রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

বাথটাব (পর্ব-১)

পুজো আসছে। পুজো এলে আপামর বাঙালি দেশে-বিদেশে প্রবাসে সর্বত্র আনন্দে মেতে ওঠেন। দুর্গাপূজা বাঙালি জীবনের শ্রেষ্ঠ উৎসব। বহু মানুষ অন্য রাজ্য থেকে কলকাতায় দেশের বাড়িতে ফেরেন, অনেকেই বিদেশ থেকে স্বদেশে ফেরেন। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় গল্পে গানে খাওয়াদাওয়ায় পূজোর কটা দিন হই হই করে কেটে যায়। সারাবছর অনেক না পাওয়ার মধ্যেও সমাজের আপামর জনসাধারণ আরো একটা বছরের জীবনসংগ্রামের রসদ খুঁজে পায় ওই অসুরদলনী সিংহারূঢ়া মাতৃমুর্তির মধ্যে। বাড়ির পুজো পাড়ার পুজো বিখ্যাত পুজো অখ্যাত পুজো—সর্বত্র সপরিবারে মা মহামায়া বিরাজমান। মহাষ্টমীর সামান্য কয়েক মিনিটের পুষ্পাঞ্জলির মধ্যে সারাবছরে করা নানান ভুলভ্রান্তির যেন শোধন হয়।
কিন্তু বাবুর মনে দুর্গাপুজো এখন আর কোনও আনন্দ বয়ে আনে না। রানাঘাট হরচন্দ্রপুরের চৌধুরীবাড়িতে জাঁকজমক করে দূর্গাপুজো হতো। এখনও নিশ্চয়ই হয় কিন্তু কেমন হয় সে পুজো সে খবর বাবু ওরফে ধৃতিমান চৌধুরী রাখে না। মা চলে যাবার পর থেকেই দূর্গাপুজো বাবুকে আর টানতো না। স্কুলপড়ুয়া বাবু মা চলে যাবার ঠিক পরের বছর ঠাকুরদালানে মায়ের চোখ আঁকার সময় মনে মনে বলেছিল—
—কেমন মা তুমি এত ছোট বয়সে আমার মাকে কেড়ে নিলে। আজ থেকে তোমার পুজোতে আমি আসবো না। পুষ্পাঞ্জলিও দেবো না।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৪৮: সুচেতার স্বপ্ন

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

সেই থেকে পুজোর ক’টা দিন বাবুকে দেখা যেত না। ঘরবন্দি হয়ে গল্পের বই নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখত, বুবুকে নিয়ে থাকতো। নতুন জামাকাপড় কোনও পুজোতে পরত না। বাড়িতে কাজের লোকেরা জানতো বাবু না খেয়ে ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে বসে আছে, তারা সময় সময়ে খাবার দিয়ে যেত। কিছুদিন বাদে বাবু যখন আরেকটু বড় তখন বাবাও চলে গেলেন। সংসার আত্মীয় এগুলো ঠিক কেমন কৈশোর থেকে যৌবনে পা দেওয়া ধৃতিমান চৌধুরী সেটা স্পষ্ট বুঝে ফেলেছিল। তারপর তো একসময় বুবুকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলো চৌধুরীবাড়ি ছেড়ে চিরকালের মতো।

কলকাতার উল্টোডাঙায় মুচিবাজারের কাছে যেখানটায় বাবু ভাড়া থাকে তার আশেপাশে বিখ্যাত সব পুজো হয়। মহালয়ার পর থেকেই সাজসাজ রব। দু’দিকে রাস্তা বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়, আশেপাশে মাইকের দৌরাত্ম্য মানুষের ভিড় খাবারের দোকান। ভিভিআইপির আনাগোনা এ সব কিছুই বাবুকে স্পর্শ করে না। বুবুর কষ্ট হবে, না হলে সে কলকাতা ছেড়ে এই সময়টা দূরে কোথাও চলে যেত। কিন্তু আমাদের দেশে পোষ্যকে নিয়ে যাতায়াতে অনেক অসুবিধে। খুব কম হোটেলেই পোষ্যকে রাখতে চায়, ট্রেনে আপত্তি। তার কিছু বন্ধুবান্ধব বিদেশে থাকে। তাদের কাছে শুনেছে, ওসব দেশে পোষ্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট মানে টিউব রেলে লোকে স্বচ্ছন্দে পোষ্য-সহ স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়। সহযাত্রীরা বিরক্ত হন না বাধা দেন না। আর একত্র যাতায়াতে অভ্যস্ত হতে হতে পোষ্যরাও যথেষ্ট সংযত ব্যবহার করে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

পুজোর কটা দিন বুবুকে একটু বাড়তি সময় দেয় বাবু। আমাদের ধৃতিমান মানে বাবু খুব একটা মিশুকে নয়। তাই তার কাছে এমনি সময়তেই আড্ডা দেবার লোকজন কম আসে পুজোর সময় তো নয়ই। ফোন আসে মাঝেমধ্যে। আড্ডা মারার আমন্ত্রণ আসে। ধৃতিমান সেগুলো এড়িয়ে যায়। এসময় সে গোগ্রাসে সিনেমা দেখে নানান দেশে নানাধরনের ছবি। শারদীয়া পত্রিকাগুলো উল্টোপাল্টে দেখে। আর মাঝেমধ্যে সিরিয়াল দেখে। এমনি সময়ও কখনও-সখনও কোনও সিরিয়াল একঝলক দেখে নেয়।

নিয়মিত আকৃষ্ট হয়ে নয়, দেখার জন্য নতুন ছেলেমেয়েরা কে কেমন অভিনয় করছে তা জানার জন্য। কাউকে কাউকে দেখে ভালো লাগে সম্ভাবনাময় মনে হয়। বুঝতে পারে ভালো অভিনেতা অভিনেত্রীদেরও ডেলিসোপের নিয়মমাফিক বাধ্যবাধকতা থেকেই সাজপোশাক বা অভিনয়ের একটা গতানুগতিক একঘেয়েমি ধরে রাখতে হয়। কিন্তু তাদের ভালো কাজ করার ক্ষমতা বা ইচ্ছে দুটোই রয়েছে। তার নিজের হাতে এখন ছবি নেই নাটকেরও শো নেই, তাই সেই সব অভিনেতা অভিনেত্রীদের ব্যবহার করার কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু কখনও কখনও মনে হয় যে সে এদের দিয়ে আরো ভালো কাজ করিয়ে নিতে পারতো।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

এ ভাবেই বাবু জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘আমি মিস ক্যালকাটা’র নায়িকা কৌশিকীকে চেনে। এই ধারাবাহিক বহুদিন ধরে চলছে। রাস্তায় ঘাটে হোর্ডিংয়ে ছবিও দেখেছে। বুকস্টলে, পত্রপত্রিকার কভার স্টোরিতে নজর এসেছে।

আজকাল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বা বলা ভালো বিনোদন জগতের অনেককেই এমনকি কোনও কোনও রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রেও ইমেজ প্রমোশনের জন্য মোটা টাকা খরচা করতে হয়। সেই প্রমোশনের মধ্যে ক্রমাগত ইন্টারভিউ নানা ধরনের অনুষ্ঠানে প্রচার, কাগজপত্রে লেখালেখি, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের অ্যাকাউন্ট সামলানো এমনকি টাকার অঙ্ক বেশি হলে এটা সেটা নানান পুরস্কারও পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

তবে কৌশিকী ভালো অভিনেত্রী। ছবির ক্ষেত্রে যেটা খুব জরুরি সেটা হল চোখের জোরালো দৃষ্টি, আর একটা আকর্ষণীয় চেহারা। কৌশিকীর এই দুটোই ছিল। সঙ্গে প্রমোশনের জোর তো ছিলই, স্বাভাবিকভাবেই জনপ্রিয়তার নিরিখে এগিয়ে থাকা ছোটপর্দার কৌশিকী বড়পর্দার আঙিনায় পা রাখল।

দূর্গাপুরের মেয়ে কৌশিকী দত্তগুপ্ত সামনের পুজোয় রিলিজ করা ‘ওহ লাভলি’ ছবির নায়িকা। পুজোর ঠিক আগের শুক্রবার ছবি রিলিজ করবে, হাতে আর মাত্র আট দিন বাকি। খুব স্বাভাবিকভাবে পুরোদস্তুর ছবির প্রোমোশন চলছে। সেই সঙ্গে চলছে পুজোর সময়ে ব্যানার হোর্ডিং-এ প্যান্ডেল জুড়ে থাকা বিজ্ঞাপনের শুটিং। কৌশিকী কলকাতার নিউটাউনের এক নামকরা হোটেলেই ছিল। সেখানেই সকলকে স্তম্ভিত করে দেওয়া দুর্ঘটনাটা ঘটেছে।

টেলিভিশনের খবরটা দেখার পর সকলের মতো ধৃতিমানও চমকে উঠেছিল। তারপর টেলিভিশন চলছিল কিন্তু টেলিভিশনের শব্দ আর কানে আসছিল না। মাথার মধ্যে কৌশিকীর মতো একজন সম্ভাবনাময় অভিনেত্রীকে নিয়ে অন্য কথাগুলো ঘুরছিল। হোটেলের নিজের ঘরের বাথটাবে অভিনেত্রী কৌশিকী দত্তগুপ্ত হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করেছেন।—চলবে।
 

কৌশিকী দত্তগুপ্ত হত্যারহস্য পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ০৩ অক্টোবর ২০২৪

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content