শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ফ্রস্টবাইটের সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হল সেটা শুরু হলে কিছু বোঝা যায় না। আমার ক্ষেত্রেও ঘটনাটা সেরকমই হচ্ছিল। সাধারণত ঘর থেকে বেরোনোর সময় আমি দেখে বেরোই যাতে আমার মুখের মাস্ক আর জ্যাকেটের উঁচু গলার মধ্যে কোনও ফাঁক না থাকে। কিন্তু ওই রাস্তায় চলতে চলতে মুখের মাস্কটা খোলা পরা করতে গিয়ে একটু ওপরের দিকে পরা হয়ে গিয়েছে আর সেটা অতটা দেখে নেওয়া হয়নি। তাতে করে হয়েছে কি, যে জ্যাকেটের উঁচু গলা আর মাস্কের মধ্যে একটা সরু ফাঁক হয়ে গিয়েছে। আর সেখান দিয়ে কনকনিয়ে ঢুকেছে ঠান্ডা আমার অলক্ষ্যেই।
ওই রকম পাগলের মতো হাঁটতে হাঁটতেই কি একটা কারণে একবার গলায় হাতটা দিতেই আমার রক্ত জল হয়ে গেল। তখনই সম্বিত ফিরল। ঝোকের বসে এ কি করছি আমি।
গলায় হাত দিয়ে দেখি সেখানে কোনও অনুভূতি নেই। আর সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রমাদ গুনলাম। এতো ফ্রস্টবাইটের লক্ষণ। তখন আমি বাঁচার জন্য মরিয়া। ওই পিচ্ছিল বরফের মধ্যেই প্রাণপণে দৌড়েছি উল্টোদিকে। খানিকটা গিয়েই জিওফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটের দরজা দেখলাম। একবার ঢুকে পড়লেই সব ঠিক আছে। কিন্তু বিপদের নিজস্ব একটা পরিকল্পনা থাকে। আর যারা তার প্রতি অতটা যত্নবান নয়, তাদের বিরুদ্ধে সে সবচাইতে কঠিন পরিকল্পনা করে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হল। জিওফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটের দরজা খুলতে গিয়ে দেখি সেটা বন্ধ। আর আমার কার্ড দিয়েও সেটা খুলছে না।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৭: একেই হয়তো বলে নিশির ডাক

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৮: শান্তা দেবী— এক মহীয়সী!

এ বার আমাকে আবার প্রায় এক মাইল পথ পেরিয়ে আমার বিভাগে পৌঁছতে হবে গরম জায়গায় ঢুকতে গেলে। আর এই একবার জমে যাওয়া অবস্থায় অতটা পথ পেরোতে গেলে আমার গলায় যে কি হবে আমি নিজেও জানি না। আমি ছুটতে শুরু করলাম। তারই মধ্যে বরফ ঢাকা ঢালু রাস্তায় দু’বার পড়ে গেলাম। কিন্তু তখন সেই সব দিকে নজর নেই। উঠে দাঁড়িয়েই আবার ছুটছি। আর ওই ছুটতে ছুটতেই মাঝে মাঝে গলার কাছটা একবার একবার করে হাত দিয়ে চেপে ধরে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছি। মাস্ক আর জ্যাকেটের গলার ওপর দিয়ে চাপছি। মনে মনে প্রার্থনা করছি, এ বার চেপে ধরলে যাতে একটু স্পর্শের অনুভূতি পাই। কিন্তু কিছুতেই কিচ্ছু হচ্ছে না। শেষমেশ ওই দৌড়তে দৌড়তে প্রায় ২০মিনিট পর আমার ভবনের সামনে এসে আমার একসেস কার্ড দিয়ে দরজা খুলে ঢুকলাম।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৭: তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথেই যে জন ভাসায়

রুমে ঢুকেই সোজা বাথরুমে ছুটেছি আয়নার সামনে। যে কী রকম অবস্থা হয়েছে গলার কাছে। মুখটা ওপর দিকে করে দাঁড়াতেই আমি নিজেই একটু শিউরে উঠলাম। গলার তলার দিকটা মানে যেখানটায় কোনও অনুভূতি ছিল না; সেই জায়গাটা পুরো কালো হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ ওই জায়গার চামড়ায় রক্তটা জমাট বেঁধে গিয়েছে। তাই ওই কালো রং। এই রকম সময় বেশি জল বা গরম কিছু দিয়ে সেঁক দেওয়া আরও বিপজ্জনক। তাতে নাকি আরও বেশি সমস্যা হতে পারে। ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে যা বুঝলাম যে ওই ভাবেই আমাকে বসে থাকতে হবে। ফ্রস্টবাইটের তেমন কোনও দ্রুত চিকিৎসা বা ফার্স্ট-এইড বলে তেমন কিছু নেই। সেরে যাওয়ার মতো পর্যায়ে থাকলে ওই ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ধীরে ধীরে সারতে থাকবে। না হলে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হবে। অতয়েব ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: আদুরের ‘মাথিলুকাল’ সারা ছবি জুড়ে মামুটির অসামান্য অভিনয় প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ

আমি চিন্তা কমানোর জন্য আমার দফতরেই ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। কাল সকালে দেখা যাবে যা হয়। কিন্তু সে কি আর হয়। চিন্তা থেকেই যায় মনের মধ্যে। সারা রাত ধরে একবার করে আয়নার সামনে গিয়ে গিয়ে মাথাটা উঁচু করে দেখছি গলার কাছটা কেমন আছে। আর সেখানে কোনও অনুভূতি পাচ্ছি কিনা। কিন্তু সেই রাতে কিছুই উন্নতি হল না। তবে আশার কথা, কোনও অবনতিও হল না। ফ্রস্টবাইটে ওই রক্ত জমে চামড়ার তেমন ক্ষতি হলে সেটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সেটা হয়নি দেখে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। অবশেষে দু’দিন পর থেকে দেখলাম যে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে, কালো অংশের পরিমাণ কমছে। তখন শান্তি পেলাম। তবে এই দু’ দিনে ইন্টারনেটে ফ্রস্টবাইট নিয়ে যত ওয়েবসাইট আছে সব আমি পড়ে ফেলেছি চিন্তায়। ওই দিনই অন্য আর একটা শীতের টুপি কিনে আনলাম যেটা একদম মাথা থেকে গলার নিচ পর্যন্ত ঢেকে দেয়। আর ভুলবশত ফাঁক থেকে যাওয়ার চিন্তা নেই।—চলবে।

ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।

Skip to content