রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

পূষণ বলল, “রিমিতা, দেখ, কী সুন্দর ফুল!”
রিমিতা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল খানিকটা, সে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রথমে পূষণকে দেখল, তারপরে তার হাতে ধরা ফুলটাকে। উজ্জ্বল হলুদ রঙের, অনেকটা সুর্যমুখীর মতো, কিন্তু সূর্যুমুখী নয়। সে পিছিয়ে গিয়ে পূষণের হাত থেকে ফুলটা নিয়ে দেখতে লাগল।
পূষণ বলল, “কী নাম বলতো?”
রিমিতা ঠোঁট উল্টাল, “কী জানি! আমি তো বটানিস্ট নই যে ট্যাক্সোনমি মুখস্থ করে রাখবো!”
পূষণ বলল, “অনেকদিন আগে অদ্রীশ বর্ধনের একটি বই পড়েছিলাম, কী যেন নাম,” বলে সে ভাবার চেষ্টা করে, তারপর বলে, “হ্যাঁ মনে পড়েছে, আমার বউ সব জানে!” বলে সিরিয়াস মুখ করে রিমিতার দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল তার প্রতিক্রিয়ার।
রিমিতার এক মুহূর্ত লাগল, পূষণের রসিকতা বুঝতে। তারপর সে দুম দুম করে কিল বসিয়ে দিল তার পিঠে, বলল, “তুমি কি আমাকে বোকা পেয়েছ? বইটার নাম—‘আমার মা সব জানে’, এখানে বউ কোথা থেকে এল?”
পূষণ রিমিতার মার উপভোগ করতে করতে বলল, “আরে লেখক ভুল করেছেন কিংবা প্রেসেও ভুল করে থাকতে পারে। মায়েরা সব জানে না কি? যতক্ষণ তারা বউ, ততক্ষণ তারা সবজান্তা। যেই মা হয়ে যায়, কেমন ভেবলে যায়!”
রাগে আবার মারতে হাত উঠিয়েছিল রিমিতা, তার আগেই পূষণ আলতো করে তাকে একটা চুমু খেয়ে বলল, “নাও, জরিমানা দিয়ে দিলুম। এ বার শান্ত হও!”
রিমিতা তাতে আরও রেগে উঠল। বলল, “কে চেয়েছে তোমার এই জরিমানা?”
পূষণ হেঁড়ে গলায় বীভৎস খারাপ সুরে দু’ কলি গেয়ে উঠল, “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়…!”
রিমিতা কানে হাত চাপা দিয়ে বলল, “দোহাই তোমার, ওই স্বর্গীয় সুরেলা গলায় গান গাইবার চেষ্টা করো না, কে জানে কালাদেও আবার ওই গানের টানে চলে না আসে!”
“হা, হা, হা” করে প্রাণখোলা হাসি হাসল পূষণ, তারপর সজোরে বুকে জাপটে ধরল রিমিতাকে। ব্যাকুল ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরল ওয়াইন কালার লিপস্টিক লাগানো রিমিতার ঠোঁটে। শুষে নিতে চাইল সব আনন্দ, সব সুধা, সব পেলবতা। রিমিতা এই আকস্মিক কিন্তু পরমপ্রার্থিত চুম্বনের মায়ায় আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল যেন। অনেকক্ষণ পরে যখন তারা মুক্ত হল, তখন মনে হচ্ছিল ‘লাখ লাখ যুগ রভসে গোঙ্গায়লুঁ, তব হিয়া জুড়ন না গেল!’
চুম্বনের শেষে রিমিতা কিন্তু লজ্জা পেল। যাঃ! কেউ যদি দেখে ফেলে, সর্বনাশ! কপট রাগে বলল, “এইভাবে ওপেন স্পেসে দাঁড়িয়ে কেউ চুমু খায়?”
পূষণ লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “বলতে পারতে, তাহলে তখন তোমায় কোলে নিয়ে বসে পড়তাম কিংবা শুয়ে চুমু খেতাম। শুয়ে চুমু খেতে কিন্তু দুর্দান্ত লাগে আমার!” বলল পূষণ।
ছদ্ম-রাগে দুম-দুম করে চারটে কিল-ঘুঁষি মেরে বসল রিমিতা। তার বেশি এগোলো না, কে কখন এসে পড়বে! একেবারে ওপেন রাস্তার ওপরে তারা দাঁড়িয়ে আছে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

“তুমি যদি এখন হোটেলের রুমে ফেরো, তাহলে আমি অন্য ঠোঁটেও চুমু খেয়ে দেখিয়ে দেব!” বলে অসভ্য ইঙ্গিত করল।
“পূষণ! এ বার কিন্তু সত্যি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!” রিমিতা তাকে শাসন করার চেষ্টা করল, “ভুলে যাবে না, তোমার-আমার একটা স্পেশাল রেপুটেশন আছে। তাকে নষ্ট করার কিংবা হেয় করার চেষ্টা করো না!”
“বাব্বা! সিরিয়াস হয়ে গেলে না কি? আমি তো জোক করছিলাম। অ্যাই?”
“ছাড়!” সহজ হওয়ার চেষ্টা করে রিমিতা। সে সত্যিই রেগে গিয়েছিল। এখানে রাস্তায় লোকজন কম হলেও একেবারে কম নয়। যদিও তারা এখন রাস্তায় নেই। আছে একটা টিলার সামনে দাঁড়িয়ে, তাও তার মনে হল, কে বলতে পারে, টিলার আশেপাশে কেউ নেই? আজ তিনদিন হল, যা সব ঘটে যাচ্ছে, তাতে মাথা আর কাজ করছিল না। তারপর আজ সকালে হোটেলে দু-দুটো অপঘাতে মৃত্যু। তার মনে হচ্ছিল যেন, কোন আধিভৌতিক কিছু তাদের দু’জনের পিছু পিছু ঘুরছে আর থেকে থেকে একটা-দুটো লাশ ছুঁড়ে দিয়ে মজা দেখছে কিংবা ভয় দেখাতে চাইছে। হোটেলের ঘরে বন্দি থাকতে তাদের দু’জনের কারুরই ভালো লাগছিল না। সেজন্য কাপাডিয়াকে গিয়ে তারা দু’জনেই বলেছিল, “হাই মিস্টার কাপাডিয়া, আপনি কি আমাদের একটা ব্যাপারে হেল্প করতে পারবেন?”

কাপাডিয়া অত্যন্ত ভদ্র এবং বিনয়ী মানুষ, চোখে সম্ভবত কোন সমস্যা আছে, সবসময় একটা কালো চশমা পরে থাকেন, তার আড়ালে চোখের কোণে হাসলেন না কী কাঁদলেন, কেউ বলতে পারে না। তবে কাপাডিয়া বিনয়ী এবং প্রত্যুৎপন্নমতি বলে কাস্টমার এসে দাঁড়ালেই বুঝে যান তাঁর কী চাই। এইভাবে বছরের পর বছর ধরে করতে করতে একটা সময় মালিক বুঝবেন যে, তিনি কী অমূল্য রতন একখানা পেয়েছিলেন। হেলায় হারালেন, এই যা। কাপাডিয়া দুপুরে ইন্টারোগেশন শেষ হওয়ার পরেই বলেছিলেন, “এই সব ঝুটঝামেলা হবে বলে যদি জানতাম, তাহলে কোনওভাবেই আমি এই রিসর্টে জয়েন করতাম না! কিন্তু এখন তো ফেঁসেই গিয়েছি, এখন আমি আর কী করব? কী-ই বা করতে পারি? তার চেয়ে আমি ঠিক করেছি, এই রিসর্টের কাজে রিজাইন করে, বাকি জীবন নিজের বাড়িতে কাটাব। যে-টুকু সম্বল আছে, তা-দিয়েই কাটিয়ে নেব বুড়ো-বুড়ি! কিন্তু এই ঝামেলার কাজে আর নয়। পুলিশ সামলাবো না বোর্ডার—এই নিয়ে ধন্দ এখনও গেল না! কাজ করব কখন?”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

পূষণ ও রিমিতাও সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা বুঝতে পারছিল, অজস্র বলিরেখা-অঙ্কিত কাপাডিয়ার মুখে এই আক্ষেপ অনেক দুঃখে বেরিয়ে এসেছে।
পূষণের প্রশ্নের জবাবে কাপাডিয়া উপরের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। তারপর মিষ্টি হেসে বললেন, “বলুন স্যার, আপনাদের জন্য কী করতে পারি?”
পূষণ বলল, “আমরা কাছেপিঠে কি একটু ঘুরে আসতে পারি? আসলে দু’দিন ধরে যা চলছে, তাতে আমাদের মাথা হ্যাং হয়ে আছে। রিমিতাও খুব খিটখিটে হয়ে উঠেছে। সকলের মতো আমরাও এখানে এসেছিলাম দু’দিন একটু রিল্যাক্স করবো বলে, কিন্তু…! যাক্‌, ব্যাড লাক। কিন্তু এখন এই রিসর্টের ঘরে বসে থাকলে আরও অসহায় লাগছে নিজেকে। দু’তিন ঘণ্টার জন্য ঘুরে আসা যাবে, এই রকম একটা স্পটের কথা বলুন আর একটা গাড়ির ব্যবস্থা যদি করে দেন, তাহলে খুব উপকার হয়।”

কাপাডিয়া ধীর গলায় বললেন, “দেখুন, আপনারা সকলেই এখানে এসেছেন এনজয় করতে, রিল্যাক্স করতে সে আমরা জানি। কিন্তু এমন সিচ্যুয়েশন হয়ে গেল যে, তা আর পসিবল নয় এখন। পুলিশ কাউকে রিসর্ট ছেড়ে কোথাও যেতে নিষেধ করেছে। এই অবস্থায় গাড়ি নিয়ে কাছেপিঠে কোথাও গেলেও যদি পুলিশ পরে অফেন্স নেয়? তাহলে আপনি আমি দুজনেই মুশকিলে পড়ে যাব, বহুত লাফড়া হয়ে যাবে!”
রিমিতা বলল, “আমরা পুলিশের সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা বলতে পারি। থানার নাম্বারটা যদি দেন।”
“অবশ্যই ম্যাম। এই নিন”, বলে কাপাডিয়া নাম্বার দিলেন। তারপ বললেন, “আপনারা ফোন করতেই পারেন, তবে এই বুড়ো মানুষটার কথা যদি শোনেন, তাহলে বলব, ওনাদের সন্দেহ বাড়িয়ে কোন লাভ আছে? তার চেয়ে রিসর্ট থেকে বেরিয়ে সামনেই একটু হাঁটাহাঁটি করুন না। এখানে দু’পাশে শাল-মহুয়ার জঙ্গল, একটু এগুলেই টিলার পর টিলা, ভালোই লাগবে আপনাদের। আর একটু এগুলেই বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে পড়বেন। সেখানে কিছু দোকানপাটও পাবেন। তবে দেইলি ইউসেজের সামান পাবেন, আর কিছু পাবেন না। তাও হাঁটতে আপনাদের মন্দ লাগবে না!”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

কথাটা রিমিতার মনে না ধরলেও পূষণের ধরেছিল। সে বলল, “এটা ভালো বলেছেন। আসলে বুঝতেই পারছেন, আমাদের একটু প্রাইভেসি দরকার ছিল। যাই হোক, আমরা যেমন বলছেন, তেমনটাই করব। তারপর বড় রাস্তা অবধি গিয়ে আবার ফিরে আসব।”
“বেশ। তাই আসুন। তবে দেখবেন, হঠকারির মতো জঙ্গলের বেশি ভিতরে যাবেন না। যা সব হচ্ছে, মালুম নেহি, কোথায় কী বিপদ লুকিয়ে আছে!” সাবধান করে দেন কাপাডিয়া।

ওরা মাথা নেড়ে বেরিয়ে এসেছিল এবং যৌবনের স্বভাবধর্মে কিছুদূর গিয়েই একটা টিলা দেখতে পেয়ে সেইদিকে এগিয়ে গিয়েছিল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ একটা পায়ে চলা পথও আছে এখানে। বোঝাই যায়, যাতায়াত আছে মানুষের। জঙ্গলও এখানে তেমন ঘন নয়। দুপাশে ঝোপঝাড় আলো করে হরেক রকম ফুল ফুটে আছে, মৌমাছি উড়ছে। তারই মাঝে সূর্যমুখীর মতো একটা বেশ বড়সড় ফুলের ঝোপ ইতস্তত দেখতে পেয়ে রিমিতাকে ফুলের নাম জিজ্ঞাসা করেছিল সে।
রিমিতা কপট রাগ ছেড়ে বলল, “আমি তো ফুলের নাম জানি না। সূর্যমুখী বলেই তো মনে হচ্ছে, তেমনই দেখতে, তবে বেশ আনইউজুয়াল। কী ফুল গো?”
পূষণ মাথা চুলকে বোকার মতো মুখ করে বলল, “আরে আমি জানলে কি আর জিজ্ঞাসা করতাম? আমি নিজেই জানি না!” বলে হাসল।
দুমদুম করে তার পিঠে গোটাকয় কিল-ঘুঁষি বসিয়ে দিয়ে রিমিতা বলল, “নিজে জানো না তো, অন্যকে জিজ্ঞাসা করে ভাব নিচ্ছিলে কেন?”
পূষণ বোকার মতো বলল, “আরে ওসব জঙ্গুলে ফুল। ওদের কী আর নাম আছে না কি? যা খুশি একতা নাম দিয়ে দাও না!”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৯: এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লগা

এমন সময় পিছন থেকে কেউ বলে উঠল, “ওগুলি জঙ্গুলে ফুল ঠিকই, তবে জঙ্গলটা আমাদের দেশের নয়। উত্তর আমেরিকার গাছ। এখানে চার্চের ফাদার এনেছিলেন। চার্চে আছেও, তারই বীজ উড়ে এসে আশেপাশের জঙ্গলে এখন এই গাছ যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে। এর সায়েন্টিফিক নেম হেলিওপসিস হেলিয়ানথোডস্‌। তবে সাধারণভাবে একে ফলস্‌ সানফ্লাওয়ার বা অক্স-আই সানফ্লাওয়ার বলে ডাকা হয়!”
চমকে উঠেছিল তারা দুজনেই। এখানে সত্যিসত্যিই তাদের সঙ্গে সঙ্গে যে আর কেউ আছে, তা তারা ভাবতেও পারেনি। আর শুধু তো থাকা নয়, সে তাদের কথোপকথনও শুনেছে! দুজনেই একইসঙ্গে সবেগে পিছনে ফিরেছিল। আর তারপরেই আগন্তুককে দেখে পূষণ অবাক হয়ে বলে উঠল, “এ কী! আপনি? এখানে?”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content