রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক বিভাগের আলাদা আলাদা এক বা একাধিক ভবন রয়েছে। প্রত্যেক বিভাগের অধ্যাপক-সহ অন্যান্য কর্মচারীদের নির্দিষ্ট ভবনে ঢোকার জন্য অ্যাকসেস কার্ড আছে। বিকেল পাঁচটার পরে যখন সমস্ত ভবন বন্ধ হয়ে যায়, তখন ঢুকতে গেলে ওই অ্যাকসেস কার্ড ব্যবহার করে ঢুকতে হবে। অবস্থানের খাতিরে আর যেটা বলে নেওয়া দরকার সেটা হল, আমার প্রযুক্তি বিভাগ থেকে ভূ-তাত্ত্বিক বিভাগ প্রায় এক মাইল মতো চড়াই রাস্তা। এই একমাইল চড়াই-উতরাই রাস্তা পেরোতে গিয়ে প্রথম বছর শীতকালের ঠান্ডায় আমার যে কি অবস্থা হয়েছিল আর কীভাবে যে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছিলাম সে কথা বলবো পরের পর্বে।
এখন শুধু এটাই বলার যে, এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় আমি এর আগে কখনও দেখিনি। এটা ভেবে প্রথমেই বেশ অদ্ভুত লাগল যে পৃথিবীর এই প্রান্তে, যেখানে কোনও মানুষজনই প্রায় নেই সেখানেও কি বিশাল কর্মকান্ড চলছে। দ্বিতীয়ত, প্রাগৈতিহাসিক থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক সবকিছুরই কি অদ্ভুত সংমিশ্রণ। আমার ভাবতেই বেশ ভালো লাগল যে এটাই পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যাদের নিজেদের রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র রয়েছে। আবার তারই আনাচেকানাচে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সাক্ষ্য পড়ে রয়েছে। সবশেষে এখানকার অদ্ভুত প্রকৃতি তো আছেই। এখান থেকেই দেখা যায় মধ্য রাতের সূর্য আবার মেরুজ্যোতি। সব মিলিয়ে যেন একটা অদ্ভুত অচেনা অজানা জগৎ।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩৭: এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র রয়েছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?

যাই হোক, পরবর্তীকালে যখন পাকাপাকি ভাবে এই শহরে চলে এলাম তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রযুক্তি বিভাগ থেকে মাইল তিনেকের মধ্যেই একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম আমি থাকার জন্য। সেরকম দেখতে গেলে, এই শহরে সব কিছুই মাইল তিন চারেকের মধ্যেই অবস্থিত। বলাই বাহুল্য যে, কোনও যানজটের বালাই নেই। যানই নেই অত, তার আবার জট। অতএব যেকোনও জায়গায় যেতে সময় লাগে ৫-১০ মিনিট বা বড় জোর ১৫মিনিট। অর্থাৎ নিজের কাজ কর্ম করার জন্য অগাধ সময়। শুধুশুধু রাস্তায় বিরক্তিকর ভাবে দাঁড়িয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে সময় নষ্ট হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। আর আমি কোনওদিনই যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা একদম সহ্য করতে পারিনা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

যদিও কলকাতা-হাওড়া থেকে এসে আমার একথা বলা মানায় না। কিন্তু আমার মনে হয় এই অসহনীয়তার জন্য হয়তো আমার ছোটবেলার কিছু অভিজ্ঞতা দায়ী। আমি রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্রাবাসে যাওয়ার আগে যথাক্রমে হাওড়া জেলা এবং হেয়ার স্কুলে পড়তাম। আমার মা-বাবার চিরকালই ইচ্ছা ছিল যে ছেলে একটু ভালো নামজাদা কোনও বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে। এদিকে আমাদের বাড়ি ছিল আন্দুলে, হাওড়া থেকে ট্রেনে করে প্রায় ৪৫ মিনিট। আর তখন এতো স্কুল-বাস বা কার-পুল হয়নি। কাজেই সেই ভোর বেলা স্কুলে বেরোতাম।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

হেয়ার স্কুলে পড়ার সময় তখন রবীন্দ্র সেতু অর্থাৎ হাওড়া ব্রিজে কাজ চলার জন্য সবসময় সেখানে যানজট। সারা রাত কাজ চলতো আর ভোর বেলায় ভোর বেলায় সমস্ত মালবাহী গাড়ি বা লরিগুলো বড়বাজারের মুখে একসঙ্গে ঢুকতে গিয়ে পুরো যানজট। একটা গাড়িও একচুল নড়তোনা। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে। আমাকে প্রায় দু’ বছর অর্থাৎ তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণিতে যখন আমি হেয়ার স্কুলে পড়তাম; ওই সময় হাওড়া থেকে কলেজস্ট্রিট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার মতো মাঝে মাঝেই হেঁটে যেতে হতো। কখনও কখনও অতটা না হলেও চিৎপুর অবধি প্রায় তিন কিলোমিটার মতো তো হাঁটতেই হতো। রাস্তার মধ্যে সব গাড়ি পরপর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর আমার মা হেঁটে চলেছি। কী হয়রানি। তার ওপরে আন্দুলের কাছে মৌড়িগ্রামে তখন রেললাইনের ওপরে তখন যানবাহন চলাচলের সেতু নির্মিত হয়নি। কাজ চলছে তখন। সেই কাজের জন্য যানবাহন চলাচলের রাস্তার অর্ধেকটা বন্ধ থাকতো। তার ওপরে যখন ট্রেন যেত তখন গেট বন্ধ থাকতো। সব মিলিয়ে মাঝে মাঝে বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ও দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

আমার এখনও মনে আছে যে মাঝে মধ্যেই বাসের সব যাত্রীই বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করে দিতো ওই যানজট ছাড়ার অপেক্ষা না করে। আমি তখন ছোট। অনেক সময়েই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। তাই, মাঝে মধ্যেই এরকম হতো যে গোটা বাসে আমি আর আমার মা একা বসে আছি। আর আমি জেগে থাকতে না পেরে বাসের পেছনের লম্বা বসার জায়গাটায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। আন্দুল এলে মা ডেকে দিত। মানে হয়রানির চূড়ান্ত। ছোটবেলা থেকে এমন সব অভিজ্ঞতার কারণেই যানজট ব্যাপারটা আমি একদম সহ্য করতে পারি না। একটুক্ষণ গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেই আমি বিরক্ত হয়ে যাই। ঠিক এই কারণের জন্যই আমি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বড় শহরেও আমি থাকতে চাইনি কখনওই। কারণ এখানকার খুব বড় শহর গুলোতেও যানজট কিন্তু বেশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে অনেক সময়েই। সত্যি কথা বলতে কি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সানফ্রান্সিসকো, নিউ ইয়র্ক সিটি, বস্টন, শিকাগো, এই সব শহরের যানজট কলকাতা-হাওড়ার যানজটের থেকেও সাংঘাতিক।—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska): ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।

Skip to content