বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অ্যানাকোন্ডা: পৃথিবীর সবচাইতে বড় সাপ

পরের দিন সকাল সকাল জলখাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে গেলাম। নৌকা করে চললাম যেখানে অ্যানাকোন্ডা দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। মাঝখানে একবার দাঁড়ানো হল ক্যাপিবারাদের একটি কলোনিতে। নদীর দুধারে জায়গায় জায়গায় দল বেঁধে এরা থাকে। একসঙ্গে অতগুলো অত বড় বড় ইঁদুর দেখে বেশ মজা লাগছিল। এরা মানুষের উপস্থিতি সম্পর্কে একেবারেই উদ্বিগ্ন নয়। নিজেদের মতো বসে আছে, রোদ পোহাচ্ছে, খাচ্ছে। আমরা খানিকক্ষণ তাদের ওই দিনগত পাপক্ষয় দেখে চললাম অ্যানাকোন্ডার খোঁজে।

প্রায় আধঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে বনি যে জায়গাটায় নৌকোটা ভেড়াল সেটা একটা জলকাদায় ভরা তৃণভূমি বা বলা যায় আগাছার জঙ্গল। মানে তলায় জল মাটি মেশা, কিন্তু নলখাগড়া এবং ঘাসের জঙ্গল এতটাই ঘন যে তার ওপর দিয়েই হাঁটাচলা করা যায়। যতদূর চোখ যায় পুরোটাই ওরকম। তা আন্দাজমতো সাত আট বর্গকিলোমিটার তো হবেই, তার চাইতে বেশি বই কম হবে না। এই রকম জলকাদা জায়গাতেই অ্যানাকোন্ডাদের বাস।

বনির থেকেই জানা গেল যে এরা বেশ শান্ত প্রকৃতির। বিষধর বা নরখাদক তো নয়ই, খিদে না পেলে এমনি এমনি ও কাউকে আক্রমণ করে না। কিছু উপজাতির বিশ্বাস এরাই এই বনভূমির রক্ষাকর্তা। কিছু উপজাতির পৌরাণিক মতে এই অরণ্যে কোথাও এক বিশাল অ্যানাকোন্ডা (জায়ান্ট অ্যানাকোন্ডা) আছে যে কি না এই পুরো নদীমাতৃক বাস্তুতন্ত্রটিকে সামলাচ্ছে। আবার অনেক পুরাণের মতে, এই বিশাল নদীটাও আসলে এক ‘জায়ান্ট অ্যানাকোন্ডা’ ছিল যে কিনা এই বস্তুতন্ত্র সৃষ্টি করেছে। বেচারাদের ওই বিশাল চেহারার জন্য কাইমানদের মতো তাদেরও চরিত্র স্খলন করা হয়েছে চলচ্চিত্র বিপণনের স্বার্থে। পৌরাণিক দেবতা থেকে একেবারে হলিউডি দুর্বৃত্ত। স্খলন বলে স্খলন।

আমি অ্যানাকোন্ডার এই শান্ত, অহিংস স্বভাবের কথা শুনে একটু আশাহত হলাম বটে। ছোটবেলা থেকে মাথার মধ্যে যে হিংস্রতা চিত্রিত হয়েছিল তার অনেকটাই মুছে গেল। তবে এই আমরা কয়েকজন ছাড়া জনমানব হীন অরণ্য প্রান্তরে তার অহিংস থাকাই ভালো বটে।

আমরা দু’জন দু’জন করে দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে গেলাম। তবে কাছাকাছিই থাকতে হবে। কথা হল, যে দলই দেখতে পাবে সেই চেঁচিয়ে ডাকবে অন্যদের। নদীর দিকের কোণ থেকে শুরু করে এভাবেই পুরো জায়গাটার যতটা সম্ভব খুঁজে দেখতে হবে। আমাদের হাতে একটা করে ছোট অথচ বেশ শক্ত গাছের ডাল, যা দিয়ে আমরা ওই আগাছার জঙ্গলে ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁজতে পারব। অদ্ভুত ব্যাপার যে ওই অত বড় একটা প্রাণী নিজেকে এমনভাবে লুকিয়ে রাখে ওই আগাছার জঙ্গলের মধ্যেই যে তার দেখাই পাওয়া যায় না।

এইভাবে আমরা ঘুরেছিলাম অন্ততপক্ষে চার ঘণ্টা। অতক্ষণ ধরে ওরকম পাঁকে ডোবা জলায়, হাঁটু অব্দি বুট পরে, দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে লাঠি দিয়ে আগাছা সরিয়ে সরিয়ে দেখা বেশ কষ্টসাধ্য। এর মধ্যে এক জায়গায় আমার আর মার্টিনের পা-টা গেল ওই পাঁকে একটু ডুবে। সেই বাজে জল ঢুকে সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার। তাই নিয়েই খুঁজছি। হঠাৎ বনি চেঁচিয়ে ডাকল আমাদের। দেখা পাওয়া গেছে। আমরা সবাই ওই পাঁকের মধ্যেই ছুটলাম। গিয়ে দেখি এক ছোট অ্যানাকোন্ডা। তার দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১০ ফুট মতো। গায়ে কালো কালো ছোপ। বলিভিয়ান আমাজনে এইরকম ‘ডার্ক-স্পটেড অ্যানাকোন্ডা’ বা ‘ব্ল্যাক অ্যানাকোন্ডা’-ই বেশি। বনি তো নিজের লাঠিটা দিয়ে একটু নড়ানোর চেষ্টাও করল তাকে। আমিও একদম কাছে গিয়ে তাকে দেখলাম।

তাতেও শান্তি নেই। তার মুখটা তখনও দেখিনি। যারা অত বড় হাঁ করে তার মুখটা না জানি কীরকম হবে। দু’বার লাঠি দিয়ে তাকে খোঁচাতেই সে মুখটা নাড়াল। তবে সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এরা কুমির থেকে শুরু করে জাগুয়ার পর্যন্ত সবই গিলে নিতে পারে। বেশ সরু মতো মুখ। বনির থেকে জানলাম যে এরা নিজেদের চোয়ালের হাড়টা শিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্নভাবে সাজিয়ে নিতে পারে। এদের চোয়ালের হাড় মানুষের করোটির মতো মাথার পেছনেই আটকানো নয় যে অল্প একটু হাঁ করেই বন্ধ হয়ে যাবে। বরং সেটা চলে যেতে পারে তাদের পাঁজর পর্যন্ত যে জায়গাটা সবচেয়ে মোটা। শিকারের আয়তন অনুযায়ী তারা ওই হারটিকে আটকে দেয় পাঁজরের খাঁচার যেকোনও একটি হাড়ে এবং সেই অনুযায়ী নিজের মুখের শক্তিশালী অথচ নমনীয় পেশি ব্যবহার করে তারা হাঁ করে শিকারটিকে গলাধঃকরণের জন্য।

তো যা-ই হোক, তাকে দেখার পরে আমরা আবার খুঁজতে লাগলাম। সত্যিই মা মনসা সেদিন আমাদের সহায় ছিলেন। তার খানিকক্ষণের মধ্যেই আর একটি দল চেঁচাতে লাগল। আমরা আবার সবাই মিলে ছুটলাম সেদিকে। সেখানে গিয়ে দেখি এক বিশাল অ্যানাকোন্ডা। ওই একই প্রজাতির মনে হল কিন্তু এর দৈর্ঘ্য আগেরটির প্রায় দু’ গুণ। এবার আর বনির অপেক্ষা না করেই আলতো করে তার গায়ে লাঠিটা বোলালাম কয়েকবার। সেও বেশ মিটমিট করে দেখতে লাগল আমাদের। এখন দেখছিল না শিকারের আয়তন মাপছিল জানি না তবে মনে মনে ভাবলাম যে এ যদি ওই ছায়াছবির অ্যানাকোন্ডার মতো হত তাহলে কী হত আমাদের। নিঃসন্দেহে মৃত্যু। আমার আর মার্টিনের উৎসাহই সবচাইতে বেশি। আমরা একদম কাছে গিয়ে তার ছবি তুললাম। পুরোটা কোনওভাবেই আনতে পারলাম না এক ফ্রেমে। তাই একবার সামনে থেকে, একবার পেছন থেকে, একবার এপাশ থেকে, একবার ওপাশ থেকে ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। তাতে যেটুকু এল আর কী। মিনিটখানেক ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে, আমাদের লাঠির ছোঁয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে বলিভিয়ান দেবতা তথা হলিউডের ভিলেইন বিদায় নিলেন। আর আমার মনে রেখে গেলেন তাঁর চিরস্থায়ী ছাপ।

আমরা আবার নৌকো করে ফিরে এলাম। দুপুর গড়িয়ে তখন প্রায় বিকেল। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ হল। নটেগাছটি, থুড়ি বিবসি গাছটিও মুড়োল। পরের দিন আবার লাপাজের পথে রওনা হতে হবে।

ছবি: লেখক

বাইরে দূরে


লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content