
গেস্টহাউসে মেঝেতে টাওয়েলের উপরে উপুড় হয়ে শুয়েছিল শাক্য। এখানে কোনও ম্যাসাজ-টেবিল নেই, ফলে মেঝেতেই ম্যাসাজ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারাদিনের ক্লান্তির পরে এই ম্যাসাজ দেহ-মনে আলাদা এনার্জি এনে দেয় বলে সুদীপ্ত অফারটি দেওয়ার পরে শাক্য আর না-করতে পারেনি। সে তার নিজস্ব জিমে শরীরচর্চা করে বলে, মাসে অন্তত দু’বার হলেও তাকে ম্যাসাজ নিতে হয়, ডিপ টিস্যু ম্যাসাজ। যারা জিম করে তাদের মাসল স্টিফ হয়ে যায়, তা যাতে না-হয়, সেজন্য ডিপ টিস্যু ম্যাসাজ নেওয়া জরুরি। না হলে অনেক সমস্যা হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। এ-কারণেই এবং শরীর ও মনের রিল্যাক্সেশনের জন্য ম্যাসাজ নেয় শাক্য। কিন্তু এই পিশাচ পাহাড়ে এসে যে সে ম্যাসাজ নিতে পারবে, তা কখন কল্পনাতেও আনেনি সে। কিন্তু সুদীপ্তর কল্যাণে সে-ব্যবস্থা হয়েছে।
ম্যাসিওর যুবকটির নাম উল্লাস মাহাতো। বয়স বছর আঠাশ এবং তার হাত ভারি চমৎকার। শাক্য জিজ্ঞাসা করায় সে জানিয়েছে, বছর তিন-চার সে এই প্রোফেশনে আছে। স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে। তবে পিশাচ পাহাড় নয়, সে আসলে থাকে জেলাসদরে, যদিও তার আদিবাড়ি এখানেই কিন্তু এই ছোট্ট পাণ্ডববর্জিত জায়গায় ও-সব জিনিসের কদরদারের অভাব বড় বেশি। ট্যুরিস্টদের ক’জন আর ম্যাসাজ নেয়, বাকি সময় তাহলে তাকে না-খেয়েই কাটাতে হত। অতএব পেটের তাগিদেই তাকে থাকতে হয় জেলাসদরে। তবে সপ্তাহে-দু’সপ্তাহে পিশাচপাহাড়ে ফিরলে সে কোনও বুকিং থাকলে ম্যাসাজের কাজ করে দেয়।
এই অঞ্চলে তার ধরাবাঁধা গুটিকয় কাস্টমার আছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কল্ দিলে সে ম্যাসাজ সার্ভিস দেয়। যেমন, রিট্যায়ার্ড জাজ মানব ব্যানার্জী। বয়স্ক মানুষ, ডাক্ত্রারের পরামর্শে কেবল সব্জী সেদ্ধ আর ভাত খান, আর সপ্তাহান্তে উল্লাস ফিরলে তার হাতে ম্যাসাজথেরাপি করান। সুদীপ্তও উল্লাসের নিয়মিত গ্রাহকদের মধ্যে একজন। ফলে তার জানা ছিল যে, উল্লাস পিশাচ পাহাড়ে ফিরেছে, এবং তাকে ম্যাসাজ করার কথাও ছিল উল্লাসের। কিন্তু হঠাৎ করে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় সেই সার্ভিস এ বারে আর উল্লাস দিতে পারেনি। তবে শাক্যকে অফারটা দিতে সে যখন রাজি হয়ে গেল, তখন সুদীপ্ত তার নিজের কোয়াটার্সেই ম্যাসাজের ব্যবস্থা করে দেবে বলেছিল। কিন্তু শাক্য রাজি হয় নি। ঠিক হয়েছিল, ম্যাসাজ নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে শাক্য রেডি থাকবে। পরে সুদীপ্তর গাড়ি এসে শাক্যকে নিয়ে যাবে তার কোয়াটার্সে। সেইমতোই সুদীপ্ত উল্লাসের সঙ্গে ফোনে স্লট বুক করে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। উল্লাসের কাল সকালেই সদরে ফিরে যাওয়ার কথা।
ম্যাসিওর যুবকটির নাম উল্লাস মাহাতো। বয়স বছর আঠাশ এবং তার হাত ভারি চমৎকার। শাক্য জিজ্ঞাসা করায় সে জানিয়েছে, বছর তিন-চার সে এই প্রোফেশনে আছে। স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে। তবে পিশাচ পাহাড় নয়, সে আসলে থাকে জেলাসদরে, যদিও তার আদিবাড়ি এখানেই কিন্তু এই ছোট্ট পাণ্ডববর্জিত জায়গায় ও-সব জিনিসের কদরদারের অভাব বড় বেশি। ট্যুরিস্টদের ক’জন আর ম্যাসাজ নেয়, বাকি সময় তাহলে তাকে না-খেয়েই কাটাতে হত। অতএব পেটের তাগিদেই তাকে থাকতে হয় জেলাসদরে। তবে সপ্তাহে-দু’সপ্তাহে পিশাচপাহাড়ে ফিরলে সে কোনও বুকিং থাকলে ম্যাসাজের কাজ করে দেয়।
এই অঞ্চলে তার ধরাবাঁধা গুটিকয় কাস্টমার আছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কল্ দিলে সে ম্যাসাজ সার্ভিস দেয়। যেমন, রিট্যায়ার্ড জাজ মানব ব্যানার্জী। বয়স্ক মানুষ, ডাক্ত্রারের পরামর্শে কেবল সব্জী সেদ্ধ আর ভাত খান, আর সপ্তাহান্তে উল্লাস ফিরলে তার হাতে ম্যাসাজথেরাপি করান। সুদীপ্তও উল্লাসের নিয়মিত গ্রাহকদের মধ্যে একজন। ফলে তার জানা ছিল যে, উল্লাস পিশাচ পাহাড়ে ফিরেছে, এবং তাকে ম্যাসাজ করার কথাও ছিল উল্লাসের। কিন্তু হঠাৎ করে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় সেই সার্ভিস এ বারে আর উল্লাস দিতে পারেনি। তবে শাক্যকে অফারটা দিতে সে যখন রাজি হয়ে গেল, তখন সুদীপ্ত তার নিজের কোয়াটার্সেই ম্যাসাজের ব্যবস্থা করে দেবে বলেছিল। কিন্তু শাক্য রাজি হয় নি। ঠিক হয়েছিল, ম্যাসাজ নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে শাক্য রেডি থাকবে। পরে সুদীপ্তর গাড়ি এসে শাক্যকে নিয়ে যাবে তার কোয়াটার্সে। সেইমতোই সুদীপ্ত উল্লাসের সঙ্গে ফোনে স্লট বুক করে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। উল্লাসের কাল সকালেই সদরে ফিরে যাওয়ার কথা।
উল্লাস উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা শাক্যকে ম্যাসাজ দিচ্ছিল যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে। মাসল স্টিফ হয়ে গিয়েছে। সপ্তাহখানেকের ওপর কলকাতা ছেড়েছে শাক্য, অতএব তারপর থেকে আর ম্যাসাজ নেওয়া হয়নি। সেক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রেসার দিয়ে ম্যাসাজ না-করলে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া সুদীপ্তবাবু তাকে বলে দিয়েছেন যে, লালবাজারের বড় গোয়েন্দা অফিসার, অতএব তাঁকে খুশি করতে না পারলে, সুদীপ্তবাবুরই না-কি চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। সেই কারণেই সে বেশি যত্নবান ছিল। প্রতি মুহূর্তেই সে শঙ্কিত হচ্ছিল যে, তার সার্ভিস বড় অফিসারের পছন্দ না হলে সে কী করবে? সুদীপ্তবাবু তাকে আস্ত রাখবেন না। যদিও শাক্যকে তার পছন্দ হয়েছিল। সে ভেবেছিল খুব খিটখিটে, তুম্বো মুখের একজন মধ্যবয়স্ক অফিসার, যার প্রমাণ সাইজ ভুঁড়ি থাকবে, আর থাকবে বিপুল পরিমাণ অহংকার। কিন্তু এসে দেখল যা ভেবেছিল, তার একেবারে বিপরীত। রীতিমতো জিমচর্চিত মেদহীন দেহ, একেবারে মাটির মানুষ, স্বল্পভাষী কিন্তু প্রিয়ভাষী মানুষ। তার নাম, ধাম, কতদিন হল সে এই পেশায় আছে, আগে ডিপ টিস্যু ম্যাসাজ সার্ভিস দিয়েছে কি-না ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করলেন কেবল। তারপর নির্দেশমতো উপুড় হয়ে শুয়ে কেবল বললেন, স্টিফ মাসল এবং স্ট্রেস দূর করার জন্যই তিনি ম্যাসাজ নিচ্ছেন, সেটা মাথায় রেখেই যেন তাঁকে ম্যাসাজ দেয় উল্লাস।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০০: চোর মাচায়ে শোর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৯: কী ছিল চিঠিতে, উত্তর লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের হাত কেঁপেছিল
ঘরে জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছিল। মোবাইলে সেতারের সুর। দুধসাদা ছোট অন্তর্বাস পরিহিত শাক্যকে মনে হচ্ছিল যেন, কোন গ্রিক গড! ম্যাসাজ নিতে নিতে টুকটাক কথা হচ্ছিল তাদের। কথা মানে, শাক্যই জিজ্ঞাসা করছিল, উল্লাস তার জবাব দিচ্ছিল মাত্র।
“উল্লাস, তোমাদের এখানে আমি কেন এসেছি জানো?”
“আজ্ঞে সঠিক জানি না স্যার, তবে আন্দাজ করতে পারছি।”
“শুনি তোমার আন্দাজ।”
“পিশাচপাহাড় রিসর্টে মার্ডারের তদন্তে স্যার।”
শাক্য বলল, “কেন তোমার এ-রকম মনে হল উল্লাস? এখানে তো আরও অনেক কিছু ঘটেছে, আজও ঘটছে। তার তদন্তেও তো আসতে পারি?”
“তা কী করে হবে স্যার?” কিছুটা অবাক হল যেন উল্লাস, তারপর বলল, “এখানে আর কিছু তো ঘটেনি!”
“সে-কী? কালাদেওর কবলে পড়ে গত বছর থেকে না-হোক দশ-পনেরো জনের মৃত্যু হয়েছে, সেগুলিকে কোন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না তোমার?”
উল্লাস বলল, “সেগুলি তো কালাদেওর কাজ। ভগবানের সঙ্গে কি আর মানুষ লড়াই দিতে পারে স্যার?” তার গলায় কিছুটা ঠাট্টার সুর, যদিও কথাটা আদৌ সে ঠাট্টা করার উদ্দেশ্যে বলেনি।
“কিন্তু যদি ভগবান না হয়ে শয়তান হয়, তাহলে কি তার সঙ্গে মানুষ লড়াই করতে পারে উল্লাস? করে জিততে পারে? তুমি কী বলো?”
“শয়তান?” উল্লাস প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “কালাদেও শয়তান কেন হতে যাবে স্যার? তিনি হলেন দেবতা। কেবল আপনাদের প্রচলিত পুজোপদ্ধতির সঙ্গে তাঁর পূজাপাঠের পদ্ধতি মেলে না। তবে তিনিও কিন্তু ভগবানের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কাউকে অকারণে হত্যা করেন না। কোন-না-কোন কারণ না-থাকলে যারা মারা গিয়েছে, তারা কেউই মারা যেত না!”
“উল্লাস, তোমাদের এখানে আমি কেন এসেছি জানো?”
“আজ্ঞে সঠিক জানি না স্যার, তবে আন্দাজ করতে পারছি।”
“শুনি তোমার আন্দাজ।”
“পিশাচপাহাড় রিসর্টে মার্ডারের তদন্তে স্যার।”
শাক্য বলল, “কেন তোমার এ-রকম মনে হল উল্লাস? এখানে তো আরও অনেক কিছু ঘটেছে, আজও ঘটছে। তার তদন্তেও তো আসতে পারি?”
“তা কী করে হবে স্যার?” কিছুটা অবাক হল যেন উল্লাস, তারপর বলল, “এখানে আর কিছু তো ঘটেনি!”
“সে-কী? কালাদেওর কবলে পড়ে গত বছর থেকে না-হোক দশ-পনেরো জনের মৃত্যু হয়েছে, সেগুলিকে কোন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না তোমার?”
উল্লাস বলল, “সেগুলি তো কালাদেওর কাজ। ভগবানের সঙ্গে কি আর মানুষ লড়াই দিতে পারে স্যার?” তার গলায় কিছুটা ঠাট্টার সুর, যদিও কথাটা আদৌ সে ঠাট্টা করার উদ্দেশ্যে বলেনি।
“কিন্তু যদি ভগবান না হয়ে শয়তান হয়, তাহলে কি তার সঙ্গে মানুষ লড়াই করতে পারে উল্লাস? করে জিততে পারে? তুমি কী বলো?”
“শয়তান?” উল্লাস প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “কালাদেও শয়তান কেন হতে যাবে স্যার? তিনি হলেন দেবতা। কেবল আপনাদের প্রচলিত পুজোপদ্ধতির সঙ্গে তাঁর পূজাপাঠের পদ্ধতি মেলে না। তবে তিনিও কিন্তু ভগবানের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কাউকে অকারণে হত্যা করেন না। কোন-না-কোন কারণ না-থাকলে যারা মারা গিয়েছে, তারা কেউই মারা যেত না!”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৩: রাগ অনুরাগের বন্ধন, ডিএইচ লরেন্স ও ফ্রিডা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী
শাক্য কাঁধের কাছে আরও কিছুক্ষণ ম্যাসাজ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলল, “কিন্তু যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মৃত্যুর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে যে, কালাদেও ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁদের হত্যা করলেন এবং খেয়েই ফেললেন ?”
“আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন স্যার, তারা প্রত্যেকে যখন বেঁচে ছিল, তখন কোনও-না-কোনও অপরাধ বা অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল।”
“এতটা জোর দিয়ে বলছ কী করে উল্লাস?”
“বলছি তার কারণ, কালাদেও এই অঞ্চলের যে গ্রামের যে গুহায় থাকেন, আমার নিজের বাড়ি সেই গ্রামেই। আমরা সকলেই তাঁর ভক্ত এবং জানি, তাঁর কাছে নির্দিষ্ট অভিযোগ কেউ-না-কেউ ঠিক পৌঁছে দিয়েছিল এবং তারপর তিনি পাপ-অন্যায়—এসবের ধ্বংস বা প্রতিকারের জন্য এভাবে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন!”
শাক্য মনে-মনে চমকে উঠেছিল। উল্লাস মাহাতোর বাড়ি সেই গ্রামেই, যেখানে পিশাচপাহাড়ের বহু যুগ আগে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হওয়া গুহায় আজও আত্মগোপন করে থাকেন কালাদেও! এ-যেন এক অদ্ভুত সমাপতন। সে মনের আগ্রহ বাইরে প্রকাশ করতে দিল না। মুখে বলল, “তুমি কালাদেওকে দেখেছ উল্লাস?”
“আজ্ঞে না। তিনি তো যখন-তখন যাকে-তাকে দেখা দেন না। তাঁর ইচ্ছের উপরে সব নির্ভর করছে। আমি না-দেখলেও আমার গ্রামের পূজারীসহ আরও কয়েকজন তাঁকে দেখেছে। তিনি খুব সুদর্শন, তা হয়তো নয়। কিন্তু তিনি তাঁর শরণাগতকে রক্ষা করেন, এ-টুকু বলতে পারি।”
“আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন স্যার, তারা প্রত্যেকে যখন বেঁচে ছিল, তখন কোনও-না-কোনও অপরাধ বা অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল।”
“এতটা জোর দিয়ে বলছ কী করে উল্লাস?”
“বলছি তার কারণ, কালাদেও এই অঞ্চলের যে গ্রামের যে গুহায় থাকেন, আমার নিজের বাড়ি সেই গ্রামেই। আমরা সকলেই তাঁর ভক্ত এবং জানি, তাঁর কাছে নির্দিষ্ট অভিযোগ কেউ-না-কেউ ঠিক পৌঁছে দিয়েছিল এবং তারপর তিনি পাপ-অন্যায়—এসবের ধ্বংস বা প্রতিকারের জন্য এভাবে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন!”
শাক্য মনে-মনে চমকে উঠেছিল। উল্লাস মাহাতোর বাড়ি সেই গ্রামেই, যেখানে পিশাচপাহাড়ের বহু যুগ আগে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হওয়া গুহায় আজও আত্মগোপন করে থাকেন কালাদেও! এ-যেন এক অদ্ভুত সমাপতন। সে মনের আগ্রহ বাইরে প্রকাশ করতে দিল না। মুখে বলল, “তুমি কালাদেওকে দেখেছ উল্লাস?”
“আজ্ঞে না। তিনি তো যখন-তখন যাকে-তাকে দেখা দেন না। তাঁর ইচ্ছের উপরে সব নির্ভর করছে। আমি না-দেখলেও আমার গ্রামের পূজারীসহ আরও কয়েকজন তাঁকে দেখেছে। তিনি খুব সুদর্শন, তা হয়তো নয়। কিন্তু তিনি তাঁর শরণাগতকে রক্ষা করেন, এ-টুকু বলতে পারি।”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৪: শিকারী ও ‘শিকার’

যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
চিত হয়ে শুল শাক্য। নানারকম জড়িবুটি মেশানো নিজের তৈরি তেল শাক্যর বুকের উপরে ছড়িয়ে উল্লাস ম্যাসাজের জন্য তৈরি হতে হতে আপনমনে বলল, “জাল-জুয়াচোরকে মেরে কালাদেও ভালোই করেছেন!”
শাক্য ভিতরে-ভিতরে চমকে উঠল। তারপর বলল, “কে জাল-জুয়াচোর উল্লাস? কার কথা বলছ?”
উল্লাস ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলল, “কেন? গেণু, গেণু হেমব্রম। যাকে কালাদেও ক’দিন আগে মেরেছেন, সে তো পাক্কা জালিয়াত!” বলেই হঠাৎ মুখ বন্ধ করল সে।
“গেণু হেমব্রম? সে কে? কোথায় তাকে মারলেন তোমার কালাদেও?” শাক্যর গলায় ভিতরের উত্তেজনার লেশমাত্র নেই, যদিও ভিতরে-ভিতরে সত্য জানবার অধীর আগ্রহে সে ফুটছিল যেন।
“ও কিছু নয় স্যার। আমি উড়ো কথা বলছিলাম, শোনা কথা স্যার। কোন প্রমাণ নেই! আপনার ফ্রন্ট বডির প্রেশার আর বাড়াবো, না-কি ঠিক আছে ?” উল্লাস কথা ঘোরাবার জন্য যেন জিজ্ঞাসা করল শেষ প্রশ্নটি।
“একদম ঠিক আছে। পাকা হাত তোমার উল্লাস। দিল্লী, মুম্বাই ইত্যাদি জায়গায় গেলে তুমি মালামাল হয়ে যেতে!”
“কী যে বলেন স্যার! ওসব জায়গায় কাজ করার মতো রেস্তেঁর জোর যদি আমার থাকত, তাহলে কি আর এখানে পড়ে থাকি? সব কপাল বুঝলেন, কপাল! তা-না-হলে কেউ দু’দিনে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়, কেউ বা স্কিলড্ হওয়া সত্ত্বেও কিংবা প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সারাজীবন পথের ভিখিরি হয়ে থাকে !”
“শয়তানি করাও কিন্তু প্রতিভারই লক্ষণ। সাধারণ যাঁরা, তাঁরা শয়তানিটুকুও সঠিকভাবে করতে পারেন না উল্লাস!”
উল্লাস প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। নিঃশব্দে ম্যাসাজ করতে লাগল।
শাক্য আবার জিজ্ঞাসা করল, “গেণু কে উল্লাস? বললে না তো? কবে তাকে হত্যা করলেন কালাদেও?”
উল্লাস অস্ফুট গলায় খানিকটা অসহিষ্ণুতার সুরে বলল, “বারবার হত্যা-হত্যা কেন বলছেন আপনি স্যার? কালাদেও কাউকে হত্যা করেন না। শাস্তি দেন। হত্যা আর পাপের শাস্তি দেওয়া কি এক?”
শাক্য ভিতরে-ভিতরে চমকে উঠল। তারপর বলল, “কে জাল-জুয়াচোর উল্লাস? কার কথা বলছ?”
উল্লাস ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলল, “কেন? গেণু, গেণু হেমব্রম। যাকে কালাদেও ক’দিন আগে মেরেছেন, সে তো পাক্কা জালিয়াত!” বলেই হঠাৎ মুখ বন্ধ করল সে।
“গেণু হেমব্রম? সে কে? কোথায় তাকে মারলেন তোমার কালাদেও?” শাক্যর গলায় ভিতরের উত্তেজনার লেশমাত্র নেই, যদিও ভিতরে-ভিতরে সত্য জানবার অধীর আগ্রহে সে ফুটছিল যেন।
“ও কিছু নয় স্যার। আমি উড়ো কথা বলছিলাম, শোনা কথা স্যার। কোন প্রমাণ নেই! আপনার ফ্রন্ট বডির প্রেশার আর বাড়াবো, না-কি ঠিক আছে ?” উল্লাস কথা ঘোরাবার জন্য যেন জিজ্ঞাসা করল শেষ প্রশ্নটি।
“একদম ঠিক আছে। পাকা হাত তোমার উল্লাস। দিল্লী, মুম্বাই ইত্যাদি জায়গায় গেলে তুমি মালামাল হয়ে যেতে!”
“কী যে বলেন স্যার! ওসব জায়গায় কাজ করার মতো রেস্তেঁর জোর যদি আমার থাকত, তাহলে কি আর এখানে পড়ে থাকি? সব কপাল বুঝলেন, কপাল! তা-না-হলে কেউ দু’দিনে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়, কেউ বা স্কিলড্ হওয়া সত্ত্বেও কিংবা প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সারাজীবন পথের ভিখিরি হয়ে থাকে !”
“শয়তানি করাও কিন্তু প্রতিভারই লক্ষণ। সাধারণ যাঁরা, তাঁরা শয়তানিটুকুও সঠিকভাবে করতে পারেন না উল্লাস!”
উল্লাস প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। নিঃশব্দে ম্যাসাজ করতে লাগল।
শাক্য আবার জিজ্ঞাসা করল, “গেণু কে উল্লাস? বললে না তো? কবে তাকে হত্যা করলেন কালাদেও?”
উল্লাস অস্ফুট গলায় খানিকটা অসহিষ্ণুতার সুরে বলল, “বারবার হত্যা-হত্যা কেন বলছেন আপনি স্যার? কালাদেও কাউকে হত্যা করেন না। শাস্তি দেন। হত্যা আর পাপের শাস্তি দেওয়া কি এক?”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০০: সন্দেহের তীরবিদ্ধ ভরতদের আজও খুঁজে পাওয়া যায়

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা
তার কথায় সায় দিল শাক্য। এই মুহূর্তে উল্লাসের কাছ থেকে তাকে জানতেই হবে গেণু কে। কবে এবং কেন তাকে শাস্তি দিয়েছেন কালাদেও। অতএব উল্লাসের কথায় সম্মত হলে উল্লাস পেটের কথা উজাড় করলেও করতে পারে। তাকে খুব একটা চালাক-চতুর মনে হচ্ছে না, তবে সাবধানী, হিসেবী।
শাক্য গলা দিয়ে আওয়াজ বের করল একটা। তারপর বলল, “দেখ আমি একমত যে, হত্যা আর শাস্তি দেওয়া—দুটি কথার অর্থ তাৎপর্য ভিন্ন। তবে গেণু কে এবং কেনই বা তাকে শাস্তি পেতে হল, তা না-জানলে মোটেই বলা সম্ভব নয় যে, সে লঘু পাপে গুরু দণ্ড পেয়েছে কি-না! সেই কারণেই তো তোমাকে জানতে চাইছি, গেণু কে এবং তার অপরাধটাই বা কী যাতে ভগবান কালাদেও হঠাৎ রেগে উঠলেন তার উপরে?”
কালাদেওকে “ভগবান” বলায় খুশি হয়ে উল্লাস বলল, “গেণু আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের ডানহাত। চুরি-ডাকাতি-ধর্ষণ—হেন কোন কাজ নেই যা-সে করেছে। তার দাপটে গ্রামের লোক তটস্থ ছিল। কথায়-কথায় মারপিট করা, জমি বেদখল করা ইত্যাদি তার কাজ ছিল। সে আমাদের গ্রামের লোক নয়। বাইরে থেকে এসেছিল বছর বিশেক হল। প্রধান নিজের গরজে এনেছিল কি-না তার ঠিক নেই। তবে সে আসার কিছুদিন পর থেকেই প্রধানের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। লাস্টবার পঞ্চায়েত ভোটের আগে এলাকায় সন্ত্রাস চালিয়ে ভোটলুট করার কৃতিত্বও তার আছে। ওর পলিটিক্যাল কানেকশান ছিল দুর্দান্ত । কেউ গেণুর নামে অভিযোগ জানালে পুলিশ উল্টে তাকেই ধরে নিয়ে যেত। আর একবার স্যার লকআপে যে পুলিশের থার্ড ডিগ্রি পেয়েছে, সে আর সারাজীবন ভুলতো না। আপনাকে আর কী-বলব স্যার, আপনি তো সবই জানেন।
পাড়ার অল্পবয়সী মেয়ে-বউদের নির্দ্বিধায় বাইরে বেরুনোর উপায় ছিল না। সাইকেল মাহাতো নামের একজন আর গেণু এই দুটি শয়তানের অত্যাচারে কত মেয়ে-বউ যে চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছে, কেউ তা বলতে পারে নি। কিন্তু গেণু বুঝতে পারেনি যে তার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে। এদিক-ওদিক থেকে দামি বাইক, চারচাকা ইত্যাদি হাপিশ করে আনতো, তারপর নম্বর প্লেট আর রং বদলে দিয়ে সে-সব বেচে দিত পাশের রাজ্যে। সকলেই জানত, লোকাল থানার পুলিশও জানত। কিন্তু ওই যে, রাজনৈতিক দাদাদের আশ্রয়ে আছে, তার উপর লাভের ভাগ তাঁরাও পান বলেই গেণুকে ধরতে চেয়েও তাঁরা ধরতে পারতেন না। তার উপর শুনেছি, সদরে ব্ল্যু-ফিল্ম সাপ্লাই দিত গেণু।
এদিকে কয়েকটা রিসর্ট-হোটেলের ওয়াশরুমে গোপন ক্যামেরা বসিয়ে রিয়্যাল ভিডিয়ো তুলতো গেণু। তার লোক ফিট করা ছিল বিভিন্ন রিসর্টে। তারা সেগুলির রেকর্ডিং পৌঁছে দিত গেণুর কাছে। সেগুলি সে আবার কাউকে বেচত। অনেক লাভের ব্যবসা। আজকাল আর্টিফিসিয়াল ব্ল্যুফিল্ম কেউ দেখতে চায় না। অনেকে লাইভ ভিডিয়ো দেখতে চায় স্যার। ডার্ক ওয়েবে আজকাল ওইসব জিনিসেরই ডিমাণ্ড বেশি বলে শুনেছি। লাইভ টেলিকাস্টও হয়তো করত গেণুর সাগরেদরা। এ-সব কিন্তু আমার শোনা কথা স্যার। কোণ প্রমাণ চাইলে দিতে পারব না। যাই হোক, আমাদের কালাদেও তা মানবেন কেন? চুরির মাল নিয়ে পালানোর পথেই তাকে একেবারে সাবাড় করে দিয়েছে!”
“কবে?”
“ক’দিন আগে স্যার। সুদীপ্তবাবু না চিনলেও বড়বাবু তো চেনেন গেণুকে। জিজ্ঞাসা করবেন তাঁকে!” —চলবে।
শাক্য গলা দিয়ে আওয়াজ বের করল একটা। তারপর বলল, “দেখ আমি একমত যে, হত্যা আর শাস্তি দেওয়া—দুটি কথার অর্থ তাৎপর্য ভিন্ন। তবে গেণু কে এবং কেনই বা তাকে শাস্তি পেতে হল, তা না-জানলে মোটেই বলা সম্ভব নয় যে, সে লঘু পাপে গুরু দণ্ড পেয়েছে কি-না! সেই কারণেই তো তোমাকে জানতে চাইছি, গেণু কে এবং তার অপরাধটাই বা কী যাতে ভগবান কালাদেও হঠাৎ রেগে উঠলেন তার উপরে?”
কালাদেওকে “ভগবান” বলায় খুশি হয়ে উল্লাস বলল, “গেণু আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের ডানহাত। চুরি-ডাকাতি-ধর্ষণ—হেন কোন কাজ নেই যা-সে করেছে। তার দাপটে গ্রামের লোক তটস্থ ছিল। কথায়-কথায় মারপিট করা, জমি বেদখল করা ইত্যাদি তার কাজ ছিল। সে আমাদের গ্রামের লোক নয়। বাইরে থেকে এসেছিল বছর বিশেক হল। প্রধান নিজের গরজে এনেছিল কি-না তার ঠিক নেই। তবে সে আসার কিছুদিন পর থেকেই প্রধানের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। লাস্টবার পঞ্চায়েত ভোটের আগে এলাকায় সন্ত্রাস চালিয়ে ভোটলুট করার কৃতিত্বও তার আছে। ওর পলিটিক্যাল কানেকশান ছিল দুর্দান্ত । কেউ গেণুর নামে অভিযোগ জানালে পুলিশ উল্টে তাকেই ধরে নিয়ে যেত। আর একবার স্যার লকআপে যে পুলিশের থার্ড ডিগ্রি পেয়েছে, সে আর সারাজীবন ভুলতো না। আপনাকে আর কী-বলব স্যার, আপনি তো সবই জানেন।
পাড়ার অল্পবয়সী মেয়ে-বউদের নির্দ্বিধায় বাইরে বেরুনোর উপায় ছিল না। সাইকেল মাহাতো নামের একজন আর গেণু এই দুটি শয়তানের অত্যাচারে কত মেয়ে-বউ যে চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছে, কেউ তা বলতে পারে নি। কিন্তু গেণু বুঝতে পারেনি যে তার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে। এদিক-ওদিক থেকে দামি বাইক, চারচাকা ইত্যাদি হাপিশ করে আনতো, তারপর নম্বর প্লেট আর রং বদলে দিয়ে সে-সব বেচে দিত পাশের রাজ্যে। সকলেই জানত, লোকাল থানার পুলিশও জানত। কিন্তু ওই যে, রাজনৈতিক দাদাদের আশ্রয়ে আছে, তার উপর লাভের ভাগ তাঁরাও পান বলেই গেণুকে ধরতে চেয়েও তাঁরা ধরতে পারতেন না। তার উপর শুনেছি, সদরে ব্ল্যু-ফিল্ম সাপ্লাই দিত গেণু।
এদিকে কয়েকটা রিসর্ট-হোটেলের ওয়াশরুমে গোপন ক্যামেরা বসিয়ে রিয়্যাল ভিডিয়ো তুলতো গেণু। তার লোক ফিট করা ছিল বিভিন্ন রিসর্টে। তারা সেগুলির রেকর্ডিং পৌঁছে দিত গেণুর কাছে। সেগুলি সে আবার কাউকে বেচত। অনেক লাভের ব্যবসা। আজকাল আর্টিফিসিয়াল ব্ল্যুফিল্ম কেউ দেখতে চায় না। অনেকে লাইভ ভিডিয়ো দেখতে চায় স্যার। ডার্ক ওয়েবে আজকাল ওইসব জিনিসেরই ডিমাণ্ড বেশি বলে শুনেছি। লাইভ টেলিকাস্টও হয়তো করত গেণুর সাগরেদরা। এ-সব কিন্তু আমার শোনা কথা স্যার। কোণ প্রমাণ চাইলে দিতে পারব না। যাই হোক, আমাদের কালাদেও তা মানবেন কেন? চুরির মাল নিয়ে পালানোর পথেই তাকে একেবারে সাবাড় করে দিয়েছে!”
“কবে?”
“ক’দিন আগে স্যার। সুদীপ্তবাবু না চিনলেও বড়বাবু তো চেনেন গেণুকে। জিজ্ঞাসা করবেন তাঁকে!” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।