রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

সুদীপ্ত ব্যাজার মুখে উঠে পড়েছিল। একটু নির্ভেজাল বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ অভিষেক মালাকর তাকে দেবেন না বলেই যেন ঠিক করেছেন। সে ভেবেছিল, আজকের অবকাশে একটু ঘুমাবে ভালো করে। দিন কয়েক ধরে যা সব চলছে, মাথা এবং শরীর কোনওটাই বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। তারপর ঘুম থেকে উঠে যদি সময়-সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে একটা ওয়েবসিরিজ দেখবে। দিন পনেরো হল, ও-সব দেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে কাজের চাপে। তার উপর দিন পাঁচেক ধরে কালাদেও নামক অপদেবতা যা-সব খেল দেখাচ্ছেন, তা বলে বোঝানো দায়। যত ভাবছে সে, মাথা ঘুলিয়ে যাচ্ছে তার।
পরীক্ষিৎ তার গলার আওয়াজ শুনে দরজার কাছে এসে দেখছিল। তাকে উঠে পড়ে পুলিশের উর্দি নিতে দেখে বলল, “এখন আবার থানায় যেতে হবে না-কি বাবু?”
শর্টসের উপর ট্রাউজার পরতে পরতে সুদীপ্ত বলল, “আর বলিস না। তোদের এই বড়বাবু আমার লাইফ হেল না-করে ছাড়বেন না। ভেবেছিলাম একটু বিশ্রাম নেবো, তাও কপালে নেই!”

পরীক্ষিৎ বলল, “সেটাই তো দেখছি! আপনি বলেছিলেন বলে আমি ম্যাসাজের লোকটিকে ফোন করে দিয়েছিলাম। বলেছিল সন্ধ্যের দিকে আসবে। তা ওকে না করে দিই তবে?”

সুদীপ্তর মনে পড়ে গেল, গা-হাত ম্যাজম্যাজ করছে বলে সে পরীক্ষিৎ-কে বলেছিল, মানসকে ফোন করতে। মানস একজন ফিজিওথেরাপিস্ট কাম ম্যাসিওর। আজকাল কোমরে সামান্য সমস্যা হয় বলে স্থানীয় অর্থোপেডিক একজনকে দেখিয়ে তাঁরই পরামর্শ মতো মানসকে আজকাল ডেকে নেয় সে। সপ্তাহে অন্তত একবার। সবসময় হয় না যদিও। তবে ম্যাসাজ নিয়ে অনেকটা ভালো থাকে সে। আজ কোয়ার্টারে ফিরেও পরীক্ষিত-কে বলেছিল, মানসকে খবর দিতে। সেই মর্মে মানসের সঙ্গে পরীক্ষিৎ কথা বলেছে। কিন্তু এখন কী করবে বুঝতে পারছিল না সে। সত্যব্রতবাবু বুধনের ব্যাপারে কী বলতে এসেছেন, সেটার অন্য ইমপ্যাক্ট কিছু আছে কি-না, কিছুই সে আন্দাজ করতে পারছে না।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭২: পথে হল দেখা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

অভিষেক মালাকর তো বলেই খালাস, “এসে শুনে যাও একটু।” এ-যেন স্ত্রী স্বামীকে ডেকে বলছে, “ওগো, একটু শুনে যাও না গো !” যত্তসব। সে জানে, এখন থানায় একটু শুনতে যাওয়ার অর্থ আজকের এ-বেলার ছুটিটাকে স্যাক্রিফাইস করে থানার কাজে লেগে পড়া। কিন্তু মানসের অনেকরকম অ্যাসাইনমেন্ট থাকে। তাকে আসতে বলে তারপর যদি সুদীপ্তর নিজেরই সময় না হয়, তা-হলে বেচারার পুরো লস্। এই সময় সে অন্য ক্লায়েন্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারত। আবার এমন যদি হয় যে সত্যব্রত-চ্যাপটার অল্প সময়েই শেষ হয়ে গেল, তখন আবার তার নিজেরই আপশোষ হবে। কী করবে ঠিক করতে না-পেরে সে বলল, “আমি আগে থানায় গিয়ে দেখি কেমন অবস্থা, তারপর তোকে বলছি। এক ঘণ্টা পরে জানিয়ে দিস না-হয়!”
“আপনি থানায় গেলে আর ছাড়ান পাবেন বলে মনে হয়? তার চেয়ে কাল আসতে বলি। আগে থেকে বললে, সে-ও অন্য কোন কাজ ঠিক করে নিতে পারে!”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৪: জোড়াসাঁকোয় পাগল-যাচাই

পরীক্ষিৎ মাঝেমধ্যে বুদ্ধিমানের মতো কথা বলে। সুদীপ্ত সায় দিল। তার ড্রেসচেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল। সে হাতে ঘড়ি পরছিল। এই ঘড়ি পরাটা তার কাছে অন্যতম জরুরি একটা কাজ। অথচ কাজের চাপে ঘড়ি দেখার সময়ই পায় না বেশিরভাগ সময়। ছোট গঞ্জ হলে কী হবে, পাশের রাজ্যের বর্ডার কাছেই বলে, সবসময়েই ছোটখাটো কিছু-না-কিছু ঘটেই চলে। তবে কালাদেওর মতো চাপ অনেকদিন কোন কেস দেয়নি। এক শেষ না হতে আর-এক। দিন-তিনেক যতগুলি লাশ পাওয়া গেল একের পর এক, তাতে মনে হচ্ছিল, কালাদেওর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। এই গঞ্জশহর এর আগে এতগুলি ধারাবাহিক মৃত্যু আগে কখন দেখেছে বলে মনে হয় না।

স্থানীয় কাগজগুলি এতটাই উৎসাহিত হয়ে পড়েছে যে, অন্তর্তদন্ত নাম দিয়ে দু-পাতা এক্সট্রা সাপ্লিমেন্টরি ছাপছে। এমনকি সাপ্তাহিক কাগজও স্পেশাল ইস্যু বলে সপ্তাহের মাঝখানে কাগজ বার করেছে। আর যা হয়, সব কাগজেই নাক ঘুরিয়ে প্রকারান্তরে পুলিশের সমালোচনা। পুলিশ যে অপদার্থ, তাদের দ্বারা যে কিছু হওয়ার নয়, ফেলুদা কিংবা কর্নেল নীলাদ্রি সরকার থাকলে কালাদেও রহস্য আর রহস্য থাকত না, এই হল সবার কথা। শুনে রাগও হয়, হাসিও পায়। মনে হয়, এই সাংবাদিককুলকেই থানায় বসিয়ে দিলে হয়, ওরাই কালাদেওকে লকআপে ভরতে পারবে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

পরীক্ষিৎ দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, “চা করে দেবো, খেয়ে যাবেন?”
“এই তো খানিক আগে লাঞ্চ করলাম রে। তার উপর একজন অপেক্ষা করছেন। এখন চা খাবো না। যদি একবার আসতে অয়ারি, তখন খাবো। আর তা-না-হলে তুই ফ্লাস্কে করে দিয়ে আসিস বিকেলে!”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে। এখন দেখুন গিয়ে কখন ছাড়া পান!” বলে সে চলে গেল। রান্নাঘরে তার অনেক কাজ পড়ে আছে। কাজ সেরে সে একটু বিশ্রাম নেবে।
বেরোতে যাবে, এমনসময় মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠল। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেল তার। নিশ্চয়ই মালাকর? এই লোকটা কোনদিন-না তার হাতে খুন হয়ে যায়! সে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল, নাহ্, মালাকর নয়। অন্য কারও ফোন। অচেনা নম্বর।
সে কল রিসিভ করল, “হ্যালো!”
ও-প্রান্ত থেকে কেউ বলল, “হ্যালো! সুদীপ্তবাবু বলছেন?”
“হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?”
“আমি অরণ্য বলছি? পিশাচপাহাড় রিসর্ট থেকে!”
অরণ্য! ও হো! সেই ওপরচালাক জিম-পাগল লোকটি? সে আবার করে কেন? আজ তাদের মর্গে আসার কথা ছিল না? না-আসার কোন কারণ দেখাতেই ফোন করেছে নিশ্চয়ই। সুদীপ্ত একটু কঠোরভাবে বলল, “আজ আপনাদের মর্গে লাশ আইডেন্টিফাই করতে আসার কথা ছিল না? এলেন না তো? এখন মর্গ তো আজকের মতো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এইভাবে চলে আপনারা নিজেদের দিকেই সন্দেহের তীর ঘুরিয়ে দিচ্ছেন অরণ্যবাবু!”
“স্যার ! আগে শুনুন, আমরা কেন আসিনি!”
ঠিক ধরেছে সে। আগের মতো কঠোর গলায় বলল সে, “তাড়াতাড়ি বলুন। আমার জরুরি কাজ আছে!”
“স্যার”, অরণ্য বলল, “কী করতে যাব? মর্গের লাশ আমাদের বন্ধুর নয়, অন্য কারও!”
“মানে? লাশ শনাক্ত না করেই বুঝে গেলেন ও-লাশ অন্য কারুর? তা লাশটা কার ?”
“সেটা স্যার আমরা কী করে জানব? সেটা বার করা তো আপনাদের কাজ!”
“তাহলে আপনাদের কাজটা কী শুনি ? ফোন করে আমাদের সঙ্গে গপ্সপ্ করা?”
“আজ্ঞে না স্যার। আপনারা এখন কতটা ব্যস্ত আছেন আমরা সকলেই তা জানি। সে-কারণে ফোন করিনি। আমার কথাটা শুনলেই বুঝতে পারবেন, আমাদের না-যাওয়ার কারণ। তবে মানছি, কথাটা আমাদের আগে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা এতটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, ফোন করে জানানোর কথা মাথাতেই আসেনি। স্যরি স্যার!”
“আবার কী হল? আপনারা আসা ইস্তক দেখছি এই জায়গাটা একেবারে দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠেছে!”
“আজ্ঞে স্যার, সে ফিরে এসেছে!”
“সে ফিরে এসেছে ? কে?”
“আর্য!”
“হোয়াট? আর্যবাবু ফিরে এসেছেন? তাহলে যার লাশ পাওয়া গিয়েছে, সে… কে?” সুদীপ্ত হতভম্ব হয়ে গেল।
“আমরাও জানি না। তবে বাইকটা অঞ্জনেরই। আর্য বলছে, সেদিন রাতে ও যেখানে ছিল, সেখান থেকে বাইকটা চুরি যায়। লক্ করা ছিল, তাও। গাড়ির চাবি ওর সঙ্গেই আছে।”
“কিন্তু ফোনে পাওয়া যায় নি কেন ? উনিই বা ফোন করেন নি কেন?”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৮: সর্বত্র জ্ঞান প্রয়োগ করলে বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৯: পুণ্যলতা চক্রবর্তী— রায়বাড়ির সরস্বতী

যেখানে ছিল সেখানে টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছিল না। তার উপর অপরাধবোধ তো ছিলই। অঞ্জনের সাধের নতুন বাইক, অত দাম, ও কোন মুখে সেটা চুরি যাওয়ার খবর শোনাবে, সেই কারণেই ও যোগাযোগ করেনি দু’দিন। এদিকে কী ঘটেছে আগে তা জানতো না। পরে জেনেছে।”
“পারলে ওনাকে আজকেই, না-পারলে কাল সকালেই থানায় আসতে বলুন। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে !”
“হ্যাঁ স্যার। আমরাও তেমনই বলেছি ওকে। থানায় গিয়ে রিপোর্ট করতে। আজ খুব শকড্ হয়ে আছে। অনিলের ওই রকম আনন্যাচারাল ডেথ্… বুঝতেই পারছেন…! কাল নিশ্চয়ই যাবে। আমরাই নিয়ে যাব !”
“কথাটা রাখলে খুশি হব। আর্যবাবুর ফিরে আসাটা কেসটাকে আবার নতুন করে ঘুরিয়ে দিল। ঠিক আছে। রাখছি এখন!” বলে ফোন কেটে দিল সুদীপ্ত। এ-যেন জোরদার এক ধাক্কা! কথাটা শাক্য সিংহকে জানাতে হবে। কিন্তু মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানার জন্য এখন থানাকেই সক্রিয় হতে হবে। কারণ, অফিসার সেটাই আগে জানতে বলবেন। থানায় থানায় এখন মিসিং-ডায়েরি কেউ করেছে কি-না তার খোঁজ নিতে হবে। একইসঙ্গে লোকাল ইনফর্মারদের কাজে লাগাতে হবে, কারণ সব নিরুদ্দেশের কেসে তো আর ডায়েরি হয় না। সুদীপ্তর মুখে চিন্তার মেঘ ঘনিয়ে উঠল। আর্য ফিরে এসেছে, তাহলে মর্গে যে শুয়ে আছে, সে কে? —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content