মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

জীবন কিছু দূর পাভেলকে অনুসরণ করেছিল, কিন্তু তারপর সে আর এগোয়নি। তার মনে হয়েছিল, সকলের একসঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে ঢোকা উচিত নয়। শহুরে-সাহেবরা কিছুদূর গিয়েই হতোদ্যম হয়ে পড়বেন, ফলে তখন ফিরে আসা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। জঙ্গলের মধ্যে দৌড়ানো সোজা ব্যাপার নয়। যার অভ্যাস আছে, সেই কেবল পারবে; যার নেই, সে কোনও মতে পারবে না। শহুরে সাহেবদের দেখে তার মনে হয়েছে, তাঁরা দ্বিতীয় দলের। কোনওদিন জঙ্গলের ভিতর দৌড়ানো তো দূরের কথা, জঙ্গল-সাফারিতে গিয়েছেন কি না সন্দেহ! তা না হলে, এ ভাবে হঠকারিদের মতো কেউ জঙ্গলের ভিতর দৌড়ে যেতে পারে না। যদি এটা বদমাশ লোকেদের কোনও ফাঁদ হয়? তাহলে আর বেঁচে ফিরতে হবে না। এই সমস্ত জঙ্গলের ওপারে যে রাজ্য, সেখানে গুলি-বোমা-বন্দুকের রাজত্ব।
এ সব জঙ্গলে তাদের কেউ আত্মগোপন করে নেই, কে বলতে পারে? আর তাদের কব্জায় একবার পড়লে আর প্রাণে বেঁচে ফিরতে হবে না। জীবন সে জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিল না। নামে যতই তার জীবন থাক, মরতে একদিন তাকে হবেই হবে, তার আগে আততায়ীর গুলিতে সে মরতে চায় না। তার অনেক শখ। হাতে যদি কিছু টাকাকড়ি জমে, তাহলে বৌ-বাচ্চা নিয়ে সে একবার কাশ্মীর কিংবা কুলু-মানালি ঘুরে আসবে। জন্ম-ইস্তক দীঘা-পুরী করেই তার গেল। আজ অবধি দার্জিলিং-এও সে যেতে পারেনি। মারা গেলে আর এইসব জায়গায় যেতে পারবে না কি? অতএব সে বাঁচতে চায়। রাজার মতো বাঁচতে না পারুক, প্রজার মতো বাঁচলেও তার চলবে। এই কারণে আর না এগিয়ে সে ফিরে এল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

গাড়িটা অরক্ষিত অবস্থায় রেখে গিয়েছিল জীবন। আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় তার মাথায় আসেনি যে, অরক্ষিত গাড়িতে চাবি ঝুলিয়ে চলে গেলে, যে কোনও সময় যে কেউ গাড়িটা নিয়ে কেটে পড়তে পারত। এখানে এমন আকছার ঘটে। আর একবার গাড়ি চালিয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে ঢুকে পড়লে আর তাকে ধরে কে? সে ফিরে এসে আগেই গাড়িটা ঠিকঠাকভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে নিশ্চিন্ত হল। যাক, এ যাত্রায় একটা ফাঁড়া কাটল। গাড়ি চুরি হলে তাকে বড়বাবু আর আস্ত রাখত না। বড়বাবুকে সে মোটেও ভয় পায় না, কিন্তু চুরি-ডাকাতি ইত্যাদিকে পায়। পুলিশে চাকরি করেও পুলিশকে তার বড় ভয়। এরা বিপদে পড়লে নিজের লোককেও ছাড়ে না। আর সে তো সামান্য গাড়ি চালায়।
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র, বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: প্রাক-কথন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

জীবন গাড়ি থেকে চাবিটা খুলে নিল। নিয়ে সাবধানে প্যান্টের পকেটে ঢোকাল। তারপর এদিক-ওদিক দেখে যখন তার মনে হল, নাহ, লালবাজারের সাহেবদের এত তাড়াতাড়ি ফেরবার সম্ভাবনা আছে, তখন পকেট থেকে একটা শালপাতার তৈরি চুরুট ধরাল। যখন বুদ্ধির গোড়ায় তার ধোঁয়া দেওয়ার দরকার পড়ে, নিজেকে অসহায় লাগে, সেই নিদারুণ ধন্ধের মুহূর্তে সে এই শালপাতার চুরুট খায়। না হলে তার বিড়ির বান্ডিল তো আছেই রোদ-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব সময়ের সঙ্গী হিসেবে।
সবে সুখটান দিয়েছে, আর ভাবছে, কখন আজ ফিরতে পারবে তারা, এমন সময় জীবন দেখল সাইকেল মাহাতো জঙ্গলের গা ঘেঁষে হঠাৎ যেন উদয় হল। সে তার বাইকে চড়েই আসছিল। জীবনকে সেখানে দেখে থমকে দাঁড়াল সাইকেল, তারপর বলল, “আরে জীবন, তুমি এখানে একা-একা? কোয়ি কাম সে আনা হুয়া ক্যা?”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

এই সাইকেল মাহাতো লোকটিকে জীবন আদৌ পছন্দ করে না। মগজের মধ্যে সদা-সর্বদাই প্যাঁচালো বুদ্ধি আঁটা। সবসময়েই যেন অন্যকে বাঁশ দেওয়াই তার কাজ। হম্বিতম্বি তো লেগেই আছে। গেল মাসেই তার পিছনে লেগেছিল, কিন্তু উপযুক্ত একজন রক্ষাকর্তা সাহায্য করেছিল বলে কিছু হয় নি। আজ সেই রাগে সে প্রায় অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছিল যেন। কিন্তু যখন বুঝল, তার কাছ থেকে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত সাইকেল মাহাতো এই স্থান থেকে নড়বে না, তখন সে দায়সারা গোছের উত্তর দিল, “ওই আর কী! কর্তার ইচ্ছেয় কাজ!”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৭: পাঞ্চালদেশে যাত্রাপথে পাণ্ডবদের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় কিসের ইঙ্গিত?

“মেনে? বড়সাহেব এসেছে না কি?”
“হুঁ!” জীবন দায়সারা জবাব দিল আবারও।
“কোথায় তিনি ? আর কে এসেছে?” সাইকেল জিজ্ঞাসা করল আবার।
“এত খোঁজে তোমার কী দরকার সাইকেল? তোমার এত আগ্রহের কারণটাই বা কী? কিছু ল্যাফড়া-উফড়া আছে না কি?”
“খুব লায়েক হয়ে উঠেচিস আজকাল তুই জীবন! দেখিস পিঁপড়ার পাখা না গজায় তোর!” রুক্ষ স্বরে বলল সাইকেল।
“তুমি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছ না কী সাইকেল? তাহলে বড়বাবুকে বলি, তোমারই বা এত পাখনা গজাল কিসের জন্য, তা তিনি খোঁজখবর নিয়ে দেখুন একটু। তুমিই বা কী করতে এই জায়গায় এসেছ, সেটাই তো আমাদের প্রশ্ন! জবাব দিতে পারবে তো?” জীবন ঈষৎ বাঁকা স্বরে বলল।
“বলগে যা! ওইরকম কত বড়বাবুকে সাইকেল তার পকেটে ঢুকিয়ে রাখে!”
“দেখিস, বড়বাবুর ওপরেও আবার বড়বাবু থাকে কি না! সেখানে ফেঁসে না যাস!”
“মানে?” সন্দিগ্ধ গলায় এবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সাইকেল।
“কিছু না!” কথা ঘোরায় জীবন, “তুমি জানো না যে, এই রাস্তা দিয়ে এখন যাওয়া মানা? এখানে টেপ লাগানো রয়েছে দেখতে পাওনি ?”
“কই! আমি তো এক ধার ঘেঁষে যাচ্ছিলুম, তাতে মার্ডার স্পটের ক্ষতি কী হল?” সাইকেল বলল বটে, কিন্তু সে অনর্থক ঘামছিল।
“ক্ষতি কিছু হয়েছে কি না সে বড় সাহেবরা বিবেচনা করে দেখবেন। কিন্তু আপাতত তুমি যে এই জায়গায় ঘোরাঘুরি করছে, তা দেখলে তোমাকে থানায় উঠিয়ে নিয়ে যেতেই পারেন তাঁরা। সুতরাং, সাধু সাবধান!” তারপর গলাটা ঈষৎ খাদে নামিয়ে বলল, “তুমি জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলে না কি?”
চমকে উঠল যেন সাইকেল। “এসব কী কথা বলচিস রে তু ? তোর কি মাতা খারাপ হল!”
“তুমি হ্যাঁ কিংবা না-তে উত্তর দিতে পারো না?”
“তাতে কী হবে?”
“অনেক কিছুই হতে পারে। আবার কিছু না-ও হতে পারে। যদিও আমার মন বলছে, এখন কিছু না ঘটলেও, পরে ঘটার সম্ভাবনা আছে। চারপাশ কেমন থমথম্‌ করছে দেখচ না?” জীবন জিজ্ঞাসা করে।
তার কথার কোন জবাব না-দিয়ে সাইকেল বাইকে স্টার্ট দিল। তারপর বলল, “বড়বাবুকে তো আমি বুঝে নেব। কিন্তু তোর এই আচরণ আমার মনে থাকবে সাইকেল! আবার দেখা হবে!”

জীবন সাইকেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়িবিড় করে কিছু বলল। যদিও বলল বটে, কিন্তু এত আস্তে যে, সে নিজেও শুনতে পেল কি না সন্দেহ! তারপরেই আবার সে সচেতন হয়ে উঠল। লালবাজারের সাহেবরা এখনও ফিরছেন না কেন? —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content