স্টেথোটা গলায় ঝুলিয়ে বেরুচ্ছেন, গোবিন্দ বলল, “আমি যাব না-কি সঙ্গে স্যার?”
“না না, তুমি কেন যাবে ? ডাক্তারবাবুকে তো আমরা নিয়ে যাচ্ছি। সহি-সলামত পৌঁছে দিয়ে যাবো এখানে। কী ডাক্তারবাবু, ভুল বললাম কিছু ?” প্রৌঢ় সত্যব্রতর অনুমতি না নিয়েই তাঁর হয়ে গোবিন্দকে জবাবটা দিয়ে প্রশ্ন করলেন সত্যব্রতকে।
“হ্যাঁ, ঠিক। তুমি এখানে থাকো। আর কোন এমার্জেন্সি পেশেন্ট থাকলে নার্সদিদিদের কাউকে ডেকে এনো। আমি তাড়াতাড়িই ফিরতে পারবো আশা রাখি!”
“আমাদেরও তেমনই ইচ্ছা ডাক্তারবাবু। আপনি আমাদের সমস্যার সমাধান করে দিন, আপনার কাছে আমরা ওই টুকু সময়ই চাইছি। আপনাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখার কোন ইচ্ছাই আমাদের নেই!”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৬: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি

সত্যব্রত কথা বাড়ালেন না। এগিয়ে গেলেন তাঁদের সঙ্গে। ছোট মারুতি ওমনিটা দাঁড়িয়ে ছিল হেলথ্‌সেন্টারের অনতিদূরে। আলোছায়া পড়ে তার গায়ে নানা চিত্রবিচিত্র ছবি ফুটে উঠেছে যেন। যুবকটি সৌজন্য দেখাতে পিছনের দরজা খুলে দিল। গাড়িতে ঢুকেই বুঝলেন, স্টিয়ারিং ধরে যে বসে আছে, সে সস্তার বিড়ি খাচ্ছিল। গাড়ির মধ্যে এখন সে কটুগন্ধ রয়ে গেছে। প্রৌঢ় অন্যদিক দিয়ে উঠলেন। যুবকটি গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজে গিয়ে সামনের আসনে চালকের পাশে বসলো। এইসব মফস্‌সলে কেউ সিটবেল্ট বাঁধে না। সামনের যুবকটিও বাঁধেনি। সেই অবস্থায় সে ড্রাইভারকে বলল, “যত তাড়াতাড়ি আমাদের পৌঁছে দাও। সময় খুব কম!”

কিসের সময়ের কথা বলছে যুবকটি ? কোন রিসর্ট সেটাও তো জানানো হল না তাঁকে! ভাবতে-ভাবতে তিনি যেন নিজের মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছিলেন। যখন তাঁর খেয়াল হল, তখন দেখলেন, গাড়ি ছুটে চলেছে লোকালয়-রিসর্ট যেদিকে আছে, তার বিপরীত দিকে, যেখানে ঘন জঙ্গল চিরে চলে গিয়েছে পিচঢালা পথ, সেখান দিয়ে। অবাক হলেন তিনি। “আরে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কোথায় আপনাদের রিসর্ট ?”
পেটের কাছে খোঁচা খেলেন সত্যব্রত। প্রৌঢ় মিটিমিটি করে হাসছিলেন। তারপর মিষ্টি গলায় বললেন, “আরে রিসর্টে তো নিয়েই যাব। তার আগে একটু হাওয়া খাবেন না? এখানকার হাওয়া খুব ভালো, জানেন তো আপনি। আগে হাওয়া খাই, তারপর ধীরেসুস্থে পেশেন্টের কাছে নিয়ে যাবো।”
পেটের কাছে রিভলভার ধরে আছে লোকটি, তা বুঝতে অসুবিধা হল না সত্যব্রতর। ওরা তাহলে তাঁকে কায়দা করে ধরে নিয়ে এসেছে। তাঁকে কিডন্যাপ করেছে ? আর করেছে এমন কায়দা করে যাতে গোবিন্দ সোরেনের পর্যন্ত সন্দেহ হয়নি। না-কি হয়েছিল? সে-কারণেই কি সে আসতে চেয়েছিল? নিজের উপর আফশোস হল সত্যব্রতর। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।

গাড়ি ছুটছিল দ্রুতগতিতে। সত্যব্রত বললেন, “কী চান কী আপনারা? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? এক্ষুনি নামিয়ে দিন, নাহল কিন্তু আমি পুলিশকে কল করবো!”
“আহা রে ! পুলিশের ফেউ যেন!’ আদুরে আদুরে গলায় ন্যাকা ন্যাকা করে কথাটা বলল প্রৌঢ়। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিবি আমাদের? এত বড় দুঃসাহস? দিচ্ছি ধরাতে…” বলেই রিভলভারের হাতলটা দিয়ে সত্যব্রতর মাথায় সজোরে মারল। সত্যব্রত অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। তার আগে অনুভব করলেন, তাঁর মাথা দিয়ে গরম চ্যাটচেটে তরলের ক্ষীণ ধারা গড়িয়ে নামছে তাঁর মুখ বেয়ে। ওরা তাঁকে…!—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content