রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

সামনেই শাক্য দৌড়াচ্ছিল। পাভেল তাকেই অনুসরণ করছিল। তবে শাক্যকে দেখে তার মনে হচ্ছিল সে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না-করেই দৌড়াচ্ছে। সে অন্তত এ ভাবে পারবে না। তার অত স্পিড নেই। সে স্পটে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করতে পারত। শাক্য তাকে বলেনি অনুসরণ করতে। কিন্তু কেউ তাকে বলুক না বলুক, তার নিজস্ব একটা কর্তব্যবোধ তো আছে? সেই কর্তব্যবোধ থেকেই সে অনুসরণ করছিল। শাক্যকে এই অচেনা-অজানা জঙ্গলের গভীরে সে একা যেতে দিতে পারে না।

জঙ্গলের ভিতরে যতই সে এগোচ্ছিল, ততই তার মনে হচ্ছিল গাছপালাগুলি যেন ইচ্ছে করেই তাকে আরও নিবিড় করে চেপে ধরতে চাইছে। সে শুনেছে, কোনও কোনও জঙ্গল না কি জীবন্ত, নানা রকম ব্যাখ্যার অতীত অনেক কিছুই জঙ্গলে ঘটতে দেখা যায়। জার্মানির ব্ল্যাকফরেস্টকে যেমন হন্টেড জাঙ্গল বলা হয়। তবে এই পিশাচপাহাড়ের সানুদেশে গজিয়ে ওঠা জঙ্গল যত পুরানোই হোক না কেন, এইরকম কোনও কিংবদন্তী নেই যে, এই জঙ্গলটা গোটাটাই ভুতুড়ে! যদিও কালাদেওর ব্যাপারে অনুসন্ধান করে তার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, কিছু না কিছু তো আছেই, তা তার নাম কালাদেও হোক বা আর কিছু। তবে তার বাস জঙ্গলের মধ্যে নয়, পিশাচপাহাড়ের পবিত্র গুহায়। কিন্তু যেভাবে কালাদেও বাবাজি এখন সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং সুযোগ পেলেই মানুষের মাস আর মজ্জা চুষে খাচ্ছেন, তাতে এই জঙ্গলে তিনি এলে আশ্চর্য হবে না সে। মনে পড়তেই গা-টা ছমছম করে উঠল তার।
এদিক-ওদিক তাকাল সে। শেষ বসন্তে গজিয়ে ওঠা পাতাদের সাজে বেশ চমৎকার লাগছে চারপাশ। জায়গায় জায়গায় নানা ঝোপঝাড় গজিয়ে উঠেছে। সেখানে নাম-না-জানা নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। এক জায়গায় বিশালাকৃতি মৌচাক দেখতে পেল একটা। ঝুলে আছে গাছ থেকে এক হাতের মতো লম্বা আর দুই হাত মত চওড়া সেই মৌচাক। এমনিতে তার দেখার কথা নয়, কারণ শাক্যকে অনুসরণ করে সে দৌড়াচ্ছিল। কিন্তু ওই যে ভয়, সেই ভয়ের জন্যই সে চারপাশে নজর রেখেই দৌড়াচ্ছিল। কিন্তু শাক্যর তুলনায় তার শরীর অনেক ভারী বলে সে খুব দ্রুত তাকে অনুসরণ করতে পারছিল না। তবে দূর থেকে শাক্যর পিঠের দিকটা এক ঝলক দেখেই সে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়তে চেষ্টা করছিল। এ-কথা যে সহজেই বুঝতে পারছিল যে, ওই সামনে পালানো ব্যক্তিটিকে যদি আজ তারা ধরতে পারে, তাহলে এই কেসের অনেকটাই সমাধা হয়ে যাবে। যদিও প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল এক ব্যক্তির পিছনে অন্ধভাবে ছুটে চলাটা সে মন থেকে সমর্থন করতে পারছিল না। সেই জন্যই হাতে রিভলভার রেখেছিল সে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৯: আবার সত্যব্রত

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার

যতই জঙ্গলের ভিতর দিকে ঢুকছিল সে, ততই জঙ্গল ঘন হচ্ছিল। রাস্তার ধারের শাল-সেগুনের জঙ্গল দেখে যতটা হালকা-পাতলা মনে হয়, ভিতরের দিকে মোটেও তা নয়। মাটির তলায় অনন্তলতা, ফার্ণের গাছ গজিয়ে সবুজ কার্পেট পেতে রেখেছে যেন। শালের গুঁড়ির গা ঘেঁষে বেরুনো নতুন শিশুশালের পাতাগুলিও সেই সবুজে মুখ ডুবিয়ে রেখেছিল। সাপ-খোপ আছে এই জঙ্গলে, মাস দুয়েক ধরে এখানে থাকার সুবাদে সে জানে তা। তবে ভালুক বা হাতি বিশেষ নেই। দলমার দিক থেকে হাতি মাঝেমধ্যে এসে ঢুকে পড়ে, তখন বিপদ। আপাতত সেইরকম কোন সংবাদ নেই।

এখানে মাটি থেকে কেমন সোঁদা গন্ধ বেরুচ্ছে। ভিজে রয়েছে অনেক জায়গায়। রোদ পৌঁছতে পারে না বলে হয়তো শিশিরে ভেজা মাটি দিনের পর দিন একইরকম থাকে। পাতা পচে উঠেছে ভিজে ভিজে। জুতোর দফারফা হচ্ছিল। খুব তাড়াতাড়ি দৌড়াতে পারছিল না সে। কিন্তু শাক্য বা অন্য লোকটির কাউকেই দেখতে পাচ্ছিল না সে এখন। একটু ইতস্তত করল পাভেল। কোন দিকে যাবে এখন সে? বুঝতেও পারছে না। শাক্যকে শেষ দেখেছিল যেন বাঁ দিকে বেঁকে গিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কিছু বলছিল তাকে। ভুলও শুনতে পারে। এখন তার উচিত বাঁ-দিকেই যাওয়া। সে এক মুহূর্ত চিন্তা করে বাঁ-দিকেই বাঁক নিল। আর ঠিক তক্ষুনি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সামনে পড়ে থাকা গাছের একটা ভাঙা ডালে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

পড়ল বেশ জোরেই, কিন্তু তেমন লাগল না। পাতাপচা আর ফার্ণের কার্পেট তাকে বাঁচিয়ে দিল বড়সড় আঘাতের হাত থেকে। গায়ে হাতে পাতা পচা আর ভিজে মাটির আস্তরণ লেগে গেল তার। পা’টা তুলতে গিয়ে দেখল সামান্য মচকেছে। ব্যথা করছে। কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল সে। শাক্যরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। হয়ত লোকটিকে ধরেও ফেলেছে শাক্য। এককালে শাক্য রাজ্যস্তরে চ্যাম্পিয়ন ছিল। তার পক্ষে দৌড়ানো কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু পাভেলের পক্ষে দৌড়ানো এখন বিলাসিতা। চাকরির ট্রেনিং-এর সময় বাধ্য হয়েই দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে সে একটু সুখী মানুষ। এখন অবশ্য পা ফেলতে গিয়ে সেই সুখ টের পাচ্ছিল পাভেল। আর এগিয়ে যেতে পারবে কি না, পায়ের এই অবস্থায় এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি না, সে-কথা ভাবছিল সে। যদি সে না এগিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলেও তো বিপদ। দুপুর গড়িয়ে জঙ্গলের এই গভীরে অনেক আগেই আলো মরে আসবে। তখন আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না সে। অতএব সে ঠিক করল, ফিরে যাবে। বাইরে বেরিয়ে অপেক্ষা করবে শাক্যর জন্য। তেমন হলে সুদীপ্তকে একটা ফোন করে সব বলবে। ড্রাইভার ছেলেটিও হয়তো এতক্ষণে থানায় জানিয়েছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৭: পাঞ্চালদেশে যাত্রাপথে পাণ্ডবদের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় কিসের ইঙ্গিত?

সে পিছন ফিরল। আস্তে আস্তে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল সে। সঠিক রাস্তা ধরেছে কি না তাও বুঝতে পারছে না সে। এতক্ষণ দৌড়ানোর সময় এত ডান-বাম করেছে যে, এখন আর দিশা ঠিক করতে পারছে না। কিছুদূর গিয়ে সে একবার পিছন ফিরে তাকাল। কেমন থমথম করছে যেন সব। পাখিও তো ডাকছে না! এক আশ্চর্য কোন জগতে এসে পড়েছে যেন সে। কোনওরকমে এগিয়ে চলেছিল সে। মনে মনে ভাবছিল, সে হয়তো বেরিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু শাক্য? সে কি পারবে?

ডান-বাম না করে সে সোজাসুজি হাঁটতে চেষ্টা করল। তার ধারণা হল, এ ভাবেই সে নিশ্চয়ই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। যদিও সামনে জঙ্গল শেষ হওয়ার কোনও চিহ্ন দেখতে পাচ্ছিল না সে। কয়েকটা খেজুর গাছ দেখল সে। তাদের পিছনে ফেলে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তার মনে হল, জঙ্গলের ভিতর দৌড়ানোর সময় একসঙ্গে বেশ কয়েকটা খেজুর গাছ আছে, এমন তো তার চোখে পড়েনি। তাহলে? সে কি অন্য পথে চলে এসেছে না কি? যদি সত্যিই সে পথ ভুল করে, তাহলে তো এইখানেই ঘুরপাক খেতে হবে সারা রাত। এমনকি কাল সকালেও সে এখান থেকে বেরুতে পারবে কী না সন্দেহ! সে যে-পথে খেজুর গাছগুলির কাছে এসেছিল, সেই পথেই আবার ফিরে গেল। বাম বা ডান কোন এক দিকে যেতে হবে তাকে। সে অনেক ক্যালকুলেশন করে দান দিকেই যাওয়া ঠিক করল। কিছুদূর গিয়েই একটা কুসুম গাছ চোখে পড়ল তার। নতুন রক্তাভ কাঁচা সোনার মতো পাতার সাজে সেজে ঝলমল করছে গাছটা। সে আসবার সময় এই গাছটা দেখেছে কি না মনে করতে পারল না। আসলে তখন দৃষ্টি স্থির ছিল সামনে ধাবমান শাক্যের উপরে। আশেপাশে চোখ তাকালেও সে তো আর গাছ দেখছিল না, দেখছিল কেউ আত্মগোপন করে আছে কি না। শত্রুর তো অভাব নেই তাদের পেশায়। আর বর্তমান কেসে তো চারদিকেই শত্রু আর অজানা বিপদ।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?

সামনে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ সে দেখতে পেল কুসুম গাছের গোড়ায় একখানা লম্বাটে কালো রঙের বাক্স পড়ে আছে। অনেকটা ট্র্যাভেল ব্যাগের মতো, তবে পুরানো কিন্তু জরাজীর্ণ নয়। অবাক হল সে! এখানে এই জঙ্গলের মধ্যে ট্র্যাভেল ব্যাগ! জায়গাটা অদ্ভুত নির্জন। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই কিছুর। এই ব্যাগটা যে এখানে বহুকাল ধরে পড়ে নেই তা বুঝতে বুদ্ধি লাগে না। এখানে কেউ কোন ব্যাগ যদি ফেলেও যায়, তাহলে এতদিনে তার উপর বুনো লতা থেকে শুরু করে পাতা ইত্যাদি এসে পড়বে। তাছাড়া এমন সাফসুতরো থাকাও সম্ভব নয়। অতএব এই ব্যাগ এখানে বহুদিন ধরে পড়ে নেই। হালে এসেছে। হতে পারে সামনে যে ব্যক্তি দৌড়াচ্ছে, এ ব্যাগ তারই! সে ব্যাগের দিকে কোনওরকমে এগিয়ে গেল। এই ব্যাগটা খুলতে পারলেই হয়তো জানা যাবে, সামনে যে লোকটি দৌড়াচ্ছিল, সে কে?

এই ভেবে সে নীচু হয়ে ব্যাগটার দিকে সবে এগিয়েছে, এমনসময় পিছন থাকে তার মাথায় আঘাত নেমে এল। চোখে যেন সর্ষেফুল দেখল সে। কোনরকমে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে সে আততায়ীকে দেখতে পেল। অজ্ঞানসমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে তার বিস্মিত মন একটা কথাই ভাবতে পারল কেবল, “এই কি সেই?” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content