শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রামচন্দ্রের বনবাস নিশ্চিত, অঙ্গে মুনিবেশ, মানসিক প্রস্তুতি সম্পন্ন। এ বার যাবার পালা। রাজা দশরথের দৃষ্টিতে রামের চীরবেশ, অসহনীয়। জ্ঞান হারালেন রাজা। আনমনে পুত্রের দিকে চেয়ে, যেন তাঁকে চিনতে পারলেন না বা দেখতে পেয়েও প্রত্যুত্তর দিতে পারলেন না। রাজার মনে যে রয়েছেন রাম। রামনামের চিন্তামাত্র কেঁদে উঠলেন তিনি। তাঁর কেবলই খেদ ও অনুশোচনা। তিনি নিশ্চয়ই জন্মান্তরে বহু গাভীকে বৎসহারা করেছেন এবং বহুপ্রাণীর প্রতি হিংসাচরণ করেছেন, যার পরিণামে আজ এই দুঃখবোধ। নির্ধারিত সময়ের আগে তাঁর মৃত্যু নেই। কৈকেয়ীর দ্বারা প্রদত্ত ক্লেশভোগ চলতেই থাকবে। তাই তাঁর খেদোক্তাতি, সম্মুখে এই অগ্নিতুল্য পুত্রের সূক্ষ্মবেশের পরিবর্তে তাপসবেশধারী রূপ আজ আমায় দেখতে হল। যোঽহং পাবকসঙ্কাশং পশ্যামি পুরতঃ স্থিতম্। বিহায় বসনে সূক্ষ্মে তাপসাচ্ছাদমাত্মজম্।। একমাত্র কৈকেয়ীর স্বার্থপরতা এই সার্বিক দুঃখের কারণ।

রাজা দশরথ এমন বলতে বলতেই কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হল তাঁর। অস্ফুট উচ্চারণে তিনি বলে উঠলেন, “রাম”। আর কোন কথা বলতে পারলেন না। পর মুহূর্তে সচেতন হয়ে, সাশ্রু নয়নে সুমন্ত্রকে বললেন, শ্রেষ্ঠ অশ্ব যোজনা করে রথ প্রস্তুত করা হোক, সেই রথে রাম যাবেন জনপদের সীমানা ছেড়ে গহন অরণ্যে। গভীর দুঃখে বলে চললেন রাজা,এমনটা বোধ হয় গুণীজনদের শাস্ত্রনির্দেশিত গুণের ফল। তা না হলে রাম গুণী, তবুও পিতামাতা এমন সৎ ছেলেটিকে অরণ্যে নির্বাসিত করছেন। এবং মন্যে গুণবতাং গুণানাং ফলমুচ্যতে। পিতা মাত্রা চ যৎ সাধুর্বীরো নির্ব্বাস্যতে বনম্।।

সুমন্ত্র রাজার আদেশানুসারে রথ প্রস্তুত করলেন। রাজা, কোষাধ্যক্ষকে নির্দেশ দিলেন, সত্ব বিদেহনন্দিনী সীতার চতুর্দশ বৎসরের পরিধানযোগ্য বহুমূল্য বসনভূষণ আনা হোক। সেই সব বিচিত্র বস্ত্রালঙ্কারে সজ্জিতা হয়ে যেন নবোদিত সূর্যের কিরণছটায় আকাশতুল্য ঘরের আলোকিত শোভা হয়ে উঠলেন বৈদেহী সীতা। রানি কৌশল্যা তাঁকে স্নেহ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে বললেন, এই জগতে স্বামীর স্ত্রীর প্রতি সদাচরণের পরিবর্তে যাঁরা বিপদগ্রস্ত স্বামীকে গ্রাহ্য করেন না তাঁরাই অসতী নারী। এঁরা বহু সমাদৃতা হয়ে সুখ ভোগ করলেও, অল্প কষ্ট অনুভব করলেই দোষারোপ করে, স্বামীকে পরিত্যাগ করেন। অসতী নারীর স্বভাবচরিত্র মোটেই সুবিধার নয়। তাঁদের স্বভাব বোঝা দায়। তাঁরা দুর্বলচরিত্র, অল্প বিরক্ত হলেই ক্ষণে ক্ষণে পূর্ব প্রেম ভুলে যান। পতির কুলমর্যাদা,অর্জিত বিদ্যাবত্তা, উপহারদান, স্বামীর ত্রুটি উপেক্ষা করা প্রভৃতি গ্রআহ্য করে না। এই নারীদের হৃদয়বৃত্তি ক্ষণভঙ্গুর।
সাধ্বী স্ত্রীর লক্ষণ হল, সচ্চরিত্রে অবিচল থাকা, সত্যনিষ্ঠতা, একমাত্র পতিকেই পরম পবিত্ররূপে বিশিষ্টতাদান। তাই তুমি আমার নির্বাসিত পুত্রকে অবজ্ঞা করো না। ধনী হোক বা নির্ধন, সে কিন্তু দেবতুল্য পুরুষ। স ত্বয়া নাবমন্তব্যঃ পুত্রঃ প্রব্রজিতো বনম্। তব দেবসত্ত্বমস্ত্বেষ নির্দ্ধনঃ সধনোঽপি বা।। শাশুড়িমায়ের ধর্মসঙ্গত উপদেশ শুনে, করজোড়ে, সীতা জানালেন,উপদেশানুসারেই তিনি চলবেন। স্বামীর প্রতি ব্যবহারবিষয়ে তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, এবিষয়ে তিনি শুনেছেন। কিন্ত তাঁকে অসতীনারীর সঙ্গে যেন তুলনা না করা হয়। চাঁদের প্রভাতুল্য অবিচল তাঁর ধর্মবোধ। তন্ত্রীহীন বীণার অস্তিত্ব নেই, চক্রবিহীন রথ বৃথা, শতপুত্রের জননী হয়েও স্বামীহীনা স্ত্রীর সুখানুভব হয় না।

সুখের বিষয়ে, পিতার দান পরিমিত, ভায়ের উপহার অপর্যাপ্ত নয়, পুত্রের দেয়বস্তুও নয় অপরিমিত, শুধু স্বামীই অপরিসীম সুখদাতা। তাই কোনও মহিলা পতিকে কেন পুজো করবেন না? স্বামীর প্রতি সাধারণ ও বিশেষ ধর্মবিষয়ে তিনি অবগত আছেন। দেবতুল্য স্বামীকে কী তিনি অবহেলা করতে পারেন?

সীতার হৃদয়গ্রাহী কথায়,উদারমনা রানি কৌশল্যার চোখ থেকে যুগপৎ হর্ষবিষাদজনিত অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। রাম মায়েদের মধ্যে মাননীয়া কৌশল্যাকে জোড়হাতে বললেন, দুঃখিনী হয়ে পিতার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না। অচিরেই চৌদ্দ বছর কেটে যাবে তখন যেন এক যুগের ঘুম ভেঙ্গে উঠে সুহৃদবর্গ পরিবৃত অবস্থায় আমাকে দেখতে পাবেন। সুপ্তায়াস্তে গমিষ্যামি নব বর্ষাণি পঞ্চ বা। সমগ্রমিহ সম্প্রাপ্তং মাং দ্রক্ষ্যসি সুহৃদ্বৃতম্।।

মাকে সান্ত্বনাবাক্যে আশ্বস্ত করে সাড়ে তিনশত বিমাতার দর্শনে গেলেন রাম। কৃতাঞ্জলিপুটে বিমাতাদের ‘মা’ সম্বোধনে শ্রদ্ধা জানিয়ে বললেন, যদি অজ্ঞানতাবশত তিনি যদি মায়েদের প্রতি কঠোর, রুক্ষ বাক্য বলে থাকেন বা কোন অনিষ্ট আচরণ করে থাকেন তবে তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী তিনি। শুনে, সেই রাজমহিষীদের শোক উথলিয়ে উঠল। সেই স্থান, ক্রৌঞ্চীদের ক্রন্দনতুল্য করুণরোদনে ভরে উঠল। একদা মুরজ,পণব ও মেঘনামক বাদ্যযন্ত্রের গম্ভীর মন্দ্র ধ্বনিতে মুখরিত রাজপ্রাসাদে আজ মহিলাদের হাহাকার ও আর্তনাদে ভারি বিষাদময়, বিপন্নতার আবহ।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৭: সাধারণের প্রতি পাণ্ডবদের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ কোন মহাভারতীয় শিক্ষা?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৯৯: জলাশয়ে ডিমপোনা ছাড়ার আগে জলজ কীটপতঙ্গের নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে

রাম সীতা উভয়েই পিতার অনুমতি নিয়ে মাকে অভিবাদন জানালেন। এ বার সহযাত্রী লক্ষ্মণের বিদায়ে নেবার পালা। লক্ষ্মণ, জ্যেষ্ঠা রামমাতা কৌশল্যাদেবীকে অভিবাদনান্তে জননী সুমিত্রা দেবীর পাদবন্দনা করলেন। দেবী সুমিত্রার অন্তরে প্রবল মনকষ্ট। তবু তিনি, স্নেহভরে পুত্রকে সদুপদেশ দিলেন। লক্ষ্মণ রামের অনুগত তাই তাঁর সঙ্গে বনবাসে তাঁর আপত্তি নেই। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সহানুগমন ও আদেশ অনুসারে চলাই কর্তব্য। তাঁর সেবায় আত্মনিয়োগ, সর্বদাই কাম্য। সম্পদে, বিপদে রাম যে অবস্থায় থাকবেন, তিনিই হবেন লক্ষ্মণের শেষ আশ্রয়। দানধর্ম, যজ্ঞ, দীক্ষাগ্রহণ, যুদ্ধে মৃত্যুবরণ— এ সবকিছুই ইক্ষ্বাকুকুলের পরম্পরাগত ধর্ম। লক্ষ্মণের বনবাসকালে রাম হবেন পিতৃতুল্য, সীতা হবেন মাতৃবৎ এবং তোমার কাছে অরণ্য হবে অযোধ্যা নগরী, এমন মনে করে, সুখে যাত্রা করো বাছা। রামং দশরথং বিদ্ধি মাং বিদ্ধি জনকাত্মজাম্। অযোধ্যামটবীং বিদ্ধি গচ্ছ তাত যথাসুখম্।। পাছে মন দুর্বল হয়ে পড়ে তাই হয়তো লক্ষ্মণজননী সুমিত্রা রাঘব রামকে তাড়া দিলেন, ‘গচ্ছ”গচ্ছ’ যাও যাও।

সারথি সুমন্ত্র আসন্ন বনবাসকালের সূচনার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। রাম যেখানে যেতে ইচ্ছুক তিনি সেখানেই দ্রুত রথ চালনা করবেন। সীতা বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে আনন্দিতমনে সেই সূর্যসম দীপ্তিময় রথে আরোহণ করলেন। রাম ও লক্ষ্মণ দুই ভাই সেই স্বর্ণকান্তি বহ্নিসম রথটির আরোহী হলেন। সঙ্গে নিলেন, সীতার চতুর্দশ বৎসরের পরিধেয় বসন ভূষণ,দুই ভায়ের অস্ত্র ও কবচপূর্ণ পেটিকা। সুমন্ত্র রথের ঘোড়া চালিত করলেন।

রাম দীর্ঘকালের জন্যে নিবিড় অরণ্যে চলেছেন, সমস্ত অযোধ্যানগরবাসী যেন মোহগ্রস্ত হয়ে তাঁর অনুসরণরত হল। হাতি, ঘোড়ার উন্মত্ত ব্যাকুল চিৎকারে সমগ্র নগরীর আকাশ বাতাস মথিত হল। রামের অনুসরণরত ব্যথিত আবালবৃদ্ধবনিতা। তাঁদের রামবিচ্ছেদের প্রতিক্রিয়া যেন, গ্রীষ্মের প্রবল উত্তাপে ঘর্মাক্তের জলের অভিমুখে ছুটে যাওয়া। তাঁরা রথের পাশে,পিছনে অশ্রুভরা ব্যাকুলনয়নে ছুটতে ছুটতে সুমন্ত্রের উদ্দেশে আর্ত চিৎকার করলেন, সংযচ্ছ বাজিনাং রশ্মীন্ সূত যাহি শনৈঃ শনৈঃ। মুখং দ্রক্ষ্যাম রামস্য দুর্দ্দশং সো ভবিষ্যতি।। ওগো সারথি, রথের রশি সংযত করো গো। ধীরে চলো। অচিরেই যাঁর দর্শন দুর্লভ হবে সেই রামের মুখখানি একবার দেখব।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

অযোধ্যাবাসীদের অনুমান, রামচন্দ্রের মায়ের মনটা নিশ্চয়ই লোহা দিয়ে তৈরি। দেবপ্রতিম পুত্রটি চলেছেন বনে, অথচ মায়ের হৃদয় ভেঙ্গে চৌচির হচ্ছে না? সূর্যকিরণ যেমন মেরুকে পরিত্যাগ করে না তেমনই দেবী সীতা স্বামীর ছায়াসঙ্গিনী হয়েছেন। সতত প্রিয়বাদী লক্ষ্মণের, জ্যেষ্ঠ রামের অনুগমনের সিদ্ধান্ত, যথাযথ। এই সুকৃতির ফলে তাঁর ইহলোক ও পরকালের অভ্যুদয় নিশ্চিত। এমন কথা বলাবলি করতে করতে, অনুসরণকারী জনগণ চোখের জল আর রোধ করতে পারলেন না।

এদিকে প্রিয়ং পুত্রং দ্রক্ষ্যামীতি প্রিয় পুত্রকে দেখব, বলতে বলতে, শোকার্ত স্ত্রীগণ পরিবৃত, দীনহীন রাজা দশরথ, রাজভবন থেকে নির্গত হলেন। যূথপতি হাতিটি ফাঁদে পরলে যেমন হস্তিনীরা ঘোর শব্দে ভরিয়ে তোলে পরিবেশ, ঠিক সেইরকম, বিলাপরতা মহিলাদের তুমুল ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেলেন রাজা। তখন রাজা দশরথের অবস্থা, রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের মতো। সারথি সুমন্ত্র পরলেন দোটানায়। রামচন্দ্রের আদেশ, ত্বরিতং বাহ্যতাম্ দ্রুত রথ চালান। জনতার অনুরোধ, তিষ্ঠেতি থামো। সারথি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেন। শোকার্ত পুরবাসীদের চোখের জলে সিক্ত হল পথ।

এই দৃশ্য দেখে রাজা দশরথ ছিন্নমূল মহীরুহের মতো লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। মাছেদের চলাচলজনিত সংক্ষোভে পদ্মে যেমন জল ঝরে পরে নিরন্তর, তেমনই পুরনারীদের নয়ন, অবিরত অশ্রুসজল হয়ে উঠল। হতচেতন রাজা দশরথকে দেখে কোলাহল করে উঠল সমবেত জনতা। হা রাম, হা রাম ধ্বনিতে সচকিত রাম, রাজপথে সমাগত শোকাকুল পিতামাতাকে দেখতে পেলেন। পাশাবদ্ধ ঘোটকশাবক যেমন মুখ ফিরিয়ে, প্রকাশ্যে মায়ের দর্শন পায় না তেমনই ধর্মপাশে আবদ্ধ রাম পিতামাতার দিকে ফিরে তাকাতে পারলেন না। রজোচিত বাহনে অভ্যস্ত পিতামাতাকে পায়ে হেঁটে আসতে দেখে, শুধু মাত্র সারথিকে হয়তো অস্ফুটস্বরে বলতে পারলেন, শীঘ্রং যাহীতি শীঘ্র চলুন। অঙ্কুশের আঘাতে ব্যথিত হাতিটির মতো রাম পিতামাতার এই দুঃখজনক পরিণতি সহ্য করতে পারলেন না।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৭: ওরাল হেলথ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

গোবৎসের স্নেহের আকর্ষণ সত্ত্বেও গাভীটি যেমন গোপের বলপূর্বক তাড়ণায় গৃহমুখী হয় তেমনই দশা জননী কৌশল্যার। হা রাম, হা সীতে, হা লক্ষ্মণ বলে তারস্বরে চিৎকার করতে করতে, চোখের জলে ভেসে, রামচন্দ্রের রথের উদ্দেশ্যে ধাবিত হলেন। রথযাত্রী তিনজনের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে তখন। বার বার মাকে দেখলেন রাম। সুমন্ত্রের অবস্থা হল, তিনি যেন রথের চক্রদুটির মধ্যের দণ্ডটি। একদিকে পিতা বলছেন ‘থামো’ অপরদিকে পুত্রের আদেশ ‘চলুন’। দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ অসহনীয় হয়। রাম বুদ্ধি দিলেন,রামকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাবার পরে, রাজার আদেশ লঙ্ঘন করায়, সুমন্ত্র তিরস্কৃত হতে পারেন। তিরস্কার প্রতিহত করবার উপায় হল সারথির উত্তর, নাশ্রৌষমিতি রাজানমুপালব্ধোঽপি বক্ষ্যসি’ শুনতে পাইনিতো। আর রামের বনগমনে বিলম্ব হলে পাপ হবে সারথির।

রামের প্রস্তাবে, সারথির মনের সংশয় দূর হল। অশ্বের গতি বাড়িয়ে দিলেন তিনি।জনতার অনুমতি নিয়ে রথের ঘোড়া ছোটালেন সুমন্ত্র। অনুগমনরত জনগণ রামকে প্রদক্ষিণ করে বিদায় নিলেন। রামমুখী তাঁদের মন,কিন্তু ফিরল না।রাজা দশরথ, রামকে অনুসরণ করতে লাগলেন। মন্ত্রীরা তাঁকে বোঝালেন, যমিচ্ছেৎ পুনরায়ান্তং নৈনং দূরমনুব্রজেৎ। যাঁর পুনরাগমন কাঙ্খিত, বেশি দূর পর্যন্ত তাঁর অনুগমন, সমীচিন নয়। অমাত্যদের পরামর্শ অনুযায়ী সস্ত্রীক রাজা ধর্মাক্তশরীরে, বিষণ্ণ মনে, রামের পানে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন।

প্রত্যেকের মনেই হয়তো এক রাম আছেন,যে সত্তা ত্যাগী, বিবাগী হতে চায়। বাবা মায়ের স্নেহবেষ্টনীর বন্ধন ছেড়ে একার জীবন বেছে নিতে চায়। কিছু মায়া, প্রাত্যহিকতার পিছুটান সঙ্গে রয়েই যায়। মহাপুরুষদের গৃহত্যাগের লক্ষ্য—কখনও ভোগবাদী জীবনের অসারতা খুঁজে পেয়ে নির্মোহদৃষ্টিতে নির্জনে কোন পরম শক্তির আশ্রয় বা সেখানে পৌঁছানোর চেষ্টা বা গার্হস্থ্যজীবনের বন্ধন উপেক্ষা করে বৈরাগ্য বেছে নেওয়ার আন্তরিক তাগিদ। পিতার আবেগময় নিষেধ, মায়ের ব্যাকুলতা,স্বজনবর্গের মনোবেদনা, সর্বোপরি আপামর প্রজাপুঞ্জের দাবি অবহলায় সরিয়ে রামচন্দ্র চললেন বনে। না, কোন বৈরাগ্যের প্রলেপ নেই তাঁর আচরণে, নেই কোন পরমার্থিক সত্যে উপনীত হওয়ার তাগিদ।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

তারুণ্যের, ভরাযৌবনে রাজসুখ প্রত্যাখ্যান, সঙ্গে কোন ভোগ্যবস্তু নেই, নেই কোনও রাজকীয় পরিষেবার বন্দোবস্ত। মহান ঋষিতুল্য পুরুষ স্ত্রীকেও গার্হস্থ্যধর্মের অঙ্গ হিসেবে পরিত্যাগ করে চলে যান পরমার্থের সন্ধানে। রাম স্ত্রীর বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছেন। রামের বনবাস,আরোপিত। ঘটনার পরম্পরাগত ফলভোগী রাম।অনেকসময়ে পিতার অদূরদর্শিতার খেসারত দিতে হয় সন্তানকেও। রাম সেভাবেই স্বেচ্ছায়, শ্রদ্ধাভরে পিতা দশরথের বরদানের সিদ্ধান্তকে কার্যে রূপায়িত করেছেন। সুমন্ত্রের প্রতি তাঁর আদেশ ‘ত্বরিতং বাহ্যতাম্’ মনটিকে অশ্বশক্তিতে চালিত করে, তিনি অতিক্রম করে যেতে চাইছেন, মোহ, মায়া, বিষয় আশয়, স্নহবন্ধন, পিছুটান।

এই নির্মোহ অনাসক্তিতে কোন গভীর তাত্ত্বিক উপলব্ধির মানসিক প্রস্তুতি নেই। রাম বৈভবময় অতীতকে উপেক্ষা করেছেন ঔদাসীন্যে, অনাগত আসন্ন দুরূহ ভবিষ্যতচিন্তা তাঁর মনে স্থান পায়নি। তিনি বেঁচেছেন বর্তমানে। যেটি আশু কর্তব্য সেটি পালনে কোন দ্বিধা,দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। তাই রাম উচ্চাসনে পরমপুরুষত্বে অধিষ্ঠিত না হয়ে, হয়েছেন আপামর ভারতবাসীর মনের মানুষ। রাম বনবাসগমন বিষয়ে দু’ বার ভাবেননি। যিনি রাজা দশরথের বহু কামনার ধন, শ্রেষ্ঠত্বের অলিখিত দাবিদার জ্যেষ্ঠ পুত্রটি, পিতার দায়বদ্ধতাপালনকেই, পিতার প্রতি নিজের কর্তব্যপালনের অংশ, মনে করেছেন। ওয়ার্ড অফ অনার, দেওয়া কথার সম্মান রক্ষা, পিতৃসত্যরক্ষার নামান্তর। বনবাসযাত্রায় সঙ্গে নিয়েছেন অস্ত্র, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, অপরকে রক্ষা ও আত্মরক্ষায় যা অপরিহার্য, পরিধানে তপস্বীর চীরবস্ত্র, অন্তরে ঋষিসুলভ নির্লিপ্ততা। আদর্শ রাজর্ষি রামচন্দ্র,রাজা হয়েও যিনি ঋষি।

অযোধ্যার ভাবি আদর্শ রাজর্ষি,রামচন্দ্র।ভাবি কালে,রাজা হয়েও ঋষির মানসিকতায়, স্ত্রীকে ত্যাগ করেছেন অক্লেশে। রামের পরিণত পুরুষরূপে আত্মপ্রতিষ্ঠায়,পরোক্ষে শিক্ষাগুরু বিশ্বামিত্রের প্রভাব যেন ক্রিয়াশীল হয়েছে। বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়োচিত দৃঢ়চিত্ততায় ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিলেন।ক্ষত্রিয় রামচন্দ্র স্বমহিমায়, চারিত্রিক বলে যেন ঋষিত্বে উন্নীত হয়েছেন। ত্যাগের আদর্শে বিশ্বাসী ভারত, তাই কী রামনামের মধ্যে পুরুষোত্তমকে খুঁজে পান?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content