শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সকালবেলা কী ভাবে আবার রতনপুর যাব সে বিষয়ে সবাই সাজেশন দিতে লাগলো যে, কোরবা মেন রোড দিয়ে বেরিয়ে যান, যাবেন তো রতনপুর কিন্তু আমার মন তো পড়ে রয়েছে ছররিতে। ছররির দিক দিয়ে রতনপুর পৌঁছতে গেলে রাস্তা খারাপ। ড্রাইভার বলল: “চলুন। কিছু হবে না আমি নিয়ে পৌঁছে দিতে পারব।” আজ আমাদের গন্তব্য ছিল এনটিপিসি টাউনশিপের ভেতর দিয়ে। অপূর্ব সুন্দর ছায়ামাখা টাউনশিপে প্রচুর গাছ। সেটা পেরিয়ে আস্তে আস্তে আমরা ছররির দিকে গেলাম। ছররিতে বহু পুরনো কোষা চাষি তার দোকানে যাওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। তার নাম সহেলুরাম, এই তথ্য আমরা সাতরেঙ্গা থেকে পেয়ে গিয়েছি। চলে এলাম সহেলুরামের দোকানে।

তার মূল দোকানটি আধুনিক দোকান যে রকম হয় সেরকমই। সমস্ত সেলসম্যান থুরি সেলস গার্ল । কোষার সাম্রাজ্যে গিয়ে বসে পড়লাম। একের পর এক অনবদ্য কারিগরি। তার সঙ্গে অতিথি আপ্যায়ন, কী খাব কি না খাব কেমন চা খাব? বাড়ির বড় বউটি সুন্দর, লাল চা খাব শুনেই আদা দিয়ে, এলাচ দিয়ে অপূর্ব লাল চা করে এনে দিল। আমার মা গুণমুগ্ধ হয়ে গেল। নাতনিরা মাকে ধরে ধরে দোকানে বিভিন্ন অংশ দেখাচ্ছে আর আমি কোষার সাম্রাজ্যে ডুবে গিয়েছি। চোখ হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বাস করুন, এখানে এলে কয়েক ঘণ্টা সময় এমনি কেটে যেতে পারে আপনি আন্দাজই করতে পারবেন না। কিনুন বা না কিনুন শুধু শিল্পীদের হাতের কাজ আর কোষা দেখতে দেখতে। এর ফাঁকেই ওরা একবার আমাকে কোষার কোকুন দেখিয়ে নিয়ে এলো। একদিকে দেখি প্রচুর শাড়ি বস্তাবন্দি হয়ে আছে, একটা দুটো বস্তা দেখিয়ে, বললঃ “আপনাদের শান্তিনিকেতনে যাচ্ছে।” তারপর দাম যখন জিজ্ঞাসা করলাম চোখের সামনে ভেসে উঠলো কলকাতার মৃগনয়নীতে এই কোষা প্রায় দ্বিগুন দামে বিক্রি হয়, কোয়ালিটি এর থেকে খারাপ মানে যেগুলো একটু সস্তা সেগুলোই। অনেক লোভ সংবরণ করেও কিছু কোষা না কেনার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। বাইরে থেকে ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যি তো আড়াই ঘণ্টা কেটে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৭: কোরবা হয়ে সাতরেঙ্গা

দশভুজা: জীবনে যা কিছু করেছি, প্রত্যয়ের সঙ্গে করেছি: কানন দেবী/২

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৩: এখানকার একমাত্র ভারতীয় রেস্তরাঁর মালিকও বাঙালি

আড়াই ঘণ্টা বাদে সহেলুরামের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের রাস্তা শুরু হল। আজ আমরা প্রথম যাব কুঠাঘাট ড্যাম দেখতে। সত্যি কথা বলতে, ছত্তিশগড় কিন্তু ড্যাম এবং ঝরনার দেশ। এত ড্যাম ভারতবর্ষের অন্য কোথাও আছে কিনা বলতে পারবো না। বিশাল বিশাল ড্যাম এবং অক্টোবর মাসে ঘুরে দেখেছি প্রত্যেকটি ড্যামে প্রচুর জল। আবার সেই রাস্তা পেরোতে পেরোতে, ধুলোর ঝড় খেতে খেতে আসছি কিন্তু ফেরার সময় কেন যেন মনে হল ধুলোর ঝড় একটু একটু কম। রাস্তাটা যেন একটু সহজ। গৌরব মানে আমার বাহনচালক বললো, ”আপনি খেয়াল করেননি ম্যাডাম, যাওয়ার দিকে রাস্তা বেশি তৈরি হচ্ছে আর আসার থেকে রাস্তাটা অনেকটা তৈরি হয়ে গিয়েছে।”
ফ্লাইওভারের পর ফ্লাইওভার টপকে টপকে আমরা কুঠাঘাট ড্যামের দিকে চলে এলাম। আদিবাসী গ্রামের ভেতর দিয়ে কুঠাঘাট পৌঁছে গেলাম। বিশাল উঁচু পাহাড়ের মতো, অনেক সিঁড়ি, সে সিঁড়ি অতিক্রম করে যেইমাত্র ড্যামের উপরে চড়ে বসলাম; চারদিকে প্রশস্ত নীল জলরাশি। স্থানীয়দের ঘোরার অনবদ্য জায়গা, দূর রায়পুর বিলাসপুর রতনপুর থেকে লোকজন আসে। চারপাশে ছোটখাট খাবারের দোকান, ছোট ছোট রেলিং দিয়ে ঘেরা ব্রিজ অতিক্রম করে আপনি ড্যামের একটা পাশ থেকে আরেক পাশ চলে যেতেই পারেন, অনবদ্য ফটোগ্রাফির জায়গা। কিছুটা সময় কাটানোর পর আবার ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে নিচ দিয়ে এঁকেবেঁকে একটি রোড সাইড ধাবাতে আমাদের দুপুরের খাওয়া শেষ করে আজ আমরা যাব একটি অনবদ্য জায়গায়। যে জায়গাটি না গেলে বোঝাই যেত না এত সুন্দর জায়গা ভারতবর্ষে আছে।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১: জলের তলায় তার শরীরের কোনও অস্তিত্ব নেই!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩: যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে এ জগতে সেই হল পণ্ডিত

আমাদের যেতে হবে রতনপুরের মায়ের মন্দিরকে অতিক্রম করে খুরদার ভ্যালি রিসোর্টে, গ্রামের নাম খুরদার। ৬৮ কিলোমিটার বিলাসপুর থেকে রতনপুর থেকে ৪১ কিলোমিটার দূরে। মজার কথা হচ্ছে খুরদার ভ্যালি এমন একটি জায়গা তার থেকে সম দূরত্বের একদিকে বিলাসপুর আরেক দিকে অমরকণ্টক। আপনি চাইলে এখান থেকে অমরকণ্টকের ট্যুরটাও করে নিতে পারেন। পাহাড়ি পথের উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে আপনি ছোট্ট একটি গঞ্জে উপস্থিত হবেন খুরদায় যাওয়ার জন্য। গঞ্জটির নাম বেলগাহানা। বেলগাহানার ছোট্ট বাজারটি বিকেলবেলা জমজমাট থাকে। বেলগাহানা থেকে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে নিতে পারেন। এরপর আস্তে আস্তে আপনি পাহাড়ি পথ ধরবেন। বিকেলবেলার সাড়ে তিনটে চারটের সময়ও পাহাড়ি রাস্তা ঘন বনাঞ্চলের রাস্তা কেমন গা ছম ছমে। পূর্বঘাট পর্বতমালার একাংশ এখানে। একটি পাহাড় থেকে আরেকটি পাহাড় আপনি টপকে টপকে চলে যাচ্ছেন এবং রাস্তা কিছুটা সংকীর্ণ।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৮: শুঁটকি মাছে কি আদৌ কোনও পুষ্টিগুণ আছে?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৮: গৃহ-সহায়িকার পাঁচালি এবং আমাদের ভদ্র সমাজ

লাল পাথুরে মাটি বালির রাস্তা দুপাশে ঘন জঙ্গল, একেক সময় ভয় আপনাকে গ্রাস করবে। কোথায় যাচ্ছেন আপনি বুঝতেই পারছেন… শুধু কতগুলো নিশানা রয়েছে খুরদার ইকো রিসোর্টের। এটা দেখতে দেখতে একটা সময় আমরা আমাদের কাঙ্খিত জায়গায় এসে পৌছালাম। যাওয়ার সময় রাস্তাটাকে এত ভয়ংকর লাগছিল যে আশেপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য ভোগ করতেই পারিনি। রিসোর্ট এর কাছে এসে গাড়িটি দাঁড়াতেই মন ভরে গেল ডানদিকে রিসোর্টে। ঢোকার রাস্তা বাঁদিকে অচানক মার ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে ঢোকার রাস্তা। গেট খুলে দেওয়ার পরে গাড়িটি ঢোকানোর পরে চমৎকার জায়গা। চারটি পাইন কাঠের কটেজ, একটু দূরে ডাইনিং, হোটেলের কর্মচারীদের থাকার জায়গা, সুন্দর বাগান। পড়ন্ত বিকেলে যখন ধোঁয়াশা মাখা প্রকৃতিতে সূর্য একটু একটু করে ডুবছে রিসোর্টের উপর দিয়ে, পিছনের রাস্তাটিতে বাইগা জনজাতির গ্রাম। আওয়াজ আসছে ঢোল ইত্যাদির। আপনার মন ভরে যাবে।
সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থা সম্বলিত কটেজগুলো আপনাকে মনোমুগ্ধ করবেই। ঘরে এসে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিতে দিতে রিসোর্ট ম্যানেজার চলে এলেন। বললেন যিনি সরকারি অধিকর্তা নতুন জয়েন করেছেন বাইক নিয়ে বেলগাহাঁনাতে গিয়েছেন প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে। এই তথ্য দিতে দিতেই হঠাৎ দেখি টেলিফোনে কোন টাওয়ার নেই। আমি বললাম: “সে কি এখানে টাওয়ার পাওয়া যায় না?”

বলল: “না আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন যে কদিন থাকবেন আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না।” আবার আতঙ্ক, সঙ্গে বৃদ্ধা মা। ঢুকতে ঢুকতেই দেখলাম দুটো মোবাইল নাম্বার ডাক্তারের নাম্বার সহ দেওয়ালে লেখা। কিন্তু আপনাকে মাথায় রাখতে হবে আপনাকে বিপদে পড়লে সেই বেলগাহানা পর্যন্ত যেতে হবে। তবেই আপনি কিছু পাবেন এবং রাত্রিবেলার কোনও বিপদ হয়ে গেলে ওই রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে বেলগাহাঁনা পর্যন্ত নামা এটাও কিন্তু ডিফিকাল্ট। কিন্তু যদি নিভৃতে নির্জনে প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে চান এর থেকে ভালো আর হয় না। —চলবে

ছবি: লেখিকা
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content