শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

সত্যব্রত এক মুহূর্তে কাঠ হয়ে গেলেন। নুনিয়াকে কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে দেখে ফেলেছে। ফাদার আগেই বলেছিলেন যে, নুনিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাওয়া যাবে না, যা জিজ্ঞাসা করবার ফাদারের মারফৎ জানতে হবে। কিন্তু ফাদারের ঘর থেকে বেরিয়েই চার্চের নিজস্ব এলাকার মধ্যে দাঁড়িয়ে যে ভাবে তিনি নুনিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন এখন, যে-কোনও মানুষেরই তা চোখে পড়বে, পড়তে বাধ্য! চার্চে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা হরবখত আসছেন, যাচ্ছেন। তাঁদের কারও চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই। সত্যব্রত এই অনাথ মেয়েটির জন্য করুণা অনুভব করলেন। এমনিতেই চার্চের বেশিরভাগ লোকই নুনিয়াকে পছন্দ করে না। তার উপর আজকেও সারা বেলা নুনিয়া তার নিজের মর্জিমাফিক ঘুরে বেড়িয়েছে, চার্চের স্কুলে পড়তে গিয়েছিল বলেও মনে হয় না, খাবারটুকুও খেতে আসেনি—ফলে কঠিন শাস্তি দিতে পারলেই এখানকার লোকজন খুশিই হবে। ফাদারের কানে উঠলে ফাদার হয়তো ক্রুদ্ধ হবেন, সত্যব্রতকে এই চার্চে আর না-ও ঢুকতে দিতে পারেন। পাশাপাশি, নুনিয়াকে শাস্তি না-দিয়েও স্বস্তি পাবেন না।
সত্যব্রত নীচু গলায় বললেন, “নুনিয়া, ওরা তোমার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দেখে ফেলেছে!”
“হ্যাঁ”, নুনিয়া স্বাভাবিক গলায় বলল, “এখানে অরফ্যানেজ হোমের কারওই বাইরের কোনও ভিজিটরের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই। আমার তো নেই-ই!” তার গলার স্বরে এক প্রবীণ প্রাজ্ঞ মানুষের আদল।
“তাহলে কী হবে? একটু আগে ফাদারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম নুনিয়া। তোমার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চাইতেই গিয়েছিলাম। উনি দেননি!”
“ফাদার যে-কাউকেই আমার সঙ্গে দেখা করতে কিংবা কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন, আসলে তাহলে আসা-যাওয়ার ব্যাপারটা সকলে জেনে যাবেন, সে জন্য!” —এমনভাবে কথাটা বলল নুনিয়া, যেন এই নিষেধাজ্ঞা সে মেনে নিয়েছে। এবং তাতে তার কোন অসুবিধাও নেই।
সত্যব্রত একটু অবাক হলেন। নুনিয়ার আসা-যাওয়ার ব্যাপারটা সকলে জেনে গেলে কী ক্ষতি হবে? চার্চের নিয়মকানুন তেমন জোরদার কিছু নয়, শিথিল—সকলে এমন ভাববে? ভাবুক না! কে জানে, গোটা ব্যাপারটা নিয়ে ফাদার এবং চার্চের সকলের বজ্র আঁটুনি মনোভাব অপ্রয়োজনীয় এবং বালখিল্য আচরণ বলে মনে হল।
এমন সময় প্রশ্নকর্তা স্বয়ং হাজির হল। তবে একা নয়, সঙ্গে আর-একজন আছে, যাকে সত্যব্রত চেনেন না। কথাবলায় ব্যস্ত থাকায় তিনি এতক্ষণ প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে দেখেননি। এখন দেখে বুঝলেন, তার চেনা লোক। খানিক আগে দেখাও হয়েছে। সাইকেল মাহাতো। সঙ্গের লোকটিকে চেনেন না, তবে দেখলে তুতো ভাই বলে মনে হয়।
সাইকেল অবশ্য তাঁকে দেখেও দেখল না যেন, সরাসরি নুনিয়াকে জিজ্ঞাসা করল, “অ্যাই নুনিয়া, তু কী কথা বলছিলি রে?”
“কেন?” নুনিয়া শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করে?”
“ক্যানে? আবার মুখে মুখে তর্ক করে? ফাদারকে বললে তুয়ার দিল্লাগি ঘুচিয়ে দেবেন তখন বুঝবি!”
সত্যব্রত বিরক্ত হলেন। সাইকেল তাঁকে যতই অস্বীকার করার ভান করুক, আদতে বেশ উত্তেজিত এবং শঙ্কিত। নুনিয়ার কোন দোষই নেই, সে যেখানেই যাক, আপনমনে ফিরছিল, তিনিই ডেকে তার সঙ্গে কথা বলেছেন, এখন সে যে গালমন্দ শুনছে এর-ওর কাছ থেকে, তার জন্য তিনিই দায়ী। অতএব তাঁর চুপ করে থাকা ভালো দেখায় না। তিনি বললেন, “সাইকেল, নুনিয়ার সঙ্গে আমি কথা বলেছি, কিছু জিজ্ঞাসা করার থাকলে আমাকে কর!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪৫: নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায়

সেদিন ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন আনন্দ দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সিনেমাপ্রেমী থেকে বরেণ্য সেই পরিচালককে

সাইকেল যেন এই প্রথম তার উপস্থিতি টের পেল, বলল, “ও আপনি চলে যাননি এখনও? ফাদার কিন্তু শুনলে ভারি রাগ করবেন। উনি শুনলাম আপনাকে চলে যেতে বলেছেন? নুনিয়ার সঙ্গে কথা বলতেও বারণ করেছেন?”
“বাহ! বাহ! ফাদার দেখছি তোমার ইয়ার-দোস্ত গোছের। যার সঙ্গে যা যা কথা হয় তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে না বলে থাকতে পারেন না? ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং!”
একটু থতমত খেল সাইকেল। বলল, “ফাদার কেন বলবেন? আমি কি তাঁর নখের যুগ্য? ঘরে তো অন্য লোকও ছিল, না কি? সেই বলছিল, দেখা হল।”
“বুঝলাম। কিন্তু তুমি তো বলেছিলে, কাজ আছে। চলেও গিয়েছিলে? আবার ফেলে এলে যে বড়?”
“পেটের দায়ে ডাগতারবাবু, পেটের দায়ে। পাপী পেট কা সওয়াল! একটা জরুরি চালান নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওটা না নিয়েই কাল যদি কলকাতা চলে যেতাম, তাহলে ফিরে আসতে হতো। অর্ডারের কপি, চালান—এসব না নিয়ে গেলে গোটা দিনটাই বেকার নষ্ট হতো। ফিরে আসতে হত খালি হাতে!” বলে তার নজরে পড়ল নুনিয়া তখনও দাঁড়িয়ে, দেখেই সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, বলল, “অ্যাই, তুই এখুনো দাঁড়্যে আছিস যে, যা ভাগ, ভাগ শালি!”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৫: ঠাকুরবাড়ির দখিনা বাতাস— জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

নুনিয়া আর দাঁড়াল না। প্রত্যুত্তরেও কিছু বলল না, সত্যব্রতর দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। সত্যব্রতর মনে হল, মেয়েটি তাঁকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারছে না। চারিপাশে যা অযুত পাহারা। মেয়েটি যেন অশোকবনের সীতা।
সত্যব্রত জিজ্ঞাসা করলেন, “সাইকেল, এই নুনিয়া কেউ হয় তোমার?”
সাইকেল অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাল, বলল, “না তো! ও কেন কেউ হতে যাবে?”
“নাহ্‌, তুমি যেভাবে হুমকি দিচ্ছ, গালিগালাজ করছ, তাতে মনে হচ্ছে, নুনিয়া তোমার কেনা গোলাম-চাকর-বাকর গোছের কেউ!” সত্যব্রতর গলার স্বর গম্ভীর।
সাইকেল কী মনে হল গলাটা একটু নামাল, “কী যে বলেন ডাগদার বাবু! নুনিয়া এমনি ঢ্যাঁটা যে মিষ্টি কথায় বললে শুনবে না!” বলে কাষ্ঠহাসি হাসবার চেষ্টা করল।
“বলে দেখেছ? আর তুমি তো চার্চের নিয়োগ করা কর্মচারী নয়, তাহলে তোমার কোনও অধিকার আছে কি ওই বাচ্চা মেয়েটির সঙ্গে এমনভাবে কথা বলার?”
“এখন নেই ঠিক কথা। কিন্তু শিগ্‌গিরি হয়ে যাবে। তখন ও শালীকে ঠিক ঢিট করে ফেলাবোক!”
“কী ভাবে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সত্যব্রত।
“এই যে দেখছেন একে”, বলে তার পাশে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখিয়ে বলল সাইকেল, “ইয়াঁর নাম মঙ্গল মাহাতো, আমার মামাতো ভাই। নুনিয়ার সঙ্গে উয়ার বিহা হবেক। ফাদার কথা দিয়েছেন। এর ঘরে এখন মেয়েছেলের খুব দরকার। বউটা মরে গেছে দু’ বচ্ছর হল। ঘরে দু’-দুটো বাচ্চা। তাদের দেখভাল করার মতো মেয়েছেলে তো চাই? বিহা যখন করতেই হবেক, তখন নুনিয়ার সঙ্গে করাই ভালো। জানেন তো” বলে যেন খুব অশ্লীল কথা বলছে এমনভাবে তাঁর কানের কাছে মুখ এনে বলল, “পাড়ার কয়েকজন বলাৎকার করেছিল উয়াঁরে। ভিতরে কী-সব কেটে বাদ দিয়েছে শুনি ছিলাম। আর কুখনও মা হতে লারবেক। মঙ্গলের তাতে শাপে বর হয়েছে, কী বলেন। নিজের বাচ্চা হলে ওই নুনিয়া ভাইয়ের আগের বউটার বাচ্চাগুলাকে দেখত না মোটেই। সেই জন্যই তো নুনিয়াকে পেয়ে আমাদের ভালো হয়েছে!”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: স্বপ্নে আমার মনে হল

সত্যব্রত হতভম্ব হয়ে গেলেন। নুনিয়ার সঙ্গে সাইকেল তার তুতো ভাই মঙ্গল মাহাতোর বিয়ে ঠিক করেছে? এই খবর নুনিয়া জানে তো? ফাদার এই কথাটা কেন চেপে গেলেন? এই জন্যই কী এখনই বিয়েটা হচ্ছে না যে, ফাদার রডরিগ অসুস্থ। তিনি জানলে এই অল্প বয়সে নুনিয়ার বিয়ে দেওয়াটা আটকাবেন। কারণ, নুনিয়াকে তিনিই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে উদ্ধার করে নবজীবন দান করেছেন, তাঁর অধিকার কম নয়। তাছাড়া নাবালিকাকে বিবাহ দেওয়া আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। ফাদার আন্তোনিও কি দেশের আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়?
মঙ্গল মাহাতোর দিকে তাকালেন সত্যব্রত। লোকটার বয়স হয়েছে। পাকানো দড়ির মতো চেহারা। দেখেই মনে হয় গাঁজা-মদে সুযোগ পেলেই চুর হয়ে পড়ে থাকে। চেহারা অমার্জিত, গুটকা খাচ্ছে। লাল-নীল-কালো-হলুদ ফুল তোলা ছিটের সাদা জামার বুকের কাছে পান-গুটকার পিকের ছিটে। মাথার চুল অবশ্য বাহার করে ছাঁটা। এত বয়স্ক একজনের সঙ্গে নুনিয়ার বিয়ে দিচ্ছেন ফাদার, হলই বা তার শরীরে কিছু সমস্যা আছে, তা বলে সে বিয়েই কেন করবে? মেয়েরা কী কেবল বিবাহ-সন্তানজন্ম-প্রতিপালন ইত্যাদির মেশিন হিসেবেই থেকে যাবে? মঙ্গল মাহাতো কিংবা সাইকেল না হয় অশিক্ষিত, কিন্তু ফাদার এবং চার্চের বাকিদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে পারলেন না তিনি।
ভেবেছিলেন চলে আসবেন, কিন্তু একটা মিথ্যে না বলে চলে এলে খারাপ দেখায়, সেজন্য বললেন, “বাহ্‌, খুব খুশি হলাম। মেয়েটর ভাগ্য ফিরবে তাহলে!”
সাইকেল একটু প্রীত হওয়ার ভান করল যেন, “তবেই বুঝুন ডাগতার বাবু ! আগেই বলেছিলাম আপনাকে! সাইকেল মিছা বাত বলে না!”
“তাই তো দেখছি। দেখ, নুনিয়া তো মাজে মাঝে আমার পাড়ায় যায়, বহুকাল যায় নি, কেন সে-কথাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।”
“ঝুট বাত্‌! আপনি ওই বুধন মাহাতোর ব্যাপারে নিশ্চয়ই পুছতাচ করছিলেন। আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। কেন ওই ব্যাপারটা নিয়ে পড়ে আছেন ডাগদার বাবু? বুধনের বাবা-মার দোষ। নিজের ছেলেকে তোরা চিনতে পারলি না কেন? মানলাম, দুজনের চোখের অসুখ। প্রায় দেখতেই পায় না ভালো করে কিছু। কিন্তু তা বলে…” কথাটা অসমাপ্ত রেখে সাইকেল বলল, “তবে আপনি উয়ো কেস থেকে সরে আসুন ক্যানে? তা না হলে খুব বিপদে পড়বেন। কালাদেওর অভিশাপ একবার আপনার উপর পড়লে কারুর সাধ্যি নেই যে আপনাকে বাঁচায়! তার চেয়ে নিজের মতো থাকুন না, ডাগদারি করুন। ফল ভালো হবে!” বলে সে আর দাঁড়ালো না, সাইকেলে চড়ে ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তার ভাইয়েরও নিজস্ব সাইকেল ছিল। সে-ও বেরিয়ে গেল।
সত্যব্রত হতভম্ব হয়ে ভাবছিলেন, সাইকেল কি তাঁকে প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দিয়ে গেল? কিন্তু কেন?—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content