রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

“নুনিয়া, কাল বিকেলে ওই লোকটা তোমায় কী বলছিল?”
নুনিয়া একটা কাগজের ঠোঙা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। তার দৃষ্টি নিচের দিকে। একটু আগে ফাদার তাকে ওই ঠোঙায় ছোলাভাজা খেতে দিয়েছিল। কেমন বিটনুন ছড়ানো। দু’ একটা বেশ শক্ত, কিন্তু তাতে কী? দাঁতে পড়তেই যে কটকট করে শব্দ হয়, সেই শব্দ শুনতে বেশ লাগে তার। ফাদারের প্রশ্ন তার কানে গেল বলে মনে হল না।

এখন দুপুরবেলা। ফাদারের ঘরের ভিতরদিকে একটা অ্যান্টিচেম্বার আছে, বাইরে থেকে সহজে এই ঘরটা বোঝা যায় না, নুনিয়া অবশ্য জানে, এর আগেও তাকে এই ঘরে নিয়ে এসেই ফাদার কথা বলেছেন, আর কথাবার্তা সন্তোষজনক না হলেই চাবুক মেরেছেন, তারপর পাঠিয়ে দিয়েছেন কালাঘরে। আজকেও তার ভাগ্যে হয়তো এমন পরিণতি আছে। যদিও মার খেতে খেতে, “মর মর” শুনতে শুনতে তার চামড়া পুরু হয়ে গিয়েছে, মরতেও আর তেমন ভয় করে না। কিন্তু মারতে পারে না। বরং অন্যের বিপদ-আপদের কথা শুনলে তার বুকের ভিতরটা আশঙ্কায় শিউরে ওঠে। প্রাণ চায়, তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু সে ছোট্ট মানুষ, কতটুকুই বা পারবে? তবুও চেষ্টা করে! না করলে তার ভাত হজম হতে চায় না যেন।
ফাদার বেশ কড়া গলায় আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি আমার কথা শুনতে পাওনি নুনিয়া?”
নুনিয়া মুখ তুলে তাকাল। তার বড় বড় চোখে ব্যাকুলতা এবং এক বিপন্ন জিজ্ঞাসা একই সঙ্গে খেলা করে বেড়াচ্ছিল।
ফাদার বললেন, “কী হল বল! হ্যাঁ বা না—কোনও একটা জবাবদিহি তোমায় করতেই হবে!”
নুনিয়া বলল, “কোন লোকটা?”
ফাদারের ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলে উঠল যেন। নুনিয়া মেয়েটি ন্যাকা সাজতে চাইছে? নাকি অন্য কোনও পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে জবাব এড়িয়ে যেতে চাইছে? দাঁতে দাঁত চেপে বেশ মোলায়েম গলাতেই যেন হুমকি দিলেন তিনি, “নুনিয়া, তুমি বোধহয় এর আগের সমস্ত ইনসিডেন্ট ভুলে গিয়েছ? তোমার শরীর থেকে কি আগের শাস্তির চিহ্নগুলি সব মিলিয়ে গিয়েছে?”
“স্যরি ফাদার, আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না যে আপনি কার কথা জানতে চাইছেন!”
“গতকাল বিকেলে তুমি যখন বাইরে টো-টো করে ঘুরে বেড়িয়ে দয়া করে চার্চের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ কর, তারপর যে লোকটা তোমায় ফিসফিস করে কী-সব জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি জানতে চাই সে তোমায় কী বলেছে?”
“ওহ্ সেই ডক্টর !”
“তুমি চেনো ওঁকে?”
“দেখেছি তো?”
“কোথায়?” উত্তেজনায় ফাদারের চোখ থিরথির করে কাঁপছিল, কিন্তু তিনি বাইরে তা প্রকাশ করতে চাইছিলেন না। যদিও তাঁর হাবেভাবে ভিতরের মানুষটি বেরিয়ে আসছিল।
“আমার দাদাকে যখন হেলথ সেন্টারে নিয়ে গিয়েছিল, তখন!” খুব শান্ত গলায় কেটে কেটে উত্তর দিল সে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬০: সন্দেহের পর সন্দেহ

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-২৫: ধৃতিমানের ওপর কি শ্রেয়া নজর রাখছিল? নাকি অন্য কেউ?

ফাদার একমুহূর্ত থমকালেন। বললেন, “কে? বুধন মাহাতো?”
“ইয়েস ফাদার!” মাঝেমধ্যে নুনিয়া যে কেন ইংরাজি বিদ্যা দেখাতে চায়!
“তা তুমি কি তারপর থেকে নিয়মিত সেখানে যাও?”
“নো ফাদার। আই নেভার ওয়েন্ট দেয়ার এগেইন। ক্যান বিলিভ।”
“হোয়াট ডিড দ্য ডক্টর ওয়ান্ট টু নো ফ্রম ইউ মাই ডিয়ার?”
“নাথিং স্পেশাল ফাদার। হি আসকড মি অ্যাবাউট মাই হেলথ, মাই এডুকেশন, দ্যাটস অল! এই রকম তো দু’জন পরিচিত মানুষ পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে করেন, তাই না ফাদার? আপনিই তো বলেছিলেন।”
“বলেছিলাম। কিন্তু তুমি জানো নুনিয়া যে, এই চার্চের কিছু নিয়ম আছে। সেই নিয়মের পঞ্চম ধারার দুই নম্বর উপধারাতে স্পষ্ট লেখা আছে, চার্চের কোন আবাসিক চার্চের বাইরের কোনও লোকজন কিংবা সংস্থার সঙ্গে আগাম অনুমতি ছাড়া কথা বলবেন না! কী, আছে তো এই নিয়ম?”
নুনিয়া ঘাড় নাড়ল। সে জানে।
“কিন্তু যদি কেউ সেই নিয়ম ব্রেক করে, তাহলে চার্চ কি তাকে ক্ষমা করবে?”
“ক্ষমা তো করাই উচিত। যদি আমরা একটু মানবিকভাবে ভাবি, তাহলে বুঝতে পারব, অপর একজন মানুষ আর-একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হলে কুশল-বিনিময় করবে, ভালোমন্দের খোঁজখবর নেবে, তারপর হয়তো আবার বহুদিনের জন্য দু’জন-দু’দিকে চলে যাবে। এই আসা-যাওয়ার মাঝখানে কি দু-দণ্ড আমরা কথা বলতে পারি না? তাহলেও কি প্রভু আমাদের উপর রাগ কর্বেন?” নুনিয়া প্রশ্ন করল উল্টে। তার মুখে বড়দের মতো কথা শুনে ফাদার আশ্চর্য হয়ে গেলেন। কোথা থেকে এ-মেয়ে পাচ্ছে রসদ? কে যোগাচ্ছে তার মুখে কথা? এ-মেয়ে যে কোনও কথাই বলতে পারে, তা নিয়ে ফাদার কেন, এ-তল্লাটের শতকরা পঁচানব্বই জন মানুষের মনেই সন্দেহ আছে। আজ অবধি এত গুছিয়ে সে কারুর সঙ্গে কথা বলেছে, এমনটি এর আগে কখনও ঘটেনি। কী হল মেয়েটার? ভূতে ভর করল নাকি? যা এখানে-ওখানে ঘোরে মেয়েটি, হতেই পারে তেমন। অন্তত হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। যদিও ওর নিজেরই যা চেহারার ছিরি, তাতে কোনও ভূতও যে ওর প্রতি আকৃষ্ট হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে!
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৪: কোন সকালে মুক্তির অপেক্ষায় ‘ত্রিযামা’

ইতিহাস কথা কও: পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি

ফাদার বললেন, “বাহ! বেশ উন্নতি হচ্ছে তো তোমার! এত গুছিয়ে কথা বলতে কে শেখালো তোমায় নুনিয়া?”
নুনিয়া মাথা নিচু করল। কোনও উত্তর দিল না।
ফাদার আসল প্রশ্নে এলেন। “তুমি কাল ডাক্তারকে কিছু দিয়েছিলে নুনিয়া?”
“কী?”
“সেটাই তো আমি জানতে চাইছি নুনিয়া? কী দিয়েছিলে?”
“কিছু না তো ! আমার কাছে কীই বা আছে যে তাঁকে দেবো?”
“তুমি মিথ্যে বলছ নুনিয়া! জানো তো, প্রভু মিথ্যে বলা পছন্দ করেন না!”
“আমি সত্যি কথাই বলছি!”
“তাহলে সাইকেল মাহাতো ভুল দেখেছে?”
“কে সাইকেল মাহাতো ?”
“মনে হচ্ছে তুমি সাইকেলকে চেনো না !”
“আমি অনেককেই চিনি ফাদার। কিন্তু মুখ চিনি। সাইকেল মাহাতো নামের লোকটিকেও হয়তো মুখ চিনি কিংবা চিনি না!” নুনিয়া ধীর গলায় বলল। তার মধ্যে এতটুকু ভয় কিংবা উত্তেজনার চিহ্নমাত্র নেই।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪১: মা সারদার অন্তরঙ্গ সেবক শরৎ মহারাজ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৯: কামিনী রায়, জনৈক বঙ্গমহিলা

ফাদার একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়েটি যে ভাবে বলছে তাতে মনে হচ্ছে সে সত্যি কথাই বলছে। নুনিয়ার মতো বোকাহাবা মেয়ে মিথ্যে বলার মতো বুদ্ধি ধরবে না। তাহলে সাইকেল কি ভুল দেখেছে? না কি সে ভুল শুনেছে? সাইকেল তাকে ভয় দেখিয়ে নিজের আখের গোছাতে চাইছে না তো? ফাদার মাথা নাড়লেন। নুনিয়া হয়তো সত্যিই চেনে না সাইকেল মাহাতোকে। এখন যদি সাইকেলের ছবি তাকে দেখান তিনি, তাহলে সে চিনে যাবে, যা সাইকেলের পক্ষে যেমন, তাঁর নিজের পক্ষেও মারাত্মক হয়ে যেতে পারে। নাহ্, এখনই মেয়েটিকে কিছু বলা যাবে না। বরং মিষ্টি কথায় তাকে বিদায় দিতে হবে যেন কিছুই হয়নি। সেই মতো ফাদার বললেন, “নাহ্, তবে সাইকেলের ভুলই হয়েছে, নুনিয়ার মতো মিষ্টি মেয়ে তো আর মিথ্যে বলতে পারে না। আচ্ছা, যাও। নিজের রুমে যাও। দেখো, আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ো না যেন। একটু লেখাপড়ায় মন দাও এবার। খুব শিগগিরিই তোমাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেবো বলে ভেবেছি আমরা। সেখানে তোমার বেটার এডুকেশন হবে। যাও!”

নুনিয়া উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীর শান্ত পদক্ষেপে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে একবার ফিরে তাকাল। খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেল, ফাদার মোবাইলে ঝুঁকে কী করছেন। তার মুখে রহস্যময় হাসি খেলে গেল। মনে মনে বলল, প্রভু, এরা কী করছে এরা তা নিজেও জানে না, এদের ক্ষমা করো।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content