কাঁচাকান্তি মন্দির।
অসমের বরাক উপত্যকার কাঁচাকান্তি মন্দির ভক্তদের এক বিশেষ আকর্ষণের জায়গা। এক প্রাচীন মন্দিরও বটে। এখানকার সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির এবং মন্দির কেন্দ্রিক কিছু প্রচলিত অলৌকিক ঘটনার গল্প। কথিত আছে কাঁচাকান্তি দেবীরা তিন বোন দেবী কাঁচাকান্তি, দেবী সিয়ামা এবং দেবী নিমাতা বা নৃমাতা। দেবী কাঁচাকান্তি তাঁর মন্দির উদারবন্দে অবস্থিত এবং খাসপুরের বাঘেরকোণা অঞ্চলেও একটি কাঁচাকান্তি মন্দির অবস্থিত কিন্তু এই মন্দিরটিতে মহিলাদের প্রবেশ অধিকার নিষিদ্ধ।
দেবী শ্যামা যিনি সিয়ামা নামে এখানে প্রসিদ্ধ তাঁর মন্দির অবস্থিত ঠালিগ্রাম চা বাগানের কাছে নাগাডুম অঞ্চলে। এই দেবীর মন্দিরে নারীর প্রবেশ অধিকার নেই। বর্মণ সমাজের পুরুষই পুরুত হন। এখানে একটি গাছের নিচে বলি হয়। জনশ্রুতি, যিনি পুরুত তিনি নাকি পর্বরতী পুরুত কে হবেন তা স্বপ্নাদেশ পান। নৃমাতার তিনটি মন্দির রয়েছে। একটি বড়খোলা বাজারে, একটি বরখোলার জাটিঙ্গা নদীর বাম পাড়ে, আরও একটি বড়খোলার উজান নগরে। এখানে কোনও বিগ্রহ নেই। একটি পাথরে পূজা করা হয়।
দেবী শ্যামা যিনি সিয়ামা নামে এখানে প্রসিদ্ধ তাঁর মন্দির অবস্থিত ঠালিগ্রাম চা বাগানের কাছে নাগাডুম অঞ্চলে। এই দেবীর মন্দিরে নারীর প্রবেশ অধিকার নেই। বর্মণ সমাজের পুরুষই পুরুত হন। এখানে একটি গাছের নিচে বলি হয়। জনশ্রুতি, যিনি পুরুত তিনি নাকি পর্বরতী পুরুত কে হবেন তা স্বপ্নাদেশ পান। নৃমাতার তিনটি মন্দির রয়েছে। একটি বড়খোলা বাজারে, একটি বরখোলার জাটিঙ্গা নদীর বাম পাড়ে, আরও একটি বড়খোলার উজান নগরে। এখানে কোনও বিগ্রহ নেই। একটি পাথরে পূজা করা হয়।
প্রচলিত অলৌকিক গল্পগুলিকে কেন্দ্র করে কখনও কখনও কোনও কোনও জায়গা বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। সেই মন্দির বা দেবালয়ে দূর দূর থেকে ভক্তরা আসেন। স্থানীয় মানুষদের অর্থনৈতিক অবস্থাও নির্ভর করে সেই তীর্থক্ষেত্রকে ঘিরে। বরাক উপত্যকার কাঁচাকান্তি মন্দিরও ঠিক এমনই একটি মন্দির। কাছাড় জেলার উধারবন্দ অঞ্চলে অবস্থিত এই কাঁচাকান্তি মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অনেক রকম গল্প। এই দেবী লৌকিক না পৌরাণিক তা বলা শক্ত। তবে দেবী কালীর প্রতিমাই পূজিত হয় এখানে। কিন্তু এই মন্দিরকে কাঁচাকান্তি দেবীর মন্দির কেন বলা হয় তা এক কথায় বলা একটু কঠিন হবে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৩৪: ব্রহ্মপুত্র নদ ও কিছু গল্প
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং
বরাক উপত্যকার আরও একটি বিখ্যাত মন্দির হচ্ছে কাঁচাকান্তি মায়ের মন্দির। শিলচর শহর থেকে প্রায় ১২ কলমিটার দূরে উদারবন্দে এই মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরটি ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত তা সঠিক কেউ বলতে পারেন না। কথিত আছে কাছাড়ের ডিমছা রাজার শাসন কালে এই মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। আবার এও শোনা যায়, কোঁচ রাজা এই মন্দিরের জন্য জমি দান করেন। অনেকের মতে, কাছাড়ি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে কাঁচাকান্তি মন্দির প্রতিষ্ঠাত করেন। কিন্তু সেই মূর্তিটি নাকি এক জয়ন্তীয়া রাজা হরণ করে নিয়েছিলেন।
অনেক দিন একটি খড়্গকে বেদীতে রেখে পুজো করা হত। তার পর বর্তমান মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এখন যে মূর্তিটি পুজিত হচ্ছে তার নিচে ১৩৪০ বাংলা কুলচন্দ্র দেব লিখা রয়েছে। এই কুলচন্দ্র দেব মূর্তি নির্মাণের খরচ আদি দিয়ে ছিলেন। ডিমাসা শব্দ ‘কাচাউড়ি মাডাই’ থেকে কাঁচাকান্দি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
অনেক দিন একটি খড়্গকে বেদীতে রেখে পুজো করা হত। তার পর বর্তমান মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এখন যে মূর্তিটি পুজিত হচ্ছে তার নিচে ১৩৪০ বাংলা কুলচন্দ্র দেব লিখা রয়েছে। এই কুলচন্দ্র দেব মূর্তি নির্মাণের খরচ আদি দিয়ে ছিলেন। ডিমাসা শব্দ ‘কাচাউড়ি মাডাই’ থেকে কাঁচাকান্দি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৮: চরম শত্রুর সঙ্গেও মতের মিল হলে বন্ধুত্ব হয়, আবার মতের মিল না হলেই শত্রুতা
এও বলা হয়, ‘কেচাই খাতি’ বা ‘কাঁচা খাউড়ি’ শব্দ থেকে কাঁচাকান্তি শব্দটি এসেছে। অনেকে মনে করেন কাছাড়ের ডিমাসা রাজারা এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন। ডিমাসা ‘কাচাউদি মাডাই’ শব্দ থেকে কাঁচাকান্দি শব্দটি এসেছে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে এই ‘দেবী বড় জাগ্রত দেবী’। প্রচলিত গল্পে আছে এক বার এক মহিলা অসূচি অবস্থায় মন্দিরে প্রবেশ করেন। পুজো শেষ করে ফিরে যাবার সময় তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তার পর তার সঙ্গীরা দেবীর মূর্তির মুখে সেই মহিলার শাড়ি টুকরো দেখতে পান। অনেকে বলেন, সেই থেকে এই মন্দিরের নাম হয় কাঁচাকান্তি। এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে একাধিক অলৌকিক গল্প। শহরের ভিড়ের থেকে একটু দূরে অবস্থিত মন্দিরটিযে দর্শনার্থীদের মনে শান্তির বার্তা নিয়ে আসে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৪৬: দুবেজিকে নিয়ে ধৃতিমানের অনুমান সত্যি
বলা হয় এক সময় এখানে নর বলি হত কিন্তু এর ঐতিহাসিক সত্যতা জানা নেই। এই নর বলিকে ঘিরে রয়েছে এক মজার গল্প। একবার দেবীর বলি খুঁজতে গিয়ে রাজার দূতরা এক ব্রাহ্মণ বালককে ধরে নিয়ে আসে। তাঁর পরিচয় গোপন করার জন্য তাঁর গলার পৈতে ছিঁড়ে ফেলে। ব্রাহ্মণ বালকটি তাই আর কোনও রকম কথা বলতে পারছিল না। কারণ ব্রাহ্মণের পৈতে ছিঁড়ে গেলে নতুন পৈতে না পরিধান করা পর্যন্ত কোনও কথা বলতে নেই।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১০: মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
ছেলেটিকে এক জায়গায় আটক করে রাখা হয়। এদিকে দেবীর পুজো চলছে পুরোহিত কিছু ভুল মন্ত্র উচ্চারণ করলে সেই ছেলেটি মুখ দিয়ে বিকট আওয়াজ বেরকছিল। তাঁর আওয়াজ সেই পুরোহিতের এবং উপস্থিত সবার কানে পৌঁছয়। তাঁকে সেই পূজা স্থানে নিয়ে আসার পর অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করাতে সে মুখ দিয়ে কোনো কথা বলছিল না। তখন পুরোহিত তাঁকে আবার পৈতে পরিয়ে দিলে সে বলে, যে পুরোহিত মশাই ভুল মন্ত্র পড়ছিলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি জানান যে, তিনি একজন ব্রাহ্মণ সন্তান। রাজা সেদিন থেকেই নরবলি বন্ধ করে দেন। বলা হয়, সেই ছোট্ট ছেলেটি ছিলেন বৃহন্নারোদিয় পুরাণের রচয়িতা ভুবনেশ্বর বাচস্পতি।
কাঁচাকান্তি দেবী।
তবে এই ঘটনা গুলির কোনোও লিখিত প্রমাণ না থাকায় তার সত্যতা জানা মুশকিল। মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ধর্মীয় ভাবনা। তবে এ কথাও স্বীকার করতে হয় যে স্থানীয় হিন্দু মুসলিম, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ এই উদারবন্দে মা কাঁচাকান্তির মন্দিরে নিজেদের মনোবাসনা পূরণ করার আর্জি নিয়ে মা এর কাছে আসেন। আর মা তার স্নেহ আঁচলে স্থান দেন তাঁর সন্তানদেরকে। এমনি কত প্রাচীন গল্প জড়িয়ে রয়েছে একাধিক পুরনো মন্দিরের সঙ্গে। মানুষের বিশ্বাসে সেই মন্দির হয়ে উঠে বিখ্যাত এক তীর্থস্থান।—চলবে।
*ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।