সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

“আপনি কি মনে করেন যে, একজন শিল্পীর বিয়ে করা উচিত নয়?”
“করতে পারে, তবে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরে।”
“তার স্ত্রীর কি তার কাজের প্রতি সহানুভূতি থাকবে না বলছেন? এমন কোনও মহিলা নেই যে স্বামীর কাজের জন্য ত্যাগ স্বীকার করবেন?”
“কি করে করবে? মেয়েদের নিজের জীবন তো পুরোটাই বলি প্ৰদত্ত। আবার কি ত্যাগ করবে সে?”
—এটি বিখ্যাত লেখক হেনরি জর্জ এবং পল ওভার্ট-এর কথোপকথনের অংশ।
এ সব মতামতের অনন্ত প্রবাহ চলেছে যুগে যুগে। বিবাহজনিত অশান্তির ভুরি ভুরি গল্প ছড়িয়ে আছে চারদিকে। এক সমীক্ষায় পয়তাল্লিশ জন বলেছে, বিয়ের পর অশান্তি বেড়েছে। বাকি পঞ্চান্নজন চুপ করে ছিল, বললে আরও অশান্তি বাড়বে বলে। এরকম মজা বিবাহিতদের নিয়ে সারাক্ষণই চলে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৩৪: প্রেমিকা রীনার জন্য সারাটা জীবন নষ্ট হয়ে গেল প্রলয়ের

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

সৃজনশীল, প্রতিভাবান মানুষদের দাম্পত্যজীবনেও অনেক ঝড়ঝাপ্টার কথা শোনা যায়। কেউ বলেছেন বিয়ে, ঝামেলা, তৎজনিত অ-সুখ…এগুলোই শিল্পীর সৃষ্টির উৎস। দার্শনিক নিৎসে মন্তব্য করেছেন—যদি বউ, সন্তান, চাকরি—সব থেকে মুক্তই হই তবে তো জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বঞ্চিত। নিজেকে একটি বিশ্লেষণী যন্ত্র ছাড়া কিছুই মনে হবে না। আশা, নিরাশা, ওঠাপড়া, বঞ্চনা, পাওয়া না পাওয়া—সব মিলেই পরিপূর্ণ জীবন। বিয়ে না করলে এ সব অভিজ্ঞতাই হবে না।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

টমাস মান নিৎসের দ্বারা অনেকটাই অনুপ্রাণিত। তিনি এর সূত্র ধরে একটি মজার গল্প বলেছেন। একজন লেখকের সৃজনশীলতা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিবাহিত জীবনের সুখের স্রোতে। স্বপ্নের মতো সুখে মজে ছিল তাঁর কল্পনার বিচরণ। কোনও কিছুই সৃষ্টি করতে পারেননি, যতদিন এ সুখসায়রে ডুবে ছিলেন। তারপর তার স্ত্রী যখন ব্যাভিচারিনি হলেন, তখনই তাঁর সৃজনশীলতার স্ফুরণ ঘটল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

আবার এই মানই পরবর্তী সময়ে অন্য কথা বলেছেন। তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি ডক্টর ফসটাস-এর নায়ক এক চুক্তিতে পার্থিব ভালোবাসাকে সাত বছরের জন্য বিনিয়োগ করে সৃজনশীলতাকে বেছে নিয়েছেন। বিয়ে এবং সৃজনশীলতার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অসম্ভব মনে হয়েছে তাঁর।

মনস্তাত্বিক বিশ্লেষক কার্ল ইউং মনে করেন, একজন শিল্পীর মনের লড়াই কখনও মেটার নয়। সেখানে তাঁর ব্যক্তিজীবন, তাঁর শিল্পীসত্বার সঙ্গে ক্রমাগত আপোষ করে চলে। তাই মনের মাঝের লড়াই থামে না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৭: পাঞ্চালদেশে যাত্রাপথে পাণ্ডবদের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় কিসের ইঙ্গিত?

সাধারণ মানুষ জীবন থেকে সুখ আর নিরাপত্তা পেলেই সন্তুষ্ট। কিন্তু শিল্পীর অন্তরে থাকে এক দুর্দম প্যাশন। ব্যক্তিজীবনের কিছু চাওয়া পাওয়া সেই প্যাশনের আগুনে ছারখার হয়ে যায়। নইলে যে নতুন সৃষ্টি পথ পাবে না। উচ্চতর অনাবিল এক আনন্দের দিশারী হতে পারবেন না শিল্পী।
আবার লরেনসের মত, লেখক বলেন যে শিল্প জীবনের আয়না। জীবনের মধ্যেই আছে শিল্প সৃষ্টির অফুরান রসদ। নরনারীর সম্পর্ক, বিবাহিত জীবনের জটিলতা, সমস্যা এসব থেকে সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী লেখা।

নদী যেমন স্রোতস্বিনী হয় বাধা পেলে, লেখক ও বিখ্যাত মানুষের সৃজনশীলতাও তেমনি পল্লবিত হয়েছে বিবাহিত জীবন এবং প্রেমের নানা দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। বিশ্ব সাহিত্যের কিছু দিকপাল সাহিত্যিক, দার্শনিকের বিবাহিত জীবনকে আলোকপাত করতেই এ লেখার অবতারণা এবং পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা। প্রকাশিত হবে প্রতি শুক্রবার ‘সময় আপডেটস’-এর পাতায়। —চলবে।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content