কার্বিদের লোকনৃত্য।
সারা ভারতে একাধিক ভাষা, ধর্মের, জাতির লোক রয়েছে। অসমও তার ব্যতিক্রম নয়। বরাক ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের এক এক অঞ্চলে এক এক জাতি গোষ্ঠীর জনগণ বসবাস করেন। তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতি সব আলাদা আলাদা। তবুও সবাই অসমের বুকে বহু বছর ধরে শান্তিতে বসবাস করছে, অসমের জন গোষ্ঠীদের সম্পর্কে বলতে গেলে আহোমদের কথা বলতেই হয়। অসমে মূলত দুটি উপত্যকা—ব্রহ্মপুত্র নদী কেন্দ্রিক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং বরাক নদী কেন্দ্রিক বরাক উপত্যকা। এই দুই উপত্যকাতেই বিভিন্ন ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী রয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আহোমদের সংখ্যা গরিষ্ঠতাই বেশি। আহোমরা দীর্ঘদিন অসমের রাজদণ্ড শক্ত হাতে ধরে রাখা আহোমরা মূলত চিনের ইউনান প্রদেশের মুংমাও রাজ্য থেকে অসমে এসে বসবাস শুরু করে। চুকাফা ছিলেন অসমে আহোম সোমরাজের প্রতিষ্ঠাতা। আহোমরা মূলত টাই জনজাতির লোক। সময়ের সঙ্গে অসমের সমাজ সংস্কৃতিরতে আহোমদের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার আরও একটি প্রাচীন জনগোষ্ঠী হচ্ছে কলিতারা। তারা সমতল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রথম বসবাস শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৪৫০০ এর মধ্যে কলিতারা সর্বপ্রথম এই উপত্যকায় আসে। কলিতাদের ৯২টি উপাধি রয়েছে। তাদের ভাষা অসমীয়া। কলিতারা মূলত কৃষিজীবী, তবে তারা মুগা কাপড়ের বুননে পারদর্শী। তাদের তৈরি অসমের সিল্ক সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত হয়।
অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার আরও একটি প্রাচীন জনগোষ্ঠী হচ্ছে কলিতারা। তারা সমতল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রথম বসবাস শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৪৫০০ এর মধ্যে কলিতারা সর্বপ্রথম এই উপত্যকায় আসে। কলিতাদের ৯২টি উপাধি রয়েছে। তাদের ভাষা অসমীয়া। কলিতারা মূলত কৃষিজীবী, তবে তারা মুগা কাপড়ের বুননে পারদর্শী। তাদের তৈরি অসমের সিল্ক সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত হয়।
আরও পড়ুন:
অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৩৭: বিহু-র আনন্দে মেতে ওঠে পুরো অসম
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন
অসমের বরাক উপত্যকায় রয়েছে ৩টি জেলা। বরাক উপত্যকায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতির, গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেছেন। বাঙালি, মণিপুরি, ভোজপুরি, বর্মণ, অসমীয়া, মার, মিজো, কুকি এবং আরও অনেক জাতির লোক এ অঞ্চলে মিলে মিশে বসবাস করছে। অসমের প্রাচীন জনজাতিদের মধ্যে এক হচ্ছে কাছারি। এই কাছারিরা মঙ্গোলীয় কিরাত গোষ্ঠীর অন্তরগত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মহাভারতের গল্প অনুযায়ী এই কাছারিরা ভীম এবং হিড়িম্বার পুত্র ঘটোৎকচের বংশ ধর।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত
বর্তমান ডিমাহাসাও জেলার অধিবাসীরা ডিমাসা জাতির লোক। এদের ভাষার সঙ্গে বড়োদের ভাষার অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তারা ৪০জন পিতৃপুরুষের বংশধর হিসেবে ৪০টি বংশে বিভক্ত। ডিমাসা সমাজে মহিলাদেরকেও সমান প্রাধান্য দেওয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে যে, মহিলারা ৪২ জন মাতৃর বংশোদ্ভূত। বড়ো জনজাতি অসমের উন্নত জন জাতিগুলির মধ্যে একটি। উত্তর পূর্ব ভারতে এদের বসবাস বহু আগের থেকেই। বড়োদের নিজস্ব সাহিত্যও রয়েছে। বড়ো সমাজে তাঁত বুনন প্রায় প্রতিটি ঘরেই হয়। তবে এরা কৃষিজীবী। বড়দের লোকনৃত্য এবং গীতের সুন্দর উপস্থাপনা লক্ষ্য করা যায়। এদের প্রধান উৎসবগুলির মধ্যে বৈশাখ মাসে পালিত বৈশাগু উল্লেখ যোগ্য একটি আনন্দ উৎসব। বিশেষত বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে নাচ গান ,খাওয়া দাওয়ার মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করা হয়। দোমাচি, কাত্রি-গাচা, আমতি চুরা ইত্যাদি উৎসবও বড়োরা আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকে।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
অসমের আদিম অধিবাসী সকলের মধ্যে একটি হচ্ছে কারবি জনগোষ্ঠী। তারা মূলত পাহাড়ের বুকে বসবাস করা এক জনজাতি। এক সময় তাদেরকে মিকির জনজাতি বলা হত, আর তারা যে পাহাড়ে থাকত সেই পাহাড়কে মিকির পাহাড় বলা হত।তারা নিজেদেরকে কার্বি বা অ্যালেং বলে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। কার্বিদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, তার নাম ‘জির কেদাম’। দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় এখানে। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য ‘জিরছং’ নামের সমিতি গঠন করা হয়।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৭: যুগধর্মের সমর্থনহীন ধর্মচিন্তার স্থান কোথায়?
অসমের ২৩টি জনজাতির মধ্যে মিচিং একটি জনজাতি। অসমের ডিব্রুগড়, শোনিতপুর, যোরহাট, দরং জেলাতে মিচিংরা প্রধানত বসবাস করে। তাদের গ্রামে একজন গাঁওবুড়া থাকে সেই গাওবুড়া বা গাম সমাজ ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। আপং বা মদ তাদের সমাজ জীবনে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। অসমের আরও একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী হল রাভা। অসমের বাইরে মেঘালয়, মণিপুর, এমন কি বাংলাদেশের কিছু কিছু জায়গায় রাভাদের বসতি রয়েছে। রাভাদের সঙ্গে গারো সমাজের ভাষা এবং সমাজ সংস্কৃতির অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তাদের দৈহিক গঠনে মংগোলীয় জাতির বৈশিষ্ট দেখা যায়। ক্ষেত-খামারি তাদের মূল জীবিকা। রাভারা খুব ভালো বুনন কার্য করে থাকে। রাভারা পিতৃপ্রধান জন জাতি।
বড়োদের হাতে বানানো উলের চাদর।
হাজং অসমের আরও একটি জনজাতি। এদের জন সংখ্যা খুব বেশি নয়। তাদের মতে তারা মূলত কামরূপ জেলার হাজো অঞ্চলে বাস করত। তাদের জন সংখ্যা হাজার ছিল, সেই থেকে হাজং শব্দের উৎপত্তি। আবার অনেকের মতে হাজং শব্দটি গারো শব্দ হা এবং জং থেকে এসেছে। হাজংদের মুঠ ২১টি কুল বা গোত্র রয়েছে। নিজের কুলের ভেতরে বিবাহ নিষিদ্ধ। তারা মূলত কৃষিজীবী।
অসমের বন্ধুর মাটিতে বসবাস করা জাতিরা নিজেদের ঐতিহ্য বহন করে বসবাস করছে। এই প্রতিবেদনে কয়েকটা মাত্র জাতি জনজাতির সম্পর্কে কিছু কথা লেখা সম্ভব হয়েছে। বৈচিত্রপূর্ণ অসমের বসবাসকারী দের সবাইকে নিয়েই অসমের সম্পূর্ণতা। ঐক্যই অসমের মূল মন্ত্র।—চলবে।
অসমের বন্ধুর মাটিতে বসবাস করা জাতিরা নিজেদের ঐতিহ্য বহন করে বসবাস করছে। এই প্রতিবেদনে কয়েকটা মাত্র জাতি জনজাতির সম্পর্কে কিছু কথা লেখা সম্ভব হয়েছে। বৈচিত্রপূর্ণ অসমের বসবাসকারী দের সবাইকে নিয়েই অসমের সম্পূর্ণতা। ঐক্যই অসমের মূল মন্ত্র।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।