রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মিত্রভেদ

লাভজনক ব্যবসার তৃতীয় উপায়টি হল গোষ্ঠিককর্ম। মানে একসঙ্গে অনেকগুলো গরু কিনে খাটাল বা খামার তৈরি করে দুধ বা সেই সংক্রান্ত জিনিসপত্রের ব্যবসা। ব্যাপারটা অনেকটা আজকের দিনের “অ্যানিমাল ফার্ম”-এর মতো বলা যেতে পারে। কিন্তু তাতে খাটনি প্রচুর এবং তুলনায় লাভের পরিমাণ কম। যদিও তার জন্য গোষ্ঠিককর্ম দায়ী নয়। কারণ গোষ্ঠিককর্ম যথাযথভাবে করতে পারলে সেটা অন্যান্য অনেক ব্যবসার অপেক্ষা লাভ জনক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে গোষ্ঠিককর্ম যিনি করেন সেই গোষ্ঠীর ভিতর থেকে নিজের উন্নতির মানসিকতা চলে যায়; তাই অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এই কাজের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করলেও নিজের ব্যবসা বা অবস্থার উন্নতি করতে পারে না। ফলে লভ্যাংশ তার কমতে থাকে। পঞ্চতন্ত্রকার নিজেই এ ব্যাপারে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে বলছেন—

গোষ্ঠিককর্মনিযুক্তঃ শ্রেষ্ঠী বিন্তযতি চেতসা হৃষ্টঃ।
বসুধা বসুসংপূর্ণা মযাঽদ্য লব্ধা কিমন্যেন।।


আসলে এই সব ফার্মের ব্যবসায় যাঁরা প্রাণাপাত করে পরিশ্রম করেন দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা বাইরের জগতের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তাঁদের জীবনটাও বলা যেতে পারে আবর্তিত হয় শুধু ওই ফার্ম আর ব্যবসাটিকে ঘিরেই। কারণ এতোটাই সময় দিতে হয় এই ব্যবসায়। ফলে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছে-অনিচ্ছে সবটাই চলে যায় এই ব্যবসায় সাফল্য পেতে গেলে। দিনের অধিকাংশ সময়টাই তাঁদের ব্যবসায় আয় করতেই চলে যায়, ব্যয়ের বিশেষ অবকাশ থাকে না বলেই মানুষের চাহিদাও কম হয় এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের। হৃষ্ট মনে শ্রেষ্ঠী ভাবে এই ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদে ভরা গোটা দুনিয়াটাই তো লাভ করেছি, অন্য কিছুর আর প্রয়োজন কীসের? এই রকম আত্মতুষ্টিতে ভোগা মানসিকতা যে বণিকবৃত্তির উন্নতির পথের অন্তরায় সেই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আর আলাদা করে বলবার দরকার নেই।

চতুর্থ পন্থাটি হল “পরিচিতগ্রাহকাগম”—পরিচিত গ্রাহকদের থেকে ধনলাভ। ব্যাপারটা একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝানো দরকার। ধরে নিন আপনি রামবাবু, আর আপনি বেশ একজন বাজার রসিক মানুষ। খেয়াল করে দেখবেন আপনি সাধারণত মাছ কিনতে নির্দিষ্ট দু-একজন বিক্রেতার কাছেই গিয়ে থাকেন। বাড়ির পুজোর ফুল বা কলাটা-মূলোটা যাই বলুন না কেন, সবকিছুর জন্যেই আপনার নির্দিষ্ট কিছু কিছু মানুষ আছে। আপনার বিশ্বাস খোকনলাল বাজারে সবচেয়ে ভালো মাছটা, সবচেয়ে কম দামে আপনাকেই দেয়। আবার খোকনলালও জানে যে রামবাবু তার বাঁধা খরিদ্দার, পরিচিত গ্রাহক। আপনিও রোজ রোজ খোকনলালের কাছেই মাছ কেনেন আর সেইসঙ্গে এটাও খেয়াল করে দেখবেন যে অধিকাংশ দিনই তার কাছে দামাদামিটাও বিশেষ করেন না আপনি। বরং তার বাড়ির খবরাখবর কিংবা ব্যবসার খবরাখবর নিয়ে থাকেন নিয়মিত। মোটামুটি এক কিলো রুই মাছ যদি আপনি দু’শো টাকায় কিনতে অভ্যস্ত থাকেন, তাহলে নিজেই খেয়াল করে দেখবেন যে সেই মাছের দামটি সেই খোকনলাল মাঝে-মধ্যে ওই দু’শো দশ-পনেরোর আশেপাশে বললেও আপনি একবারও দাম না করেই সেটা কিনে নিচ্ছেন। কারণ আপনি জানেন খোকনলাল আপনাকে একেবারে ঠিক জিনিসটা ঠিক মূল্যে দেয়—সে আপনাকে ঠকায় না। আর আপনার মতো পরিচিত গ্রাহক বা বাঁধা খরিদ্দারকে দেখলে খোকনলাল কী ভাবে জানেন? সেটা না হয় পঞ্চতন্ত্রকারকের নিজেই ভাষাতেই শুনে নিন—

পরিচিতানামাগচ্ছন্তং গ্রাহকমুত্কণ্ঠ্যা বিলোক্যাসৌ।
হৃষ্যতি তদ্ধনলুব্ধো যদ্বত্পুত্রেণ জাতেন।।


মানে পুত্র জন্মালে মনে যেমন আনন্দ হয়, সেইরকম পরিচিত গ্রাহক বা বাঁধা খরিদ্দারকে বাজারে ঢুকতে দেখলেই সেই ধন লোভী খোকনলালদের মনও আনন্দে নেচে ওঠে এই ভাবনায়, যে আজকে মাছের দামটা ঠিক কতটা বাড়িয়ে বললে আপনি সন্দেহও করবেন না আর সেইসঙ্গে লাভটাও ভালো রাখা যাবে। এরা আপনার কাছে একরকম, আরেকজনের কাছে আরেক রকম দাম বলে—যে যত পরিচিত গ্রাহক তার কাছ থেকে লাভের সম্ভাবনা ততোই বেশি। পাঠকদের অনুরোধ করবো যে অবসর পেলে নিজেদের বাজার করার প্যাটার্নটা কখনও একবার বিশ্লেষণ করে দেখবেন। মনে হয় না যে, পঞ্চতন্ত্রকার না বুঝে-শুনে হঠকারীর মতো এই সমস্ত খোকনলালদের মতো ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে অকারণে এইরকম একটা মন্তব্য করেছেন। যেকোনও ব্যবসাতেই এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করলে ব্যবসায়ীর লভ্যাংশের পরিমাণ নিয়ে সন্দেহ থাকে না। তবে এটাকে আপনি একজন খরিদ্দার হিসেবে সাধু না অসাধু পন্থার তালিকায় রাখবেন সেটা আপনার ব্যাপার, কারণ এটা ব্যবসার একটা স্বতঃসিদ্ধ স্ট্র্যাটিজি।

আর সেই সঙ্গেই জড়িয়ে আছে পঞ্চম উপায়টিও—“কূটতুলামানম্‌”; মানে ওজনের কারচুপি। তুলা বলতে এখানে তুলাদণ্ডকে বোঝানো হয়েছে, দাঁড়িপাল্লা। এ-ব্যাপারটায় আমরা যারা একটু-আধটু দোকান-বাজারে যাই তারা সকলেই কমবেশি ভূক্তভোগী।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪: একজন জ্ঞানী পণ্ডিত এবং ব্যবসায়ীর মধ্যে রাজা কাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৩: গগনেন্দ্রনাথের‌ ঘুড়ি ওড়ানো

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৫: প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নবপ্রজন্ম-মীনমিত্রের পরামর্শে গ্রামগঞ্জেও মাছচাষ বিকল্প আয়ের দিশা দেখাতে পারে

ষষ্ঠ উপায়টি হল “মিথ্যাক্রয়কথনম্‌”। এইটিও অনেকটা লোক ঠকানোর মতোই বলতে পারেন। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বললে হয়, ধরুন আপনার খোকনলাল পাইকারি মাছের আড়ৎ থেকে পাঁচশো টাকা দিয়ে একটি ইলিশ মাছ কিনে এনে বারশো টাকায় আপনার কাছে বিক্রি করবার সময় যখন বলে “বিশ্বাস করুন! এগারশো টাকায় কেনা আছে মাছটা, ভালো মাছ, আপনার জন্য শুধু বারশো দাম বলছি, এ মাছ পনেরোশোয় বিক্রি আছে”—এইটাই “মিথ্যাক্রয়কথনম্‌”। কিন্তু ধন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এইসব অসাধু উপায় প্রথমে অর্থকরী হলেও বেশি দিন চলে না, একদিন আপনি এই খোকনলালকে বাদ দেবেন, কিন্তু তার বদলে মানিকলালকে পাবেন— এইটুকুই যা তফাৎ।

তাই সবরকম দিক বিচার-বিবেচনা করে বর্ধমান ভাবলেন আমদানি-রপ্তানির ব্যবসাই শ্রেষ্ঠ। কম দামে এক জায়গা থেকে জিনিস কিনে অন্য জায়গায় দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে বিক্রি করা অনেক বেশি নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ। এতে বিক্রেতা হিসেবে সম্মানও থাকে গ্রাহকদের কাছে— বড় ব্যবসায়ীর লক্ষণ এইটাই; আর সেই ধরণের দ্রব্যের মধ্যে ভাণ্ড বা বাসনের ব্যবসাই শ্রেষ্ঠ। কারণ একজায়গা থেকে কিনে অন্য জায়গায় বহুদূরে নিয়ে গেলেও সেটা পচনশীল বস্তু নয় বলে তার কোনও রকম ক্ষতি হয় না। ফলে উচিত দাম তত্ক্ষণাৎ কোথাও পাওয়া না গেলেও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও দু-তিনগুণ দাম বাড়িয়ে সে হাঁড়ি-কুড়ি বিক্রি করা যেতে পারে। বছর ভর রেখে দিলেও সেক্ষেত্রে মূলধন নাশের সম্ভাবনা নেই।

তাই মথুরাতে বিক্রি করা যাবে এমন বাসনপত্র সংগ্রহ করে শুভ তিথি দেখে বাড়ির গুরুজনদের অনুমতি নিয়ে বলদের গাড়িতে চেপে উত্তরে মথুরার দিকে যাত্রা শুরু করলো সে। এখানে এই “মথুরাতে বিক্রয়যোগ্য বাসন-পত্র” ব্যাপারটা খেয়াল করবেন। নিঃসন্দেহে সে যুগেও মার্কেট সার্ভে করা হতো নিশ্চয়ই—না হলে মথুরায় কিরকম বাসনের চল আছে সেটা দাক্ষিণাত্যের লোকে জানবে কী করে? মনে হয় দক্ষিণাপথ বা উত্তরাপথ বেয়ে বণিকের দল যখন এক দেশ থেকে অপর দেশে বাণিজ্য করতে যেতো, তাদের কাছ থেকেই হয়তো এইসব খবর পাওয়া যেতো।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৫: যে ছিল আমার ‘ব্রতচারিণী’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০: প্রশিক্ষক গুরু বিশ্বামিত্র, নারীহত্যা না মানবধর্ম?

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৬: ব্যর্থ প্রেমের বহ্নিশিখা

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১১: ‘কটি পতঙ্গ’ ছবিতে পঞ্চমের সুরে কিশোর নিজেকে উজাড় করে দেন

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৪: ভয়ংকর গর্ভ

যাইহোক “মথুরাতে বিক্রয়যোগ্য বাসন-পত্র” নিয়ে সেই বণিকপুত্র বর্ধমান বলদের গাড়ি চেপে সার্থবাহদের দলের সঙ্গে রওনা হলেন মথুরার পথে। সঙ্গে নিলেন তার বাড়িতে জন্মানো সঞ্জীবক আর নন্দনক নামের আরও দুটি বলশালী বৃষকেও। তাদের পিঠেও বড় বড় পণ্যের বোঝা চাপিয়ে তারা রওনা হলেন দলের সঙ্গে। কিন্তু সাফল্যের পথ কখনও নির্ঝঞ্চাট হয় না। মথুরার কাছাকাছি পৌঁছে একদিন যমুনা নদীতে জল খেয়ে গিয়ে নদী-তীরের কাদাতে পা আটকে সঞ্জীবক নামের বৃষটির পা ভেঙে যায় ভয়ানক ভাবে। অনেক মালপত্র তার পিঠে। বর্ধমানের কথা ভেবে সার্থবাহদের দল সেখানে অপেক্ষা করলেন পুরোপুরি তিন-তিনটে দিন। কিন্তু তারপরে চতুর্থ দিনে সার্থবাহরা সকলে মিলে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে বর্ধমানকে প্রকৃত পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলে যে সামান্য একটা বৃষের জন্য এই বাঘ-সিংহে ভরা এই জঙ্গলে আর একদিনও থাকতে তারা নারাজ।

ন স্বল্পস্য কৃতে ভূরি নাশযেন্‌ মতিমান্নরঃ।
এতদেবাত্র পাণ্ডিত্যং যত্স্বল্পাদ্‌ ভূরিরক্ষণম্‌।।


কোনও বুদ্ধিমান মানুষই অল্পের জন্য বড় সম্ভাবনাকে নষ্ট হতে দেয় না। আপনি তো বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী। পণ্ডিতব্যক্তিরা সামান্য কিছু ক্ষতি সাধন করে হলেও বেশিটাকে রক্ষা করেন, সবটা নষ্ট হতে দেন না। ব্যবসার নিয়মই তো তাই। দূর দেশে গিয়ে জিনিসের মূল্য নির্ধারণ করবার সময়ে এইসব ক্ষতির পরিমাণগুলোকেও মূল্যের মধ্যে ধরে নিতে হয়। সেইসব ক্ষতি বা পথের খরচ বিবেচনা করেই তো জিনিষের মূল্য নির্ধারিত হয়। এইসব দূর দেশে ব্যবসা করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের যে কত রকমের জিনিষ মাথায় রাখতে হতো এবিষয়ে বৌদ্ধজাতকের একটা গল্পের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ইচ্ছা করছে। যেটা এই সময়ের প্রাচীনভারতের ব্যবসায়ী শ্রেণির একটা চিত্রকল্প আপনার কাছে স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে। বৌদ্ধজাতকের গল্পগুলোর সময়কাল যদি বিবেচনা করতে হয় তাহলে বলতে হয় যে পণ্ডিতদের মতে এগুলো মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টিয় ৫ম শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল। তাই সময়-কালের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলা যেতেই পারে যে এই জাতকের অনেক কাহিনিই পঞ্চতন্ত্রের সমসাময়িক। এমনকি পঞ্চতন্ত্রের অনেক গল্পের সঙ্গে বৌদ্ধজাতকের গল্পগুলোর বিষয়গত মিলও আপনি নিজেই খুঁজে পেয়ে যাবেন অনেকক্ষেত্রেই। কখনও কখনও দুটি গ্রন্থের মধ্যে একই ধরণের সমাজচিত্র দেখতে পাবেন। তাই এইরকম সার্থবাহ বা ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গে বৌদ্ধজাতকের একটা শোনাতে ইচ্ছে করলো আপনাদের। দূর দেশে ব্যবসা করতে যাওয়ার সময় সার্থবাহরা কত রকমের লাভ-লোকশানের চিন্তা করে অগ্রসর হতেন, এই গল্পে সে কথাই আছে। সংক্ষেপে গল্পটা এইরকম—

অনেক অনেকদিন আগে বারাণসীতে যখন ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজার রাজত্ব ছিল, সে সময়ে বোধিসত্ত্ব কোনও এক সম্পন্ন বণিকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বড় হয়ে পারিবারিক পেশাই গ্রহণ করেছিলেন তিনি। “অপণ্ণক-জাতক”-এর কাহিনি অনুযায়ী বোধিসত্ত্বের পাঁচশটা গরুর গাড়ি ছিল আর সে গাড়িতে মাল বোঝাই করে কখনও পূর্বদেশে, কখনও বা পশ্চিম দেশে তিনি বাণিজ্য করতে যেতেন। সে সময়ে বারাণসীতে আরও একজন বণিকও বাস করতেন, তিনি বোধিসত্ত্বের তুলনায় বয়সে নবীন এবং অনভিজ্ঞ। বলা যেতে পারে ব্যবসা-বুদ্ধি বিশেষ ছিল না তার, কারণ কোন পরিস্থিতিতে কী উপায় অবলম্বন করতে হবে সে বিষয়ে অভিজ্ঞতা তার তেমন ছিল না।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৯: কুরদার ইকো রিসর্ট—অনাবিস্কৃত এক মুক্তা

ছোটদের যত্নে: শিশু পেটের ব্যথায় ভুগছে? তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি মেনে চলুন

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩২: মঞ্জু ও অনুভা এসে বললেন, ‘আসুন বিকাশবাবু চু-কিত-কিত খেলি’

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-২: কপালে জমেছে ঘাম, শুকিয়ে গিয়েছে জিভ, পেছন থেকে ভেসে আসছে গা ছমছমে শব্দ

একবার বোধিসত্ত্ব অনেক মূল্যবান দ্রব্যে গাড়ি বোঝাই করে বিক্রি করার জন্য দূর দেশে যাওয়ার সঙ্কল্প করেছে একথা শুনে ওই তরুণ বণিকও পাঁচশ গাড়ি নিয়ে সেই দেশেই ব্যবসা করতে যাবে এমন সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু বোধিসত্ত্ব বিচক্ষণ ব্যবসায়ী, সে তখন চিন্তা করলো যে তাঁদের দুজনের মোট এক-হাজার গাড়ি একসঙ্গে একই রাস্তায় গেলে নানা ঝামেলা হবে। প্রথমত, এতোগুলো মালবোঝাই গাড়ি একসঙ্গে গেলে গাড়ির চাকার চাপে রাস্তা ভেঙে চুরমার হবে। দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে গুরুতর সমস্যাটি হল একসঙ্গে এক-হাজার লোক ও আর সেইসঙ্গে দু-হাজার বলদের খাদ্য-পানীয় সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। তাই একসঙ্গে না গিয়ে একদলের আগে আর অপরদলের পরে রওনা হওয়াই ভালো।

মনে মনে এসব বিষয় চিন্তা করে বোধিসত্ত্ব সেই তরুণ বণিকটিকে ডেকে সবকিছু বুঝিয়ে বললেন, “আমাদের একসঙ্গে না যাওয়াই ভালো। তাই আপনিই বলুন আপনি আগে যাত্রা করবেন? না আমি আগে?”

সে যুবক মনে মনে চিন্তা করে দেখলেন যে, প্রথমে যাওয়াটাই শ্রেয়। কারণ পরে গেলে এতো লোক-লস্কর আর গাড়ির নিয়ে ভাঙা রাস্তা দিয়ে যাওয়াটা বেশ দুর্ভোগের বিষয়। এখনও রাস্তা ভালো আছে, তাই আগে-ভাগে রওনা হয়ে যাওয়াই ভালো। তার উপর বলদগুলো বেছে বেছে ভালো ঘাসও খেতে পারবে। পাঠকদের জানিয়ে রাখি যে, সে আমলে বর্ষার পর সাধরণত শরৎকালেই বণিকদের দল যাত্রা করতেন দূর দেশে। এমনকি রাজারাও বর্ষার পর শরত্কালেই দিগ্বিজয়ে বেরোতেন। কারণ সে সময়ে পথে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে গবাদি পশুর খাদ্যের অভাব ঘটতো না, এমনকি মানুষজনের আহারের জন্যও উত্কৃষ্ট ফলমূলেরও অভাব হতো না বনে-জঙ্গলে। স্নান বা পানের জন্যও পরিষ্কার শুদ্ধ জল পেতেও অসুবিধা হবে না। বর্ষার পর সব নদী-সরোবর ভরা থাকবে জলে। আর সবচেয়ে বড় কথাটা হল নতুন দেশে নিজের ইচ্ছে মতন দামে কেনা-বেচা করা যাবে। এইসব চিন্তা করেই সেই তরুণ বণিকটি বোধিসত্ত্বকে বললেন “মহাশয় আমিই প্রথমে যেতে চাই।”

বোধিসত্ত্ব বললেন, “বেশ কথা, আপনিই তবে রওনা হোন প্রথমে।”

বোধিসত্ত্ব তখন চিন্তা করলেন অন্য কথা। —চলবে
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content