রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


কুর্গের কথা মনে পড়লেই দেখি বড় বড় গাছে জমাট বাঁধা সবুজ। ঘন জঙ্গল। আর আছে ঝর্ণা ও পাহাড় ঘেরা লেক। বেঙ্গালুরু থেকে মাইশোর যাবার পথে আছে এক অপূর্ব ঝর্ণা। বড় চুককি। পোশাকি নাম শিবানাসমুদ্রম। একসঙ্গে অনেকগুলো জলধারা, বিভিন্ন পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে প্রবল বেগে নিচে পড়ছে। উল্টোদিকে পর্যটকদের দেখার জন্য রেলিং দেওয়া সিঁড়ি আছে। বাঁধানো জায়গা আছে দাঁড়ানোর। যেদিকে চোখ ফেরাই সেখান দিয়েই প্রবলবেগে জলরাশি ধেয়ে আসছে। প্রতিটি জলধারাই অনবদ্য। একসঙ্গে সব মিলে প্রচন্ড গর্জন। বাতাসে ছড়াচ্ছে জলকণা। একসঙ্গে এতগুলো জলধারা আগে অন্য কোনও ঝর্ণায় দেখিনি। ভালোই ঘাড়ের ব্যায়াম হল দেখতে দেখতে।
কর্ণাটক ট্যুরিজম-এর মাইশোরের পর্যটক আবাসে উঠলাম। প্যালেসটা দেখে নিলাম দিনের বেলা। জমকালো। নানা সূক্ষ কারুকার্য দেয়ালে ও সিলিংয়ে। অপূর্ব সব ঝাড়বাতি, আসবাবপত্র। অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রাসাদ। ভারত বর্ষের সব অঞ্চলেই রাজা রাজরাদের নানা প্রাসাদ। প্রতিটাই বিভিন্নভাবে অনবদ্য ও স্থাপত্যের জয়স্তম্ভ। কিন্তু মাইশোর প্রাসাদের বৈশিষ্ট্য তার সন্ধেবেলার আলোকসজ্জা। বহুদিন ধরে শুনেছিলাম। এ বারে দেখে অভিভূত হলাম। ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় পুরো প্রাসাদে জ্বলে উঠলো দীপাবলির মতো আলো। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র একসঙ্গে বেজে উঠলো। তৈরি হল এক অপূর্ব রাগিনীর মূর্ছনা। এক লহমায় পুরো পরিবেশ পাল্টে গেল। মনে হল কয়েকশ বছর আগের বিরাটএক প্রাসাদের সামনে এসে গিয়েছি।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৪: বাংলায় জীবনীমূলক ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে কালীপ্রসাদ ঘোষ এক স্মরণীয় নাম

রাজবাড়ি আমায় স্বাগত জানাচ্ছে সুর ও আলোয়। কোনও রেকর্ডে বাজানো সঙ্গীত নয়। যন্ত্রীরা ওই সময় প্রাসাদের সামনের একটি নির্দিষ্ট কক্ষে বসে সুর তোলেন সানাইয়ে। আধ ঘণ্টা মতো। সমবেত দর্শকরা রাজবাড়ির রেলিংয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে সাক্ষী থাকে এই অপূর্ব মুহূর্তের। এক অপার্থিব দৃশ্য। সুর ও আলোর মায়াজালে পারিপার্শ্বিক ভুলিয়ে দিল।

মাইশোরে দেখার মতো আছে বৃন্দাবন গার্ডেন। মস্ত জায়গা জুড়ে। ধাপে ধাপে। সবুজ লন। নানাধরনের বাহারি ফুল। ফোয়ারা। সন্ধের পর নির্দিষ্ট সময় ফোয়ারা নানা সুরের ও রঙের আলোয় সেজে উঠলো। পুরো বাগানটি যত্নের সঙ্গে রাখা হয়।
কুর্গ ঢোকার সময় মনে হচ্ছিল এক সবুজ দুর্গে ঢুকছি। মস্ত বড় বড় গাছে ভরা জঙ্গল। তার মাঝ দিয়ে ঝকঝকে মসৃণ রাস্তা। রাস্তার পাশে একটু দূরে দূরে থাকার রিসর্ট। আর আছে কফিক্ষেত। আমাদের গাড়ি ঢুকলো জাঙ্গল ক্যাম্পে জঙ্গলের পর্দা সরিয়ে ঢুকে আরেক চমক। সামনে পাহাড় ঘেরা মস্ত লেক। আমাদের খাওয়ার জায়গা একদম লেকের ধারে। থাকার ঘর তিনতলায়। বারান্দায় বসলে পাহাড় জল সব দেখা যায়। নিচতলার ঘরে দৃষ্টি আটকে যায় গাছে। ওপর থেকে পুরো প্রকৃতি যেন ফ্রেমে বাঁধানো এক খানি ছবি।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা

কুর্গে বেশ কিছু ফলস আছে। ভরা বর্ষায় তারা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবি ফলসের মধ্যে অন্যতম। অনেক কাছ থেকে দেখার জন্য রেলিং দেওয়া সিঁড়ি করা আছে। উঁচু পাথরের ওপর থেকে বিরামবিহীন লাফিয়ে পরছে জলধারা। চারদিকে ঘন সবুজ। মন ভরে যায়। আর আছে তালকাভেরি মন্দির। কাবেরী নদীর উৎস মনে করা হয় এ জায়গাকে। শিবলিঙ্গ আছে এখানে। সুন্দর একটি কুণ্ডও আছে। একদিন কফি ক্ষেত দেখতে গেলাম। আমাদের কফি ক্ষেতের মালিক যত্ন করে সব দেখালেন। লাল টুকটুকে কফির বীজ থেকে কখন কীভাবে আমাদের খাওয়ার উপযোগী করে তোলা হয় বললেন। এছাড়া কফি ক্ষেতে আছে গোলমরিচের লতা। অনেকটা জায়গা জুড়ে কফি ক্ষেত।
কুর্গ থেকে বেলুরে কিছু মন্দির দেখলাম। অপূর্ব স্থাপত্য। হয়সালা বংশের রাজাদের তৈরি। পাথরের গায়ে সূক্ষ কারুকার্য। কি করে সম্ভব করেছেন শিল্পীরা ভাবলে বিস্ময় জাগে। মন্দিরগুলো স্থাপত্য হিসেবেই বিশেষ ভাবে দর্শনীয়।বিগ্রহের বিশেষ আড়ম্বর নেই।
এছাড়া একদিন গেলাম চিকমাগলুর। এ অঞ্চলটি যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এটি আমি জানতাম না। বোধ করি অনেকেই জানেন না। পাহাড়ের ওপরে শহর।আবহাওয়ার এক অদ্ভুত পরিবর্তন ওপরে। পথে পড়ল ভিরনারায়ান মন্দির।হয়সালা বংশেরই এক অপূর্ব স্থাপত্যের সাক্ষী। পাহাড়ে কতগুলো ঝর্ণা দেখলাম। ঝাড়ি ফলসে যেতে প্রায় তিন কিলোমিটার হাটতে হল। কাঁচা রাস্তা। আমরা হাঁটার শুরুতে সস্তার রেইনকোট কিনে নিলাম। যেখানে জিপ থামে সেখানে বিক্রি হয়। পর্যটকদের জন্য। তারপর হেঁটে পৌঁছলাম। কি অপূর্ব ফলসটি। সাদা দুধের মতো জল। অনেক উঁচু থেকে পড়ছে। গভীর জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘেরা চারদিক। ফেরার পথে একটু বিশ্রাম নিলাম একটি হোমস্টেতে। ওখানকার কেয়ারটেকার আমাদের যত্ন করে চা খাওয়াল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৯: ইষ্টদেবী জগদ্ধাত্রী

হ্যালো বাবু! পর্ব-৩: সুষমা দেবীর ঘরের দুটো জানালার উপরের পাল্লা খোলা ছিল

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হেঁটে পৌঁছলাম আমাদের জিপের কাছে। ওপরে ভিউপয়েন্টে যেতে বিশেষ জিপ নিতে হল। রাস্তা খুব খারাপ। প্রচণ্ড ঠান্ডা। সঙ্গে হাওয়া। মেঘেদের দৌড়োদৌড়ি। তাদের মতো হালকা হলে বুঝি আমাদের ও ভাসিয়ে নিয়ে যেত। ধোঁয়াশার চাদর জড়িয়ে ওপর থেকে দেখার চেষ্টা করলাম। বেশিদূর দেখা গেল না। ওপরে বাবাবুদানগিরিতে একটি ঝর্ণা আছে। যেখানে জল জমা হচ্ছে সেখানে অনেকে স্নান করছে। এছাড়া আছে বাবাবুদান এর মাজার ও ঋষি দত্তাত্রেয় র উপাসনা ঘর। পাশাপাশি দুই ধর্মের উপাসনা স্থান। এর চেয়ে বড় পীঠ আর কি হতে পারে? আসার পথে থামলাম সিরি নেচার রুষ্ট-এ। একটি কফি শপ বলা যায়। চমৎকার সাজানো। ঘাস ছেঁটে নানা রকম ডিজাইন করা বাইরে। লতাপাতার ছাউনিতে বসে কফি খেলাম। চিকমাগলুর এর সৌন্দর্যে আমরা মুগধ হলাম।
অনেক ঝর্ণা, অনেক মন্দির হয়তো দেখা হল না। ফিরতে হবে। সময় শেষ। কিন্তু মন রইল চিকমাগলুর এর মেঘের সঙ্গে। প্রার্থনা রইল কুর্গ এর সবুজ দুর্গ যেন মানুষের আগ্রাসে না পরে। মানুষের নিরাপদ আশ্রয় হয়েই থাকে।

ছবি: লেখিকা
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content