রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


এ বারে দুর্গোৎসব টাকিতে কাটালাম। দু’ দেশের ভাসান দেখার টানে। সঙ্গে আশেপাশের রাজবাড়িগুলোর ঐতিহ্যমন্ডিত পুজো। ইছামতীর পারে ভাঙনে পরা রাজবাড়ির পুজো দেখে শুরু হল। রাজবাড়ি এখন নবনির্মাণের পর গেস্ট হাউস। ভাঙনে পরার শেষ অংশকে আঁকড়ে রেখেছে এক প্রাচীন বটগাছ। গাছ রয়েছে একখণ্ড দেওয়াল আঁকড়ে। কেউ কাউকে যেতে দেবে না। অবাক হয়ে সে বিশাল মহীরুহকে দেখলাম। মস্ত ডালপালা বিছিয়ে ভাঙা বাড়ির অংশ জড়িয়ে যেন একে অপরকে বলছে যেতে নাহি দিব।
রাজবাড়ির ঠাকুর দালানটি প্রাচীন। একচালার ঠাকুর। পুরোনো মস্ত পিলসুজ। বাসন-কোসনও। বাড়ির লোকেরাই পুজোর আয়োজনে। রাজবাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন অংশ পুবের বাড়ি বলে বিদিত। খানিকটা এগিয়ে সেটি। তিনশ দু’ বছর হল সে পুজোর। মস্ত ভাঙা রাজবাড়ির অংশ। একতলা ইট বার করা দালান। তারই এক দিকে ঠাকুর দালানে পুজো হচ্ছে। শুনলাম একসময় সেখানে মহিষ বলি হতো।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১২: নেতারহাটের নাশপাতি বাগান

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?

আরেকটি বাড়িতে পুজো হয়। ঘোষবাড়ি। সেটিরও ভগ্নদশা। শুধু পুজোর সময় বাড়ির লোকেরা এসে একটু মেরামত করে সাবেকি পুজো বজায় রাখে। ঠাকুরদালানের ভাঙা বারান্দার এক কোনে ঘাসের মতো ছোট ছোট গাছে লাল ফুলে ভরে গিয়েছে। কি সুন্দর লাগলো। মনে হয় তারা এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। নাই বা রইল রাজ্যপাট, লোকলস্কর। মা আসছেন বছর-বছর। তাই ছোট্ট ফুলেরাই আঙিনা ভরিয়ে দিয়েছে।
নবমীর সকালে গেলাম ধান্যকুরিয়ার জমিদার বাড়ির পুজো দেখতে। ওখানে তিনটি সম্পন্ন বাড়িতে পুজো হয়। এ বারে দুটি বাড়িতে হয়েছে। গায়েনবাড়ি ও বল্লভ বাড়ি। একটু পর পরই মস্ত সব জমিদার বাড়ির মতো বাড়ি। আমরা ভাবছি পাশাপাশি সবাই কি জমিদার ছিল? আসলে তা নয়। সবই সম্পন্ন ব্যবসায়ী বাড়ি। সঙ্গে অনেক জমি জায়গাও ছিল।
ওখানকার লোকেরা বলে বাবুদের বাড়ি। একই রকম মস্ত বাড়ি। মাঝখানে বাঁধানো উঠোন আর চারদিক ঘিরে দোতলা বাড়ি। একদিকে ঠাকুর দালান। খড়খড়ির জানালা। লম্বা টানা বারান্দা। লাল রঙের। এক বাড়ির ঠাকুর দালানের সামনে আবার পুজোয় পাওয়া সেরার পুরস্কারের সব পদক সাজানো। খুব ভালো লাগলো সাবেকি বাড়ির পুজো দেখে। এ বাড়িগুলো দেখে গেলাম আরবেলিয়ার বসুবাড়ির পুজো দেখতে। সেটি ও অনেক প্রাচীন পুজো। রোজ বলি হয় শুনলাম। একটি ভেড়া ও একটি ছাগল বাঁধা আছে দেখলাম সেদিন। বসুবাড়ির সামনেই আরেকটি বাড়িতেও পুজো হয়।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস

বাড়ির লোকজন দেখে মনে হল সবাই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন নিজেদের ভিটেতে। পুজোর কটা দিন একসঙ্গে আনন্দ করবেন। শহরের জাঁক জমকের পুজো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এগুলো। নিয়ম নিষ্ঠার প্রতি বেশি নজর এদের। বছরে একবার বাড়িগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে সেজে ওঠে। মানুষের কোলাহলে মুখর হয়। আলো, ঢাকের বাদ্যে, ট্রাডিশনাল সাজে পুরোনো দিনকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা। দু’ একটা বাড়িতে দেখলাম বাড়ির প্রবীণ মানুষ ঠাকুরদালানে চেয়ার এ বসে সব নির্দেশ দিচ্ছেন। খুব ভালো লাগলো। মনে পড়ল আমার বাড়ির এক বয়োজ্যেষ্ঠ র উপদেশ—বড়দের অভিজ্ঞতা ও ছোটদের কর্মক্ষমতা একসঙ্গে হলেই কোনও কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়।
আসলে আমরা গিয়েছি বিসর্জন দেখতে। শুনেছিলাম সেদিন দু’ দেশের বর্ডার এর বাঁধন খুলে সবাইকে এক হতে দেওয়া হয়। একই নদীতে বিসর্জন হয়। পিতৃপুরুষের ভিটের দেশ। এক সুন্দর আশা নিয়ে গিয়েছি এ বার। দশমীর সকালেই সে ইলিউশন প্রথম ধাক্কা খেল যখন দেখলাম নদীর ওপর দশ-পনেরো নৌকো সাজিয়ে জলকেও ভাগ করে দিল বিএসএফ।
নদীর জলের ওদিক তোমাদের এ দিক আমাদের। কেউ কারও দিকে আসবে না। বাইনোকুলার নিয়ে গেস্ট হাউসের ছাতে বসে আছি। প্রাণপণে দেখছি ও দেশ। বাপ ঠাকুরদার দেশ। কী করে রাজনীতির খেলায় ওদেশ হয়ে গেল। ওপারে আস্তে আস্তে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক জড়ো হতে লাগলো। দুর্গা প্রতিমা এল। পারেই রাখা হল। ছোট খাটো মেলা বসে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, এই দেশ এই মাটি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৮: ইষ্টদর্শন

এপার থেকে খালি চোখে দেখছি কিছু রং বেরং এর বাহার।সবাই রঙিন জামাকাপড় এ উৎসবের সাজে এসেছে।বাইনোকুলার থেকে চোখ সরাচ্ছি না। ওরা যে বাইনোকুলার থেকে মনে ঢুকে যাচ্ছে। ওরা কারা? ভিনদেশি? কে বানালো ওদের ভিনদেশি? আমার পাশে ছাদে বসে একজন ছিলেন ওদেশে বাপের বাড়ি। বললেন, আহা ওরা আসতে পারছে না। কত কষ্ট হচ্ছে ওদের। কথাটা বুকে বাঁধলো শেলের মতো। বাইনোকুলার এ তো মুখ দেখতে পাচ্ছি না। মনের মধ্যে পাচ্ছি। বাইনোকুলার ঝাপসা হলো চোখের জলে। এ কেমন বিসর্জন। ওরা দূর থেকে এপারের বিসর্জন দেখছে। অর্ধেক নদীর জল ওদের। সেখানে কোনো নৌকো নেই। ওদের প্রতিমা কম। কারণ ওপারে হিন্দু বসতি কম। কিন্তু ওরা আমাদের আনন্দের ভাগ নিতে এসেছে। এখন আমরা আর ওরা। আসলে সবাই আমরা ছিলাম।
ইছামতীর জলের কি ভাগ হয়? ওই যে নদীর পাড়ে মস্ত বটগাছ সে কি ভাঙা বাড়ি ছেড়েছে? মানুষই এমন নিষ্ঠুর ভাবে ভাগ করতে পারে। বিসর্জনের ঢাক বাজে। চিৎকার, আনন্দ, জনসমুদ্র। গান বাজে এপারে। ওপারে আমার দেশের লোকেরা দূর থেকে আনন্দ বোঝার চেষ্টা করে। আমার চোখে ভাসে নদীর ধারে সেই বটগাছ, যে রাজবাড়ির ভাঙা অংশ আঁকড়ে যেতে নাহি দিব বলে। আমার মনে বাজে গোষ্ঠ গোপালের গান—
হায় রে, বনলতা বোঝে যাহা,
মানুষ বোঝে না, হায় রে মানুষ বোঝে না।


ছবি: লেখিকা
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content