রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

ছোটবেলা থেকেই যেটা হয়ে উঠতে বলা হয়, সেটা হয়ে ওঠা জীবনভোর চলতে থাকে। হয়তো হয় না। যারা সেটা হতে পারে তাদের ‘অজাতশত্রু’ বলার একটা কেতাবি পরিভাষা আছে। অথবা ক্যাবলা। হ্যাঁ, যারা পৃথিবীতে অনেকদিন থেকেও, জাগতিক কানাগলির ক্লেদকে জানে না, অথবা মানেও না হয়তো, তাদের ভালোমানুষ বলা হয়। অতঃ কিমাশ্চর্যম্, বাবা-মায়েরা সন্তানকে ভালো করে মানুষ করছেন, চাইছেন হয়তো বা ভালোমানুষ হয়ে উঠুক তাঁদের নয়নের মণি, কিন্তু সেই-ই যখন “বাবার মতো বড়” হয়ে শুনছে, এত ভালোমানুষ হওয়ার দরকার নেই, তখন মনে হয় কি জীবনের ষোল আনাই মাটি? হঠাৎ করেই কি মনে হয়, ভালোমানুষ, ভালোমানুষীর মধ্যে লক্ষযোজনের দুস্তর ব্যবধান, সকালে উঠিয়া মনে মনে ভালো হয়ে চলার যে মন্ত্র তা নিছক অন্যতর কিছু বিষয় বুঝি!

হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকে ভালোমানুষ হয়ে ওঠার কথা বলা হয় বটে, কিন্তু তত্ত্ব ও প্রয়োগের মাঝে অনেকগুলো কিন্তু আর যদির ভিড়। যাকে আপনি ভদ্রতা ভাবেন, তাকেই অন্যজন ভাবেন ভালোমানুষী, অর্থাৎ ক্যাবলামি।

ধরা যাক, আপনি সিনেমা দেখার টিকিট কিনতে গিয়েছেন। গিয়ে দেখলেন হাউসফুল। আপনি ভারি আশা করেছিলেন। এখন ‘ফুল’ হয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে দেখতে ভাবলেন, তাই তো! পরেরদিনের টিকিট কিনে রাখি। তা-ই করলেন। ওপারের টিকিটবাবু ভারি ব্যস্ত হয়ে এমন করতে লাগলেন, যেন আপনাকে বাঁচার পাসওয়ার্ড দিচ্ছেন অথবা জ্বরের প্যারাসিটামল, অথবা ডুবতে থাকা মানুষকে অক্সিজেন। এমন সময় আপনার মনে পড়ল, ও হরি! আরেকটা সিনেমাও আপনার দেখার ইচ্ছে ছিল, সময়াভাবে হয়নি আর কি! এই সুযোগে দেখে নিলে হয়! একদিন আগেও তো বিজ্ঞাপন দেখলেন “সগৌরবে চলিতেছে”।
আপনি উইন্ডোস্ক্রিনে চোখ বোলালেন। কই! জ্বলজ্বল করা নানা স্লটের নামের মাঝে সেই নাম কোথায়? প্রশ্ন করেই ফেললেন, দাদা! ওই বেলা একটার সিনেমাটা কি আর নেই?

কাচের ওপার থেকে ভগবান ভর্তসনা বললেন, থাকলে তো লেখাই থাকতো! আপনি কিছুটা সংবেদনশীল। কষ্ট করে পড়ালেখা শিখে নিজেকে আকস্মিক ধাক্কায় নিরক্ষর মানতে মন চাইল না। মানে, আপনার ‘মানে’ লাগল। মনে ভাবলেন, এ কী, কথাটা কি ভালোভাবেই বলা যেতো না?

শেম অন ইউ!!!! আপনি মনুষ্যপদবাচ্য নন হে, হাঁচির মানে বোঝেন না, ছলাকলা বোঝেন না, সোজা বোঝেন না, উল্টো বোঝেন না। আপনি একটি নিখাদ ক্যাবলা। আপনার জন্য এমন এমন ব্যবহার-ই বাঁধা। আপনার উল্টোদিকের ওই ভগবান, তিনি টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে সম্ভব-অসম্ভব নানা পদে অধিষ্ঠিত হয়ে পদাধিকারে আপনাকে অপদস্থ, বিপদস্থ করে নিজের দ্বিপদ সত্তাটিকে জাহির করতে চান, বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা জীবটির চতুষ্পদ হয়ে ওঠার বিনিময়ে। তখন কি একবারও কচি গলার সেই গানটা কানে ভাসে?

“ভালো ভালোবাসা তোমরা জান কি/ ভালোবাসতে না জানলে জীবনের ষোলআনাই ফাঁকি/ হে ষোলআনা থেকে যদি ষোল আনা যায়/ হিসেবটা কষে দেখো দাঁড়াও কোথায়/ শুধু শূণ্য শূণ্য শূণ্য রাশি রাশি/ তোমাদের কথা ভেবে আমরা হাসি…”
(গান: পড়াশোনায় জলাঞ্জলি, কথা ও সুর: তাপস দাস ও গৌতম চট্টোপাধ্যায়, অ্যালবাম: আবার বছর কুড়ি পরে, শিল্পী: লক্ষীছাড়া)
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৯: যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫: চন্দ্রমণির বধূবরণ

ওই যেন, ভালোমানুষ আর ভালোমানুষীর মধ্যে ‘ভালো’টুকুই যতো সমস্যার। দর্শন বলবে, মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকাল থেকেই তিনটি গুণ কম-বেশি থাকে। যার মধ্যে যেটি বেশি, সে তেমনতর। যেমন রাজার মধ্যে থাকা রাজসিক গুণ। এই গুণ পার্থিব আকর্ষণের আধার হলেও কর্মের অনুপ্রেরণা দেয়। অলস, কর্মবিমুখ মানুষের মধ্যে তামসিক গুণ সার্বিকভাবেই অজ্ঞান, ভ্রম ও মোহবন্ধনের মরীচিকায় জড়িয়ে রাখে। সত্ত্বগুণযুক্ত মানুষের মন নির্মল হয়, নির্মল মনে পরাজ্ঞানের ছায়াপাত ঘটে, অমলিন দর্পণে যেমন স্পষ্ট মুখচ্ছবি ধরা পড়ে, তেমনভাবেই খানিক। কিন্তু তারপরেও সাত্ত্বিক মানুষ বন্ধনজর্জর থাকে, কেননা, সে সুখী হলেও, জ্ঞানী হলেও সেই অহংবোধকে অতিক্রম করতে পারে না, আত্মসুখের বোধ তাকে ভালোমানুষ করেই রাখে, কৈবল্য দেয় কই!

আপনার বিপরীতের ওই দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা মানুষটি আপনাকে কী ভাবে? বোকা অথবা ক্যাবলা, না-মানুষ অথবা নির্বোধ ভালোমানুষ, যাকে অনায়াসে আঘাত করা যায়, ‘হ্যাটা’ করা যায়, খানিক “খিল্লি ওড়ানো যায়”… এমনকি গালমন্দ, কটুকথা বা ‘খিস্তি’ দিয়ে সম্ভাষিত করা যায়।

একে সমাজ নিরীক্ষকরা বহুস্তরীয় নানা ব্যবধানের তত্ত্বে দেখতে চাইবেন। শিক্ষা, বোধ, শ্রেণী, প্রতিবেশ, প্রজন্ম ইত্যাদি নানা অনুঘটক ও উপাদানের যোগসূত্রে এধরণের আচরণের বিবিধ ‘প্যাটার্ন’ নজরে আসতে থাকবে। মধ্যে শুধু একটি কাচের দেওয়াল, অথবা একটি টেবিল অথবা কিছুই না… দুপাশে দুটি ভিন্ন বোধসম্পন্ন জীব। তাদের আপেক্ষিক আচরণের মানদণ্ডে তারা কেউ মানুষ, কেউ না-মানুষ, কেউ ভদ্র, কেউ অভদ্র, কেউ ক্যাবলা, কেউ হাবলা, কেউ টেনি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩১: বিড়াল ঘাঁটলেই কি ডিপথেরিয়া হতে পারে?

ফেলুদা ভ্রূদুটো কুঁচকে বলতে পারে “চিন্তা হচ্ছে রে তোপসে!” অথবা জটায়ু অবাক বিস্ময়ে বলতে পারেন “হাইলি সাসপিশাস”…

এই ধরণের ‘কাল্টিভেট’ করার মতো বিষয়টিকে একটু তলিয়ে দেখার জন্য এই উদ্ধৃতিটুকু রাখা হল—
“তবু একাল সেকাল, এযুগ সেযুগ বলে অভিহিতও করা হয়। সমাজ, মানুষের রীতিনীতি, চলন-বিলন, এরাই ধরে রাখে কালের এক-একটা টুকরোকে, ইতিহাস নাম দেয় অমুক যুগ, তমুক যুগ।

কিন্তু কালকে অতিক্রম করতেও থাকে বৈকি কেউ কেউ, নইলে কারা এগিয়ে দেবে সেই প্রবহমান ধারাকে? সে ধারা মাঝে মাঝেই স্তিমিত হয়ে যায়, নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়। তবু এরা বর্তমানের পূজো কদাচিৎ পায়, এরা লাঞ্ছিত হয়, উপহসিত হয়, বিরক্তিভাজন হয়।
এদের জন্যে কাঁটার মুকুট।
এদের জন্যে জুতোর মালা।

তবু এরা আসে। হয়তো প্রকৃতির প্রয়োজনেই আসে। তবে কোথা থেকে যে আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। আসে রাজরক্তের নীল আভিজাত্য থেকে, আসে বিদ্যা বৈভবের প্রতিষ্ঠিত স্তর থেকে। আসে নামগোত্রহীন মূক মানবগোষ্ঠীর মধ্য থেকে, আসে আরো ঘন অন্ধকার থেকে।” (সুবর্ণলতা, আশাপূর্ণা দেবী)
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৮: হৃদয়ে আমার দিয়েছে ঢেউ, ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি

ছোটবেলা থেকে যে ভালো হওয়ার পাঠ, সেই সমুদ্দুরের স্বপ্ন বড়বেলায় এসে যখন নেহাত গোষ্পদে পরিণত হয়, তখন হতবুদ্ধি, চাতুর্যহীন, ভাজা মাছ উল্টে না খেতে পারা, বিড়াল-তপস্বী, হাবা, গবেট, আকাট, বাপের হোটেলভোগী, গণ্ডমূর্খ, অকর্মার ধাড়ি, ক্যাবলাকান্ত ইত্যাদি নানা অভিধা ও (অ) সম্মানে ভূষিত হতে হতে রোদ্দুর হতে চাওয়া অমলকান্তির মতো অনেকটা নেতির জয়মাল্য গলায় পরতে পরতে মনে পড়ে যাবে সেই শ্মশানবাসী শিবের কথা, যিনি আক্ষরিক অর্থে ‘কল্যাণ’, বৈশিষ্ট্যে ‘আশুতোষ’, আর অচেতন প্রকৃতির সঙ্গে যূথবদ্ধতায় চৈতন্যময় জড় পুরুষ।

এই বিরোধাভাসকে স্ফুট করতে মঙ্গলকাব্যের কবি শিবকে অকর্মা, বেকার, নেশাগ্রস্ত, বখাটে, অসহায় স্বামী করেছেন, দ্ব্যর্থে জানিয়েছেন “কোনও গুণ নাই তার কপালে আগুন”। শিব ঠাকুরের আপন দেশেই যখন আইন-কানুন এমন সর্বনেশে, তখন ক্যাবলাদের এই ছোট হয়ে থাকার বেলা আসে যদি আসুক, বেশ তো! থেকেই যাক না হয় বা! ওপার থেকে ঐশ্বরিক অবজ্ঞার মুচকি হাসিতে আপনাকে ধৌত করে আপনার অপার মূঢ়তাকেই কেবল নির্দেশ করেন যিনি, তাঁর এই বৈদগ্ধ্যে যদি আপনার মনে এসে যায় “দারোগারই চেয়ে দেখছি চৌকিদারের হাঁক বেশি/ সূর্য থেকে বালিরই তাপ অধিক সে ভাই কোন দেশি? সানাইটা না গর্জে যতো তর্জেরে তার পোঁ-এর দল/বালুচরেও দাঁড়িয়ে বলে হ্যাঁ এখানে হাঁটুজল!!!”….

আপনি তবুও তাঁকে অ্যাণ্টনি কবিয়ালের মতো করেই বলুন…
“জয় হল তোমার ভোলা কার সাধ্য তোমায় হারাতে/ এবার গিয়ে থাকো তুমি ফুলবাবুদের পাড়াতে/…. আমার জন্য থাকুক না হয় শুধুই কাঁটার জ্বালা/ সভার মাঝে তোমার গলায় পরিয়ে দিলাম মালা।” (গীতিকার: গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার)

ক্যাবলামিটা তাই বুঝি একটা ডিসকোর্স। এই কোর্সের সিলেবাস জটিল, আর ডিশ!! সকলের পেটে সহ্য হওয়ার নয়।—চলবে।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content