বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

গতকাল সন্ধের ঘটনার পর রাতেই পুলিশ জায়গাটা হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে ‘নো এন্ট্রি’ বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিল। এটা মেইন রাস্তা নয়, মেইন রাস্তার সমান্তরালে একটা শর্টকার্ট মাত্র। এ-সব রাস্তায় বাস-টাস এত কম চলে যে ট্র্যাফিক জ্যাম হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে কখনও কখনও দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে রাস্তা সম্পূর্ণ ব্লক না হয়ে যায়, সেই কথা ভেবে কিছুদূর অন্তিওর এক-আধটা এই রকম শর্টকার্ট রাস্তা করে রাখা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ সময় এই রাস্তাগুলি নির্জন অবস্থায় পড়ে থাকে। জঙ্গলের কাঠকুটো কিংবা পাতা-সংগ্রহকারীরাও সচরাচর মেইন রাস্তা ধরে চলে। পিচ রাস্তায় জীবজন্তুর আগমন কিছুটা কম হয় বলে আর হাঁটতেও সুবিধা বলেও তারা এমন করে।

শাক্য জায়গাটা দেখছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পাভেলও। গতকাল সন্ধ্যা অবধিও এখানে তার পরিচয় কেউ জানত না বলে তার পক্ষে ঘটনার পর পরই এখানে আসা সম্ভব হয়নি। আর সে খবরও পেয়েছিল দেরিতে। কলকাতার কাছাকাছি হলে সামান্য ঘটনাও চ্যানেলগুলি অসামান্য করে মুহূর্তে যে ভাবে ছড়িয়ে দেয়, এখানে তা আশা করা যায় না। টিভির নিউজে রাতেও সে কিছু দেখতে পায়নি। সকালবেলা থেকে অবশ্য তিন-তিনটে অপমৃত্যুর কথা সামান্য অদলবদল করে হাজারবার ধরে বলেই চলেছে নিউজ-অ্যাংকররা।

শাক্য একটা ভাঙা ডাল দিয়ে গাছের নিচে পড়ে থাকা পাতার স্তুপ ঘাঁটছিল। মূল জায়গাটা ইতিমধ্যেই দেখেছে সে। পুলিশের তরফ থেকে সাদা রঙ দিয়ে সার্কেল টেনে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রক্ত ইত্যাদি ফরেন্সিক তদন্তের পরে ধুয়ে দেওয়া হয়েছে নিয়ম মতো। অতএব কিছু যদি ক্লু থাকেও, তা বিশ বাঁও জলে ভেসে গিয়েছে। মুখ দিয়ে আক্ষেপসূচক শব্দ করল সে। বলল, “পাভেল, কাল যদি ঘটনার পর পর তুমি এখানে আসতে, তাহলে আজ আমাকে আসতে হত না। কিছু না পেয়ে এমন আক্ষেপও করতে হত না!”
পাভেল একটু দূরে উবু হয়ে কিছু সূত্রটুত্র পাওয়া যায় কি না দেখছিল। শাক্যর কথা শুনে সে বলল, ‘আরে, কাল অবধি তো আমি ক্যামাফ্লেজ করে ছিলাম! আসবো কী করে? কাল যদি আসতামও পুলিশ আমায় দেখতে দিত? পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিত!” বলেই মনে পড়ল জীবন বাবু পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। অতএব অপশব্দ ব্যবহার করায় সে জিভ কাটল নিজের মনেই।
“তোমাকে তা দেওয়াই উচিত! অকুস্থলের কাছে থেকেও এভিডেন্স কালেক্ট করতে না পারলে খুব খারাপ লাগে আমার।”
“আই অ্যাম হেল্পলেস শাক্য! কিছু করার ছিল না। তুমিই তো বলেছিলে, যতদিন না তুমি আর একেজি স্যার বলছেন, ততদিন আমাকে নিজের পরিচয় গোপনই রাখতে হবে। তাহলে?”
“হ্যাঁ, তখন তো পরিস্থিতি এত ঘোরালো হয়ে উঠবে বুঝিনি, জানতাম না, একেজির ভাগ্নি আর ভাগ্নি-জামাই জড়িয়ে পড়বে এমন ঘটনার সঙ্গে। সে-কথা ভেবে যদি তুমিও আমার কথা অমান্য করতে তাতে আমরাই লাভবান হতাম। এখন এভিডেন্স কিছু পাওয়া মুশকিল! তার উপর কাল সারারাত থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত জায়গাটা এমন অ্যাবাণ্ডেড পড়ে ছিল যে, এভিডেন্স যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে তা পাওয়া অসম্ভব।”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬২: যেখানে দেখিবে ছাই

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

জীবন চুপ করে শুনছিল সব। শাক্যর কথা শুনে সে বলল, “স্যার, কাল তদন্তের সময় যদিও আমি ছিলাম না, তবে যতদূর জানি, সারা রাত এখানে পুলিশ পোস্টিং ছিল। সকালে এসআই স্যার আবার এসে তদন্ত করেছিলেন, তারপর এখান থেকে পুলিশ পোস্টিং তুলে নেওয়া হয়।”
“এত তাড়াতাড়ি পুলিশ পোস্টিং তুলে নেওয়া উচিত হয়নি!” পাভেল বলল।
“সেটা বুঝি স্যার। আসলে থানায় পুলিশের সংখ্যা তো তেমন বেশি নয়। তার উপর আজ রিসর্টে দু’ দুটো মিসহ্যাপ না ঘটে গেলে হয়তো একজন অন্তত থাকত এখানে”, জীবন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, যেন পুলিশ পোস্টিং না-রাখার দায় তার।
“জীবন, তোমার এস.আই স্যার আজ সকালে যখন এসেছিলেন, তখন তুমি ছিলে তাঁর সঙ্গে?”
“আজ্ঞে স্যার, ছিলাম।”
“ফরেন্সিক টিম এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“আচ্ছা বেশ। তাহলে তাঁদের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই!”
পাভেল বলল, “এতগুলি ইনসিডেন্ট একসঙ্গে ঘটে যাওয়া একটু আশ্চর্যের ব্যাপার বৈকি!”
তার কথার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না শাক্যর কাছ থেকে। জীবনও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। শাক্য হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা জীবন, এই যে সকলে বলছে, কালাদেও সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটিয়েছেন, সে-ব্যাপারে তোমার কী মত?”
“আজ্ঞে স্যার, আমি কী বলব? আমার বলা না বলায় কী যায় আসে!”
“আমি তোমার মতামতই শুনতে চাইছি জীবন। অনেক সময় দেখা যায়, পাকা মাথা যে-পথে ভাবতে পারে না, কাঁচা মাথা সে-পথে ভাবতে গিয়ে সত্যের কাছে পৌঁছে যায়। এইজন্য আমি মনে করি, তোমাদের কথার গুরুত্ব অনেক বেশি।”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু

কথাটায় জীবন যে সামান্য হলেও খুশি হল, সেটা তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। সে বলল, “স্যার। আজকালকার ছেলেপিলেরা হয়তো দু’চার পাতা লেখাপড়া শিখে কালাদেওকে মানে না। কিন্তু আমরা যারা একটু সেকালের কিংবা ছোটবেলা থেকে কালাদেওকে বিশ্বাস করে আসছি, তারা জানি, কালাদেও যদি রুষ্ট হন, তাহলে তিনি না-করতে পারেন, এমন কিছুই নেই। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। কালাদেও রুষ্ট হলে অনেক কিছু করতে পারেন যেমন সত্য, তেমনই তিনি অকারণে রুষ্ট হন না—এ-কথাও সত্য। আজ অবধি এমন ঘটেনি যে, কালাদেও অকারণে একের পর এক মানুষকে খুন করে যাচ্ছেন। কেন করবেন? এরা কেউ তাঁর থানে যায়নি, এরা কেউ তাঁর থানকে অশ্রদ্ধা করার মতো কোন কাজ করেননি, অথচ কালাদেও তাঁর থান থেকে বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং এক-ওকে-তাকে হত্যা করছেন, এই ব্যাপারটা মেনে নিতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। কালাদেওকে আমরা দেবতা বলে বিশ্বাস করি, তিনি হত্যাকারী নয়!”

জীবনের গলায় উষ্মার সঙ্গে বেদনার সুরও মিশে ছিল। শাক্য বলল, “কথাটা আমারও মনে হয়েছে কেস-স্টাডি করে। এর আগে যতগুলি ঘটনা কালাদেওর কাজ বলে দাবি করা হয়েছে, সেখানে কয়েকটি ক্ষেত্রে সেই দাবির পক্ষে অনেক লু-ফলস্ আছে। কালাদেও হঠাৎ কেন রাস্তায় নেমে এসে কারও মাথা চিবিয়ে খেতে যাবেন কিংবা রিসর্টে গিয়ে দু’-দু’জনকে হত্যা করবেন, সেটা স্পষ্ট নয়!”
“আমার মনে হয় স্যার, এ-সব কাজ কালাদেওর নয়। আমি কিন্তু স্যার নিজের বিশ্বাসের কথা বলছি!” জীবন ইতস্তত করে বলতে।
শাক্য বলেন, “হ্যাঁ, আমি তো আগেই তোমায় বলেছি, তুমি তোমার নিজের জ্ঞান-বিশ্বাস মতে যা সত্যি বলে মনে হয়, তা বলো।”
“হ্যাঁ স্যার। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কেউ এইসব কাণ্ড করে কালাদেওর নামে চালাতে চাইছে না তো? কারণ, সে জানে, কালাদেওর কীর্তি হলে পুলিশ কী আইন তার কিছু করতে পারবে না। আশ্চর্য এই যে, কালাদেও যদি নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করতে যাবেন, তাহলে তাঁর থান থেকে এই রাস্তা কিংবা রিসর্ট তো অনেকটাই দূরে। সেখানে পৌঁছানোর পথে অনেক গ্রাম পড়ে, শহরের রাস্তাতেও কম লোকজন থাকে না, তাদের কাউকে হত্যা না করে, এতদূর পৌঁছে তিনি মানুষ মারতে যাবেন, কেন?”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

পাভেল বলল, “আচ্ছা জীবন, যদি এমন হয় যে, যাদের কালাদেও হত্যা করেছেন, তারা কোন না কোন অপরাধ করেছিলেন, যা আমরা জানি না, কিন্তু কালাদেও জানেন, হয়তো সেই কারণেই তিনি হত্যা করেছেন তাদের, তাহলে?”
জীবন বলল, “তাহলে তাঁদের সম্পর্কে তদন্ত করলেই জানা যাবে, তাঁরা অপরাধ করেছিলেন, না কী করেননি। আমি আসলে বলতে চাইছি, ছোট থেকে শুনে আসছি, কালাদেও বছরের একদিন ছাড়া জাগেন না, আর বিনা অপরাধে তিনি কাউকে শাস্তি দেন না।”
শাক্য বলল, “এই কথাটাই আমি জানতে চাইছিলাম। স্থানীয় বিশ্বাস কিন্তু অনেকসময় আমাদের সত্যের কাছাকাছি এনে দিতে সাহায্য করে। আমরা নিজেই জানি না, কোথায় কী সূত্র লুকিয়ে আছে। কথায় বলে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই…!”
পাভেল বলল, “কিন্তু ছাই ওড়াতে ওড়াতে বেশি দেরি না হয়ে যায়…! যে-হারে এই শান্ত-নিস্তরঙ্গ জায়গায় একের পর এক খুন হয়ে চলেছে, তাতে ভয় হচ্ছে, আবার কিছু না ঘটে যায়!”
শাক্য বলল, “ভয় নেই বন্ধু। এত তাড়াতাড়ি আর কিছু ঘটবে না বলেই বিশ্বাস। তবু যদি ঘটে, এবার অন্তত তুমি আছ, আমি আছি, আর এই জীবন বাবুর মতো সাচ্চা দিল, বুদ্ধিমান ইনসান আছেন। আশা করা যায়, আমরা পারবো সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে।”
কথা বলতে বলতে শাক্য এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল, “কে ওখানে কে?”
সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে কারুর দৌড়ানোর শব্দ শোনা গেল। পিছন পিছন শাক্য দৌড়াচ্ছিল। পাভেল এবং জীবন মুহূর্তমাত্র হতভম্ব হয়ে গিয়ে তারপর দ্রুত শাক্যর পদাঙ্ক অনুসরণ করল।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content