শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


“আচ্ছা আর্য, অনিল কেন খুন হল বলতে পারিস?”
“আমি কীভাবে বলব? আমি কি খুনটা করেছি না-কি?” আর্য বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল।
প্রশ্নটা তাকে করেছিল অরণ্য। হাসতে-হাসতে কোন আড্ডার মুডে করেনি। করেছে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে। তবে ফিসফিসিয়ে। কারণ, এই মুহূর্তে ডাইনিং-এ তাদের গ্রুপের কেউ না থাকলেও, পরে আসা কাপল্‌ দুজন রয়েছে কিছুটা দূরেই। রিসর্টের দুজন কর্মচারী, যারা কখন কুক, কখন ওয়েটার, তারাও আছে, অতএব তাদের কান বাঁচিয়েই প্রশ্নটা করেছে সে। অন্য জায়গায় প্রশ্নটা করা যেত। কিন্তু পরপর কয়েকটি ঘটনায় সব এমন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে যে, সেই ‘অন্য জায়গা’টাই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর এখন।

বাইরে বেরোনো রেস্ট্রিক্টেড্‌, যে-যার রুমের মধ্যে খাচ্ছে-শুচ্ছে, দেখা হলে কাস্ট হেসে উইশ করছে বটে কিন্তু মনের দুর্ভাবনাগুলিকে আড়াল করতে পারছে না। প্রত্যেকেই ভাবছে, কে জানে, কালাদেও আমাকে এ বার টার্গেট করবে না তো? আর তা না হলে ভাবছে, অনিল যদি অন্য কারণে মার্ডারই হয়ে থাকে, আর সেই মার্ডারার যদি আমাদের মধ্যেই কেউ হয়ে থাকে, তাহলে সে কে? সকলেই সকলকে আড়চোখে মেপে নিচ্ছে। হাঁফিয়ে উঠেছে অরণ্য। মিস করছে সে জিম, কলকাতার লাইফ, নাইটক্লাব, আর তার সিক্রেট অ্যাডমায়ারদের। এক্ষুনি যদি সে অনুমতি পায় এখান থেকে চলে যাওয়ার, সে বোধহয় দুটি ডানা লাগিয়ে রাতেই উড়ে যাবে। অবশ্য কেবল সে কেন, আরও অনেকেই এখান
আর্যর প্রতিক্রিয়া অরণ্য হালকাভাবে নিল। বলল, “তুই যে খুন করতে পারবি না সে-কি আমি জানি না? তুই শালা ওই অঙ্গটাই ব্যবহার করতে ভয় পাস, তুই করবি খুন!”
আর্য আরও চাপা গলায় দাঁতে দাঁত চেপে খিস্তি দিল বাছাই করা। তারপর বলল, “আমি তোদের মতো সেক্স-ম্যানিয়াক না-কি? আমি সন্ন্যাসীর মতো, সংযমী পুরুষ!”
“সংযমী না-হয় মানলাম, অনেক ইম্পোটেন্টই নিজেকে ‘সন্ন্যাসী’ কিংবা ‘সংযমী’র মুখোশে আড়াল করে। কিন্তু ওই যে বললি, তুই ‘পুরুষ’, সে-বিষয়ে কনফার্ম তো?”
“কেন? তুই কি আমার সঙ্গে বিছানায় শুয়েছিলি যে তোর মনে হচ্ছে আমি পুরুষ নই?”
অরণ্য কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলল, “শুতে তো চাইছি। প্রমিস, তোর দিল্‌ খুশ করে দেবো। একবার পেলে, বারবার চাইবি। কিন্তু কবে, কখন বল? সারারাত চাই?”
আর্য বিরক্ত হয়ে তাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল, “ভাট বকিস না তো! তুই বাই-সেক্সুয়াল, আমরা জানি। কিন্তু তা বলে আমি গে নই!”
অরণ্য বলল, “তোদের জানাটা ভুল নয়, আর আমিও যে সেটা কাছের জনদের কাছে লুকিয়ে রাখি, তা তো নয়। কিন্তু তুই বাই বা গে নয়, সিঙ্গল তো নয়ই, আমি একবারও তোকে ও-সবের মধ্যে ফেলিনি। আমি বলতে চেয়েছি, তুই ইমপোটেন্ট এবং ফ্রিজিড। কেবল ইমপোটেন্ট হলেও না-হয় কথা ছিল, কিন্তু তুই ছেলে হোক বা মেয়ে, কারুর প্রতিই আকৃষ্ট হবি না যদি তুই বাংলায় যাকে কামশীতল বলে, তা হোস্‌। আমার বক্তব্য তুই সেটাই, কামশীতল!”
আর্য অস্বস্তিবোধ করছিল। সে প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বলল, “তুই কি এসব বলার জন্যই অনিলের প্রসঙ্গ তুলেছিলি?”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৫: পরবর্তী পদক্ষেপ

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

অনিলের কথায় অরণ্য হালকা-তরল মুড ছেড়ে আবার সিরিয়াস গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “না! অনিলকে কে মারল আর কেনই বা মারল, সেই প্রশ্ন আমাকে কুরে-কুরে খাচ্ছে আর্য! আমি যত ভাবছি, তত অবাক হয়ে যাচ্ছিস!”
আর্য বলল, “আমিও!”
অরণ্য খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “জানিস, এই রিসর্টে আসার পর, তুই যেদিন চলে গেলি, সেদিন সন্ধ্যায় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটি আমি ভুলে গিয়েছিলাম, এখন মনে পড়ল। আমরা তখন নীচে গার্ডেন পার্টিতে যাব বলে তৈরি হচ্ছি আমি আর তৃধা, এমন সময় দরজায় নক্‌ হল। খুলে দেখি একটি লোক্যাল মেয়ে, মে বি ফ্রম ট্রাইব্যাল কমিউনিটি, দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাবলাম, ভিক্ষাটিক্ষা কিছুর জন্য কোনওভাবে রিসর্টে ঢুকে পড়েছে। কিছু বলার আগেই সে বিশুদ্ধ ইংরাজিতে আমাকে কিংবা আমাদের সাবধান করল, কোনভাবেই যেন বাইরে না বেরোই, তাহলে বিপদ! আমি হতভম্ব, কী বলব বুঝতে পারছি না। এই সুযোগে মেয়েটি ভ্যানিশ। পরে শুনে রিসর্টের কর্মচারীদের কেউ-কেউ বলছিল, নুন না চিনি কী একটা নাম মেয়েটির, সেই হতে পারে। তার মাথায় না-কি পোকা আছে। স্থানীয় চার্চের হোমে থাকে। যখন-তখন হোম থেকে পালিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। যাই হোক, তাকে অতটা গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ হল, সে কিন্তু আগাম বিপদের কথা আঁচ করেছিল। হাউ?”
আর্য ঘটনাটির কথা জানত না। সে তখন উপস্থিত ছিল না। এখন শুনে সে খানিকটা অবাক হল। এইরকম আবার হয় না-কি? এ-তো বি-গ্রেডের মুভি কিংবা ওয়েবসিরিজেই দেখা যায়! কোনও দুর্ঘটনা ঘটার আগেই তার আঁচ পাওয়া! তাছাড়া মেয়েটি জানলই বা কী করে? তার ইন্টারেস্টই বা কী? পিশাচপাহাড়ে দেখা যাচ্ছে অনেক আজব ঘটনা ঘটে, যার কোন মাথামুন্ডূ অর্থ হয় না!
অরণ্য বলল, “অবাক হলি না-কি?”
“তা একটু হলাম। এ-তো আষাঢ়ে গপ্পে শোনা যায়!”
“কিন্তু এটা গপ্পো না, ফ্যাক্ট। বিশ্বাস না-হয় তুই তৃধাকে জিজ্ঞাসা করতে পারিস!”
“না না, তা নয়। বিশ্বাস করছি। তুই নিশ্চয়ই আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে বসছিস না। কিন্তু কীভাবে মেয়েটি আগাম সতর্কতা জারি করল আর কেনই বা তোকে এসে বলতে গেল, সেই মিসিং-লিংকটা খোঁজবার চেষ্টা করছি আর-কি!”
“আমিও চেষ্টা করেছি। বার করতে পারিনি। মেয়েটির সঙ্গে দেখা করার চান্সও পেলাম না আর। একের পর এক এমন সব ঘটনার ঘনঘটা শুরু হয়ে গেল!”
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৪: আশ্রমের আনন্দময় পিকনিক

“সত্যিই। এই পিশাচপাহাড় ট্রিপটা আমাদের কাছে খুব আনলাকি হয়েই থেকে গেল। আসাই উচিত হয়নি আমাদের!” আর্য আক্ষেপের শব্দ করল মুখ দিয়ে। তারপর বলল, “অনিলকে যেন যম ডেকেছিল। তা-না-হলে সে এ-ব্যাপারে একেবারে আদাজল খেয়ে লেগে পড়ত না! মনে আছে, সেই-ই এই পিশাচপাহাড় ট্রিপের কথা বলে?”
“অনিল ?” অরণ্য একটু চিন্তা করার চেষ্টা করল, “অনিল এখানে আসার ব্যাপারে সমস্ত বন্দোবস্ত করেছিল সত্যি কথা, কিন্তু সে-ই কি এই জায়গাটা বেছেছিল?”
“হ্যাঁ, সে না তো কে? আমার তো বেশ মনে আছে, অনিল সেই পার্কস্ট্রিটের বারে বসে বলেছিল, একটা ট্যুর করলে কেমন হয়? একটু অফবিট প্লেসে? তখনই তো পিশাচপাহাড় নামের এই জায়গাটার কথা ও বলে। নাম শুনেই আমরা সকলে আগ্রহ দেখাই। আমরা ভেবেছিলাম, নামটা এমন গা-ছমছমে, তাহলে আসলে নির্ঘাৎ থ্রিলিং প্লেস হবে। কেউ বোধহয় আমাদের মধ্যে ঠাট্টা করে বলেছিল, পিশাচ-টিশাচ দেখা গেলে বেশ হয়!”
অরণ্য বলল, ‘যতদূর মনে পড়ছে অঞ্জন বলেছিল। শুনে উন্মেষা ওকে গুঁতো মেরে থামিয়ে দিয়েছিল। ওর মুখ পিশাচের কথা শুনে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, আমার নজর এড়ায়নি।”
“কেউ-কেউ ভূত-প্রেতে এত ভয় পায়!” আর্য বলল, “যত সব অন্ধ কুসংস্কার। যদিও এখানে আসার পর মনে হচ্ছে, সব কিছুই অন্ধ কুসংস্কার না-ও হতে পারে। দেয়ার আর মোর থিংস…!”
“তার মানে, তুইও এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিস কালাদেও-টেওর গল্প?” অরণ্য হাসল না। সিরিয়াস ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৫: বিরোধিতায় নয়, মৈত্রীবন্ধনেই রয়েছে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসূত্র

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

“বিশ্বাস করতে তো চাই না। কিন্তু অবস্থা এমন যে…! হিসেব মেলাতে পারছি না! অনিলের মতো অমন বন্ধুবৎসল ছেলে…! তার এমন পরিণতি ভাবা যায়?”
“আচ্ছা, আত্মহত্যাও তো হতে পারে!” অরণ্য যেন নিজের মনকেই সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল।
“যেভাবে মৃত্যুর কথা শুনেছি, সেটা কখনই আত্মহত্যা হতে পারে না। হলে পুলিশ, বিশেষ করে লালবাজার থেকে আসা গোয়েন্দা অফিসারটি সকলকে ডেকে এত হ্যারাস করত না! আমি অবশ্য তখন ছিলাম না! নাহলে আমাকেও হ্যারাস করত!”
“আচ্ছা, এমন নয় তো, অনিল কোন বিশেষ কারণে ফেঁসে গিয়েছিল, সেজন্য কলকাতা থেকে পালাতে চাইছিল, যে-কারণে এই অফবিট জায়গাতে এসেছিল। হয়তো ভেবেছিল, এখানে এলে সে কাউকে এড়াতে পারবে?”
“কী জানি? সেইরকম কোন ক্রাইসিস হলে সে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করত না?”
“আরে হয়তো করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেয়ার করতে পারেনি কোন কারণে। হয়তো আমাদের কাছে বলাটাও অসম্ভব ছিল তার পক্ষে!”
“হতে পারে। তবে তার আচার-আচরণে কিন্তু কোনও পরিবর্তন আমরা কেউই আসবার সময় কিংবা এখানে এসে অবধি দেখিনি। সেই পিকনিক যেদিন গেলাম, সেদিন আমি যতদূর দেখেছিলাম, তাতে তো বেশ হাসিখুশি প্রাণোচ্ছ্বল—যেমন ওর নেচার, তেমনই দেখে গিয়েছিলাম। তারপর কী ঘটল যে, সে আত্মহত্যা করবে? এটা আত্মহত্যা নয়, মার্ডারই। তা সে কালাদেও করে থাকুক বা আর কেউ!”
“জানিস তো, আমার মা একটা কথা বলতেন, তুমি যদি ভাবো যে মাঠ-ঘাট ঘুরে আসবে আর কোন চোরকাঁটা তোমার পায়ে পায়ে ঘুরবে না কিংবা তোমার সঙ্গে-সঙ্গে তোমার অজান্তেই তোমার ঘরে ঢুকে পড়বে না, তাহলে তুমি ভুল! চোরকাঁটা যে কখন আমাদের পায়ে পায়ে জড়িয়ে আমাদের সঙ্গ নেয়, তা জানতে পারা দুষ্কর। তেমনই, আমরা অনেকসময় বিপদ নিজেরাই ঘাড়ে করে নিয়ে আসি নিজেদেরই অজান্তে। অনিল কী তেমনটাই করেছিল?”
আর্য বলল, “তুই কিন্তু পুলিশের মতোই ভাবছিস, আমাদের মধ্যে থেকে কেউ…!”
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

অরণ্য বলল, “ভাবতে বাধ্য হচ্ছি! কারণ, অনিলকে, আমাদেরকে এখানে কে চেনে? আমরা ট্যুরিস্ট, বহিরাগত। দু’দিনের জন্য এসেছি, চলে যাব বলেই। তাহলে হঠাৎ এইখানে স্থানীয় কেউ আমাদের পিছনে ধাওয়া করে কেনই বা আসবে আর খুনই বা কেন করবে? অতএব হাতে রইল…”
“পেনসিল! বাদ দে। অনিল চলে গেছে, আমরা রয়ে গিয়েছি। এখন আমাদের সকলের একটাই প্রশ্ন হওয়া উচিত, কবে নাগাদ এই অন্ধকূপ থেকে মুক্তি মিলবে!”
“হুম। হোপলেস লাগছে। এদিকে আমার ক্লায়েন্টস্‌ সব অন্য ট্রেনারদের কাছে না চলে যায়! বড় লোকসান হয়ে যাবে তাহলে!”
“বুঝলাম, তোর জ্বালার কারণ। তা তৃধা কোথায়?”
“আর বলিস না, সেই কখন থেকে স্নান করতে গিয়েছে, এখানে আসার সময়েও তার সেই স্নান শেষ হয়নি। আমি হোমসার্ভিস বলেছিলাম ওর জন্য, সে-খাবার হয়তো ঠান্ডাই হয়ে যাবে! এদের নিয়ে চলাই মুশকিল!”
“তবুও চলতে হবে! এখন তো আরওই। নাহলে আমরা এই ক’জনও যদি নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, তাহলে সেই গোপন চোরকাঁটা হয়ত আমাদের এসেও বিঁধবে!” আর্য দার্শনিকের মতো করে বললেও, কথাটার মধ্যে সত্য আছে।
অরণ্য মাথা নেড়ে সায় দিল। সে তখন ভাবছিল, আর-কোনও বিপদ আসছে না তো ? সেজন্যই কী এই ক’দিন আপাত শান্ত হয়ে আছে সব? —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content