বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা ও বিপ্লবকুমার দেব (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী)।

সুদীর্ঘকাল ব্যাপী বামফ্রন্ট শাসনের অবসানের পর যখন ভিন্ন দলের কোনও সরকার আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই জনগণের প্রত্যাশার মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। ত্রিপুরার ক্ষেত্রেও ২০১৮ সালে তাই ঘটেছিল। পঁচিশ বছর একনাগাড়ে শাসনের পর বামেরা তখন বিরোধী আসনে। ক্ষমতায় বিজেপি জোট। আর কংগ্রেস বিধানসভার ভোটে নিশ্চিহ্ন!

সরকার পরিবর্তনের পর প্রথম কয়েক মাস যে ভাবে কাটে ত্রিপুরাও সে ভাবেই কাটাল। নতুন মন্ত্রীদের ভাষণ-বক্তৃতা আর বিগত দিনের শাসকদের সমালোচনা। সেই সঙ্গে নবাগতদের নানা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। ওরা কিছু করেনি, আমরা অনেক কিছু করব-চলতে থাকল এই সব ভাষণ। কিন্তু এই ভাবেতো আর দীর্ঘদিন চলতে পারে না!

বিজেপি জোট সরকার ধীরে ধীরে কিছু কিছু উন্নয়ন কাজকর্ম শুরু করল। ঘোষিত সপ্তম পে কমিশনের প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি রূপায়ন না হলেও কর্মচারীদের কিছু আর্থিক সুবিধা দিল সরকার। রাজ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নানা কর্মসূচি রূপায়িত হতে থাকল। কাজ শুরু হল পর্যটনের উন্নয়নেও। হস্ততাঁত ও কারু শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়নের উদ্যোগ নেওয়া হল। কিন্তু সরকারি চাকরি কিংবা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যেন অধরাই রয়ে গেল। রাজ্যের বিপুল সংখ্যক কর্মপ্রার্থীদের একাংশের মনে ধীরে ধীরে মোহভঙ্গ ঘটতে শুরু হল। ঠিক এই সময়টাতেই রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের কিছু অপ্রয়োজনীয় আলটপকা মন্তব্য ঘিরে রাজ্য ও বহির্রাজ্যের সংবাদ মাধ্যমে ঝড় উঠতে শুরু করে। বিরোধীরা এই সব ইস্যু করে বাজার গরম করার চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি! এদিকে শাসকদল বিজেপি’র মধ্যেও শুরু হয়ে যায় কিছুটা অন্তর্কোন্দল।
মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লববাবুর বিরোধী মুখ হয়ে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুদীপ রায়বর্মণ। উল্লেখ করা যায় যে, ত্রিপুরাতে বিজেপি’র তেমন কোনও সংগঠন আগে ছিল না। ২০১৪ সালে দেশের ক্ষমতায় বিজেপি আসার পর ত্রিপুরাতেও বিজেপি’র সাংগঠনিক তৎপরতা গতি পায়। রাজ্যের যেসব কংগ্রেস বিধায়ক এক সময় তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন তারা সবাই সুদীপবাবুর নেতৃত্বে বিজেপি’তে যোগ দেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সুদীপবাবু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। কিন্তু দিনে দিনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুদীপবাবুর ব্যবধান বাড়তেই থাকে। এক সময় মন্ত্রীত্ব থেকে অপসারিত হন সুদীপবাবু। তারপর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তার সংঘাত বাড়তেই থাকে। সুদীপবাবু তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামী বিধায়ক আশিস সাহাকে সঙ্গে নিয়ে বিপ্লব দেব নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে থাকেন। রাজ্যবাসীর মনে তখন এই রকম একটি ধারণা গড়ে উঠতে থাকে যে, সুদীপবাবুদের বিজেপি ত্যাগ সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-১৯: বিজেপি’র উত্থান, বামফ্রন্টের পতন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

২০২০ সালের শুরু থেকেই কোভিড সংক্রমণে প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ে দেশ। ত্রিপুরাও তখন সারা দেশের সঙ্গে ব্যস্ত কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইতে। রাজ্যের বিপ্লব দেব নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট সরকার তখন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কোভিডের মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা প্রশংসা দাবি রাখে। করোনা টিকাকরণের ক্ষেত্রেও এগিয়ে থাকে রাজ্য।

যাইহোক, ত্রিপুরার রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ঘটতে থাকে নানা পরিবর্তন। রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায় বিজেপি’র জোট সঙ্গী জনজাতি ভিত্তিক আঞ্চলিক দল আইপিএফটি’র প্রভাব দ্রুত কমতে থাকে। সেখানে নতুন জনজাতি ভিত্তিক দল তিপ্রা মথার প্রভাব বাড়তে থাকে। রাজ্যে ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডে’র শ্লোগান তুলে পাহাড়ে পাহাড়ে জনজাতিদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনা সৃষ্টি করে তারা। এমন কি, নির্বাচনের মাধ্যমে জনজাতি স্বশাসিত জেলা পরিষদের ক্ষমতাও দখল করে নেয় তিপ্রা মথা। দিনে দিনে তিপ্রা মথা যেন এক বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৪: লোকশিক্ষক মা সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী

একদিকে তিপ্রা মথার অভ্যুদয় এবং অপরদিকে কংগ্রেসের সঙ্গে সুদীপবাবুদের সখ্যতা বৃদ্ধি যেন রাজ্যে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ উস্কে দেয়। একসময় সুদীপবাবু ও আশিস সাহা বিধায়ক পদ ও বিজেপি ত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দেন। আইপিএফটি’র এক বিধায়কও দলত্যাগ করে যোগ দেন তিপ্রা মথায়। সব মিলিয়ে ত্রিপুরার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চলতে থাকে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা। রাজ্যের সিপিএম, কংগ্রেস, তিপ্রা মথা-বিরোধী দল সমূহের মধ্যে আগামীদিনে ঐক্যের এক সম্ভাবনাও ঝিলিক দিয়ে উঠে।

সুদীপবাবুদের কংগ্রেসে যোগদানের পর কংগ্রেসে যেন নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয়। রাজ্যের নানা প্রান্তে কংগ্রেসের নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি রূপায়িত হতে থাকে। সিপিএম দলও তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। সে সময় কোভিডের প্রকোপও অনেকটাই কমে এসেছে। দেশ ও রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষেরই টিকাকরণ হয়ে গিয়েছে। দেশের আর্থিক অবস্থারও উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটছে। ত্রিপুরারও সামগ্রিক অবস্থা ভালোই বলা যায়। কিন্তু হঠাৎ এ কি! বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত!
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসাসা— নুনিয়া ও সিঙ্গরা

দিনটি ছিল ২০২২ সালের ১৪ মে। বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব পদত্যাগ করলেন। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজ্যের রাজনৈতিক মহলের সবাই একেবারেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এই খবরে। প্রথমে অনেকের কাছেই তা অবিশ্বাস্য মনে হল। ক’মাস আগেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগরতলায় এক অনুষ্ঠানে বিপ্লববাবুর পিঠ চাপড়ে প্রশংসা করেছেন। আর এখন তাকেই কিনা সরিয়ে দেওয়া হল! কিন্তু ঘটনাতো ঘটনাই! বিপ্লববাবু পদত্যাগ করেছেন এটাই হচ্ছে শেষ কথা। সেদিনই দিল্লি থেকে সরকারি ও দলীয় কাজ সেরে বিপ্লববাবু আগরতলায় আসেন। এসেই পদত্যাগ করে সেই ঘোষণা দেন তিনি।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

বলাই বাহুল্য, বিপ্লববাবুর পদত্যাগে রাজ্য রাজনীতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকরা ভিড় জমান বিপ্লববাবুর সরকারি বাসভবনে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দলীয় নির্দেশে প্রশাসনিক কাজ থেকে দলের সাংগঠনিক কাজে ফিরে যাচ্ছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের পর সে-দিনই বিজেপির পরিষদীয় দলের বৈঠকে নেতা নির্বাচিত হন বিজেপি’র তদানীন্তন প্রদেশ সভাপতি ডাঃ মানিক সাহা। পরদিন রাজ ভবনে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু বিপ্লব দেব মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেন কেন? এটা তো সবাই জানে যে, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্ব এমন নির্দেশ দিলেনই বা কেন? দুর্নীতি? দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ? প্রশাসন পরিচালনায় তাঁর ব্যর্থতা? কিন্তু পরবর্তী সময়ের ঘটনা প্রবাহে সে সব সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বিপ্লববাবুর অপসারণ যেন আজও রহস্যাবৃত। —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content