শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

নুনিয়ার ঘুম আসছিল না। প্রায়ই আসে না। সারাদিন এত দৌড়ঝাঁপ করে, ঘুরে বেড়ায়, শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ার কথা। কিন্তু পড়ে না। আগে যেমন বিছানায় শুলেই ঘুম দু’-চোখ ভরে ঝেঁপে আসত, এমনকি সন্ধে থেকেই ঘুমে ঢুলে পড়ত বলে মা বকাবকি করত, আজকাল আর তেমন হয় না। মা-ও নেই, ঘুমও যেন চলে গিয়েছে সেই থেকে। তার উপর ফাদারের সঙ্গে আজকাল আর দেখা করতে দেওয়া হয় না তাঁকে। তিনি না-কি আরও অসুস্থ। কথা বলা তো দূর, চোখ মেলেও তাকাতে পারছেন না। ডাক্তারেরা তাঁকে স্পেশাল অবজারভেশনে রেখেছেন, এখান থেকে শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও এখন সম্ভব নয়, পথেই এক্সপায়ার করতে পারেন, অতএব এখানে রেখেই তাঁর চিকিৎসা চলছে। সেই চিকিৎসাও আসলে সময়ের অপেক্ষা, কবে ফাদার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন!

আগে নুনিয়া রাতের বেলা একা হলেই কাঁদত। বাবা নেই, মা নেই, ফাদারের স্নেহচ্ছায়া, বকুনি, উপদেশ—কিছুই নেই। এই দুনিয়ায় সে বড় একা, সে-জন্যই কাঁদত। কিন্তু তারপর একদিন তার সেই কান্নার প্রবাহ শুকিয়ে গেল। সে নিজেকেই নিজে বুঝিয়েছে, এই দুনিয়ায় তাকে টিকে থাকতে গেলে কান্নায় ভেঙে পড়লে চলবে না। শক্ত হতে হবে তাকে, দেহ এবং মন—দু’দিক থেকে। তারপর থেকেই সে আর কাঁদে না। ভিতরে-ভিতরে বিদ্রোহী উঠেছে সে, কিন্তু কার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তা সে জানে না। হয়তো গোটা ব্যবস্থার প্রতিই বিদ্রোহ, কারণ এই চার্চের হাসপাতাল এবং হোস্টেলের আবাসিকদের নিয়ে যা চলে, তার মধ্যে যে বিরাট গণ্ডোগোল আছে, তাতে তার আর কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বাইরে তার যতই অবাধ বিচরণ থাক, চার্চের চৌহদ্দীর মধ্যে সে অসহায়।

এখানে অনেক জায়গায় যাওয়া তো দূর, তাকে ঘেঁষতেই দেওয়া হয় না। সে চেষ্টা যে করেনি তা তো নয়। কিন্তু এখনও পেরে ওঠেনি। আচ্ছা, ওই নতুন পুলিশআংকেলকে বলবে সে? উনি নিশ্চয়ই তার কথা শুনে কিছু একটা ব্যবস্থা নেবেন? যে-টুকু সে বুঝেছে, ওঁকে বিশ্বাস করা যায়। তার সঙ্গে কেমন স্নেহমাখা স্বরে কথা বলছিলেন। আর দেখেও মনে হচ্ছিল, মনের জোর আছে, শরীরেও। জঙ্গলের মধ্যে যেভাবে দৌড়াচ্ছিলেন। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। যার পিছনে উনি দৌড়াচ্ছিলেন, নুনিয়া তাকে দেখেছে। ভালোভাবেই চেনে সে। এই চার্চে তার অবাধ যাতায়াত। যেখানে-যেখানে নুনিয়ার যাওয়ার পারমিশন নেই, সেখানে-সেখানে বাইরের লোক হয়েও ওই লোকটি নির্দ্বিধায় যেতে পারে। বর্তমান ফাদার তাকে সেই অনুমতি দিয়ে রেখেছেন বলে শুনেছে সে। যদিও পুলিশআংকেলকে সে তার নাম এখনও বলেনি। যদিও উনি জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছিল, পরে বলবে। কিন্তু আর বলা হয়নি। আসলে আর একজন লোক, সম্ভবত ওই পুলিশআংকেলের বন্ধু, তিনি জখম হয়ে পড়ে আছেন দেখে পুলিশআংকেল এমন কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলেন, যেন বাচ্চা ছেলে। ততক্ষণে ওই লোকটি পগারপার।
লোকটিকে তার একেবারেই পছন্দ হয় না। হবে কী করে? যেমন কথা বলার ছিরি, তেমনই অভদ্র ব্যবহার। সকলের সঙ্গেই সে এমনভাবে কথা বলে, যেন এই চার্চের মালিক প্রভু যিশু নয়, সে-ই!
ফাদার… যে তাকে কেন পছন্দ করেন না, তা বোঝে না নুনিয়া। হতে পারে সে, নিয়মকানুন মানতে চায় না, যখন-তখন বেরিয়ে যায় চার্চের পিছনের দিকের পথ দিয়ে, ক্লাস করতে ভালো লাগে না তার, যাঁরা পড়ান, তাঁদের পড়ানোর মধ্যে সে কোন প্রাণ খুঁজে পায় না। তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগে প্রকৃতির মাঝে গিয়ে বসে থাকতে। জঙ্গলের জীবজন্তু, পোকামাকড়, এমনকি পিঁপড়ের কাছ থেকেও সে কত কিছুই শিখতে পেরেছে এ-জীবনে। আর জঙ্গলের মধ্যে বসে থাকতে গিয়েই তো সে জানতে পেরেছিল, তার মধ্যে সুপ্ত হয়ে থাকা সেই অদ্ভুত ক্ষমতাকে!

সেদিন জঙ্গলের অনেকটা ভিতরে একটা বেশ মোটা অর্জুন গাছের ডালে আধশোয়া হয়ে সে সাতপাঁচ ভাবছিল। ভাবার কী-আর শেষ আছে? কত কিছুই যে ভাবনা তার মাথার মধ্যে গজায়! সেদিন সে ভাবছিল, যদি তাকে বড় হয়ে এই চার্চের মধ্যেই তার পছন্দসই কোন কাজে ফাদার নিযুক্ত হতে বলেন, তাহলে সে কী করবে? কোন কাজ বেছে নেবে? প্রথম কথা, সে চার্চের কাজে নিযুক্ত হতে চাইবেই, কারণ, বাইরের দুনিয়া সে তেমন দেখে নি। জানেও না কীভাবে বাইরের দুনিয়ায় গিয়ে চলাফেরা, আচার-আচরণ করতে হয়। তার পক্ষে চার্চই সেফ। কিন্তু চার্চের মধ্যে কোন কাজে যুক্ত থাকার জন্য বেছে নিতে বললে সে কী নেবে, এটাই বেশ গোলমেলে প্রশ্ন। কী বাছবে সে? রান্নাঘরে হেল্পিং-হ্যাণ্ড হিসেবে কাজ ? না-কি চার্চের হাসপাতালের কোন কাজ ? ওরা হয়তো তাকে চার্চের হোস্টেল সুইপিং করার কাজে নিযুক্ত করতে চাইবে, কিন্তু ওই কাজটা তার মোটেও ভালো লাগে না। এখন যে সুইপিং ডিপার্টমেন্টের হেড, সেই দামোদর ডেভিড মুর্মুদা বলেছিল, “খবরদার নুনিয়া, বড় হয়ে এরা এই কাজ তোকে দিলেও তুই নিস না যেন ! এই কাজ একবার এরা যাকে দিয়ে করায়, অন্য কাজ সে শিখলেও তাকে দিয়ে আর করাবে না! যেন গন্দেগি সাফ করতে গিয়ে হামাদের ভিতরটায় ময়লা হয়ে গিয়েছে!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯০: দুই ভবানী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ

সত্যি! নুনিয়া দেখেছে, দামোদর ডেভিডদা সারাদিন ব্যস্ত থাকে, এমনকি সন্ধ্যের পরও, তবুও চার্চের লোকজনই তাকে এড়িয়ে চলে, তার সঙ্গে বসে খাওয়া তো দূর, ভালো করে কথা পর্যন্ত বলে না। অবশ্য কেবল তার সঙ্গেই নয়, যারা-যারা ওই একই কাজ করে, তাদের কারুর সঙ্গেই চার্চের কেউই ভালো করে কথা বলে না। এমনকি হোস্টেলের ছেলেমেয়েরাও নয়। অথচ তাদের সকলকে, নুনিয়াকেও, শুনতে হয়, ‘অনাথ, ফেলে দেওয়া বেজন্মার বাচ্চা’ জাতীয় বিশেষণ। যখন একজন বলে, তখন অন্য কেউ তার পাশে উপস্থিত থাকলে দাঁত বার করে হাসে। আর দামোদর ডেভিডদাএর সঙ্গে তো কথাই নেই ! ভালো ব্যবহার কেউই করে না। এমনকি ফাদারও না। অথচ, বর্তমান ফাদার রবিবাসরীয় উপদেশ দেওয়ার সময় সবাইকে বলেন, “প্রভু যীশুর চোখে ছোটবড় বলে কোন ভেদ নেই। সকলেই তাঁর সন্তান, অতএব সকলেই তাঁর দৃষ্টিতে সমান। কাউকে ঘৃণা করলে, প্রভুও তোমাকে ঘৃণা করবেন। আর কাউকে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে ধরলে, প্রভুও তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন।” অথচ নিজে যখন দামোদর ডেভিডদার সঙ্গে কথা বলেন, তখন কেমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তুই-তোকারি করেন!

আচ্ছা, বেশি বড় হলেই কি মানুষ অন্যরকম হয়ে যায় ? যেন একজন মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আর-একজন মানুষ?
সে সেদিন দামোদর ডেভিড মুর্মুকে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বলেছিল, “না না, একদম না। আমার সাফাইয়ের কাজ একেবারেই ভালো লাগে না। আমি অন্য কিছু করবো!”
“কী করবি ভেবে রেখেছিস নুনিয়া?” দামোদর ডেভিডদা জিজ্ঞাসা করে। সে সকলের সঙ্গে সমানভাবে কথা বলে বলে এরা সকলেই তাকে ভালোবাসে, স্নেহ করে।
নুনিয়া সেদিন মাথা নেড়েছিল। “এখনও ভাবিনি, তবে ভাবতে হবে !”
“ভেবে রাখিস। বড় হয়ে গেলে আর ভাববার সময় পাবি না!” বলেছিল দামোদর ডেভিডদা।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম

অর্জুন গাছের মোটা ডালের উপর শুয়ে সেকথাই ভাবছিল সে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়েই পড়েছে কে জানে। যদিও ঘুমের মধ্যেই সে ভেবে চলেছিল, বড় হয়ে তার কী হওয়া ভালো, কী-হওয়া ভালো নয়! একবার ভাবল, চার্চের অরফ্যানদের এই স্কুলে পড়াবে, তারপর বাতিল করে দিল নিজেই। পড়াতে গেলে অনেক পড়তে হয়, অত পড়া তার পোষাবে না। তারপর ভাবল, অরফ্যান-হোস্টেলে মেয়েদের উইং-এ সুপার হবে। চার্চের নিয়ম অনুযায়ী বয়েজ হোস্টেলে কখন ফিমেল সুপার থাকে না। ফলে নুনিয়া নিশ্চিন্তে শাসন-ত্রাসন চালিয়ে গোটা হোস্টেলকে একেবারে শান্তির অভয়ারণ্য করে তুলবে। সুপার হতে গেলে লেখাপড়া করতে হয়, এমনটি তার অভিজ্ঞতায় দেখেনি সে। অতএব এবারেরটা মনে ধরল। এখন বাকি, সুপার হতে গেলে তাকে কোন্‌ কোন্‌ ধাপে এগিয়ে যেতে হবে, সেটা জানা!

ভাবতে-ভাবতে কখন যে ঘুমের ঘোরে নীচে পড়ে গিয়েছে, তা সে নিজেও জানে না। সম্ভবত, উপর থেকে পরায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে। পরে যখন তার হুঁশ ফিরল নিজের থেকেই, তখন মাথার ডানদিকটা ফুলে উঠেছিল। চোখের সামনে ঘোলাটে-ঘোলাটে ভাব। কোনরকমে হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে যেতেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠেছিল সে। এইসময়েই সে তার নাগালের সামান্য এক ইঞ্চি দূরে অর্জুনগাছের মোটা গুঁড়িটা দেখতে পেল। দেখল সেই গুঁড়িতে অসংখ্য কালো পিঁপড়ে ব্যস্তসমস্তভাবে ঘোরাঘুরি করছে। অগুন্তি। কোথাও কোথাও ছোট দল-উপদল দেখতে পেলেও বাকি পিঁপড়েরা এলোমেলোভাবেই ঘোরাঘুরি করছিল। হয়ত ওরা রানি পিঁপড়ের গুপ্তচর কিংবা সৈনিক। পাহারা দিচ্ছে চারদিকে খেয়াল রাখতে রাখতে! অথবা রানির সাম্রাজ্যে সর্বদা যাতে আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকে, সেই দায়িত্ব পালন করছে। ওরা সকলেই পিঁপড়েদের প্রতিরক্ষাদপ্তরের কেরানী।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

সে নিজের মনেই বলল, এলোমেলোভাবে না-ঘুরে মাঝেমধ্যে বাকিদের সাবধান তো করতে পারো ? ইস্‌, যদি লেখাপড়া জানতো ওরা! সে ভাবল, তাহলে হাতে-হাতে পোস্টার লিখে রানির রাজ্যের নিয়মগুলি ওদের জানাতে পারত! আর নুনিয়ার নিজের যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে ওদের দিয়েই লিখিয়ে বাকিদের জানিয়ে দিত, কী-কী পালন করতে হবে, কী হবে না! এই ভেবে সে পিঁপড়েগুলির দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে অদের কার্যকলাপ দেখতে লাগল। এমনসময় ওর চারপাশটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে এল! মাথার মধ্যে কী যেন একটা ঘুরতে লাগল ! সে খালি দেখতে পেল, পিঁপড়েগুলি এলোমেলোভাবে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ যেন সারিবদ্ধভাবে নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর অর্জুনগাছের সাদাটে গুঁড়ির গায়ে কালো পিঁপড়েরা সারসার নির্দিষ্ট ক্রমে দাঁড়িয়ে যেন একটি লেখা ফুটিয়ে তুলল, “আমরা ঠিক আছি। ডোন্ট বি ওয়ারি!” পরমুহূর্তেই আবার ছড়িয়ে পড়ল তারা।

নুনিয়া প্রায় তড়াক করে উঠে বসেছিল। এ-টা কী হল? সে মনে মনে চেয়ে ওদের দিকে তাকাতেই ওরা গাছের গায়ে লেখা লিখে ফেলল! পিঁপড়ে কি লিখতে পারে? এরা তো দিব্যি লিখল। কিন্তু সে ভাবছে, কী করে তার ভাবনার সঙ্গে ওই পিঁপড়েদের ভাবনা মিলে গেল, যাতে নুনিয়া যা চাইল, গাছের গায়ে সেই ভাবনারই প্রতিফলন ঘটল।

প্রথম দিনের ঘটনার ব্যাপারে প্রথমদিন কাউকেই কিছু বলেনি সে। কী আর বলবে? এসবকে বলে কাকতালীয় ঘটনা। তা-না-হলে পিঁপড়ের লেখাপড়া শিখতে বয়েই গিয়েছে। আর তাছাড়া ওদের সমাজে মানুষের মতো লেখাপড়ার কোন চল আছে বলে বিশ্বাস করে না নুনিয়া। যাই হোক, প্রথমদিনের কথা ভুলেই গিয়েছিল নুনিয়া। কিন্তু এরপর থেকে একই ঘটনা বারবার যখন ঘটতে লাগল, তখন সে বুঝতে পারল, অর্জুনগাছের উপরের ডাল থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনায় তার মাথার ডানদিকে চোট লেগেছিল। বিরাট কোন চোট নয়, সাধারণ চোট। চোটের ধাক্কায় সে-তো চোখে সরষেফুল দেখছিল। এই চোটের ফলেই কি কিছু ঘটেছে ? তার ফলে তার আশেপাশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকামাকড়েরাও তার কথা শুনতে পাচ্ছে, বিশ্লেষণ করে অর্থোদ্ধার করতে পারছে এবং কোন নির্দেশ থাকলে সেই নির্দেশানুযায়ী আচরণ করছে।

নুনিয়া বিস্ময়ে হতবাক্‌ হয়ে গিয়েছিল। এমনও হয়! কিন্তু সে জানত, আপণা মাসেঁ হরিণা বৈরি ! তার নিজের অমন ক্ষমতা দেখা দেওয়ার ফলে, যাদের সে বন্ধু বলে ভাবত এতদিন, তারা সবাই মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাছাড়া এই ক্ষমতার কথা জেনে ফাদার কিংবা সাইকেল মাহাতো যদি ভালোমন্দ কিছু করে বসে, তা হলেই হয়ে গেল ! অতএব পাঁচবার একই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে, তখনই সে সিদ্ধান্ত নিল যে, এই অদ্ভুত ক্ষমতার কথা যেমন এতদিন গোপন করেছে, তেমনিই গোপন করে থাকবে। কারও জানবার দরকার নেই। তার নিজের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। প্রাকটিশ আবার কী? প্র্যাকটিশ করারও দরকার নেই। আগের ফাদার বলেছিলেন, “শক্তির কখনও অপপ্রয়োগ কিংবা অযথা প্রয়োগ—কোনটিই করতে নেই। তোমার-আমার—আমাদের সকলের প্রভু যিশু আগ বাড়িয়ে তোমায় যে শক্তি দিয়েছেন, তিনি নিশ্চয়ই কোন ভালোমন্দ ভেবেই দিয়েছেন। সুতরাং, তাঁর দেওয়া শক্তির সঠিক প্রয়োগের স্থান কোথায়, তা-তাঁকেই বুঝে নিতে দাও!”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন

অতএব, নুনিয়াও তার এই অদ্ভুত শক্তির কথা কাউকে বলেনি। মাঝেমধ্যে উপায় না-থাকলে শক্তির ব্যবহারও করতে হয়। একবার পিশাচপাহাড় রিসর্টে বন্ধ ঘরের এপার থেকে ওপারের দেওয়ালে ভয়াবহ একটা মুখ এঁকে সবাইকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল, যেন তারা ভয় পেয়ে পালায়। কারণ, সেদিনই জঙ্গলে সে শুনে এসেছে, একজন আর-একজনকে বলছে, “রিসর্টে আসা বিশেষ দু’জনকে একেবারে ফিনিশ করে দিতে হবে!” বলে ফিসফিস করে নাম বলেছিল। নামটা যদিও শুনতে পায় নি সে, তবুও অনুমান করে নিয়েছিল, এরা রিসর্টে কোন গোলমাল পাকানোর মতলবে আছে। শুনেই সে ভিতরে-ভিতরে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। ঘন পাতার প্রায়ান্ধকার আড়ালে থেকে সে যখনই শুনেছে এই কথা, তখনই সুযোগ বুঝে রিসর্টে ঢুকে পড়বে বলে ভেবে রাখল। সেইমতো রিসর্টে কোনভাবে সে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে এবং কয়েকটি ঘরে নক না করেই সাবধান করে দেয় তার উইল-পাওয়ার কাজে লাগিয়ে। কিন্তু ওরা বোকা ছিল, এত করেও একজনকে বাঁচাতে পারা গেল না!

অন্ধকার বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সেই কথাই ভাবছিল নুনিয়া। অনেকদিন হল, সে হোস্টেলে থেকেও একেবারে আলাদা ঘরে একা ঘুমায়। হোস্টেলসুপার ম্যামের দাবি, তা-না-হলে, নুনিয়া যে-ঘরে থাকবে, সে-ঘরের অন্য বোর্ডারেরা সব নষ্ট হয়ে যাবে। নুনিয়ার ভারি বয়েই গেছে, ওদের নষ্ট করতে! অন্ধকারে মুখে বেঁকায় নুনিয়া। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই “ক্যাঁচ” করে খুব হাল্কা একটা আওয়াজ হয়। প্যাসেজ থেকে স্বল্প আলোর ফালি ভিতরে এসে ঢোকে। কেউ কি তার রুমে ঢুকতে চাইছে? না-কি ঠিক করে লক করা হয়নি বলেই এই বিপত্তি? নুনিয়া আস্তে-আস্তে উঠে পড়ল। এত রাতে এভাবে ঢুকতে চাওয়ার অর্থ, যে-ই হোক-না-কেন, তার মতলব ভালো নয়। নুনিয়া মাথার বালিশটাকে কোনমতে চাদর চাপা দিয়ে নিঃশব্দে নেমে গেল বিছানা থেকে। এমনভাবে যাতায়াত তার কাছে কোন ব্যাপারই নয়! সে বাইরের আগন্তুক ঘরে ঢোকবার আগেই আস্তে আস্তে পা টিপে-টিপে দরজার পাল্লা যে-সাইডে খোলে, তার বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে রইল। দরজা আর-একটু ফাঁক হল, কেউ একজন ঢুকল। হাতে কিছু আছে। সে ঢুকে একপলক দাঁড়াল। নুনিয়ার বুক ঢিপঢিপ করছিল। কিন্তু সে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। আগন্তুক সম্ভবত কালো পোশাক পরে আছে, অন্ধকারের মধ্যে মিশে গেছে যেন। সেই অবস্থাতেই একসময় সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল, যেমন কোন বাঘ তার শিকারের দিকে পায়ে-পায়ে এগিয়ে যায়। আগন্তুকের লক্ষ্য নুনিয়ার বিছানা। সে ধরেই নিয়েছে, নুনিয়া এখন গভীর ঘুমে অচেতন। আর-কোন সম্ভাবনার কথা তার মাথাতে আসেও নি। আসা সম্ভবও নয়।

নুনিয়া এই অবসরে নিঃসাড়ে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। যে ঢুকেছিল, সে টেরও পেল না। প্যাসেজে ক্ষীণ আলো জ্বলছে। নুনিয়ার হাতে খুব কম সময়। সে যে বিছানায় নেই, তা ধরা পড়ে যাবে এক্ষুনি। তার আগেই তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। সে জানে, তাকে কোথায় যেতে হবে আর কীভাবেই বা যেতে হবে। সে শব্দ না করেও দ্রুত নেমে গেল দোতলায়। করিডোরে এখানেও ক্ষীণ আলো জ্বলছে। একেবারে প্রান্ত ঘেঁষে কমন টয়লেট। এর পাশেই পিছনদিক থেকে সাফাইকর্মীদের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া তা বন্ধ থাকে হুড়কো দিয়ে। এখনও ছিল। সেটা নিঃশব্দে খুলে সে বেরিয়ে গেল। এবার তাকে দ্রুত দৌড়াতে হবে। সে বুঝতে পারছিল, না-পালাতে পারলে তার সামনে গভীর বিপদ। সে ধরা পড়ে গিয়েছে ! —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content