রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

স্থানীয় এক রিপোর্টারের বাইকে সুদীপ্ত থানায় ফিরে এসে আগে কোয়াটারে গিয়ে স্নান করেছিল। কাপাডিয়া লাঞ্চ খাওয়াতে না পারায় দুঃখপ্রকাশ করছিলেন বারবার। তবে রিসর্টের বর্তমান অবস্থায় লাঞ্চে খুব একটা কিছু জুটত বলে তার মনে হয় না। কাপাডিয়াকে আশ্বস্ত করে সে ফিরে এসে স্নান-খাওয়া সারল। সে বিবাহিত হলেও তার স্ত্রী এখানে থাকেন না। তিনি একটা ব্লকে চাকরি করেন, আপাতত নর্থ বেঙ্গলে পোস্টেড। সুযোগ-সুবিধা হলে পরের পোস্টিং দু’জনে একই জায়গায় নেবে, এমনই ইচ্ছা। এখানে তার সঙ্গে থাকে পরীক্ষিৎ মহান্তি বলে একজন। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব কাজ সেই একা হাতে সামলায়। সুদীপ্ত নিজে ভোজনরসিক, পরীক্ষিৎ রাঁধেও চমৎকার। অতএব বাড়ি ফিরে লাঞ্চ করাটা তার কাছে বেশ সুখকর একটা অভিজ্ঞতা।

খাওয়াদাওয়ার পর মৌজ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ছিল সে, সারা সকাল থেকে দুপুর অবধি ডিউটি করেছে সে। আজ আর থানার দিকে তার যাওয়ার ইচ্ছা নেই। এ-বেলা আর কেউ সামলাক। তাছাড়া আপাতত যে পিশাচপাহাড় রিসর্টের কেস এবং গত পরশুর কালাদেও-কাণ্ডের ধাক্কা সামলাতে হবে তাকে। ওসি মালাওকর সাহেব যে এই নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, তা সুদীপ্ত ভালো করেই জানে। কোনও কেস নিয়ে তাঁকে কখনও মাথা ঘামাতেও দেখেনি সে। সব সময়েই বলেন, “সুদীপ্ত, তোমার অল্পবয়স, তোমার এখন শেখার সময়। আমি ইচ্ছে করেই নাক গলাই না, গলালে গলাতেই পারি, কিন্তু তাতে তুমি কিছু শিখবে না। মনে রাখবে, এখনই নানা কেস থেকে যা শেখার শিখে নিতে হবে তোমাকে, পরে আর সুযোগ পাবে না। আমার কী? রিটায়্যারমেন্ট চলেই এল!”
সুদীপ্ত মনে মনে আসে। সরকারি চাকরিতে জয়েন করে সে বুঝেছে, এই চাকরিতে একদল লোক আছে, যারা চাকরিজীবনের গোড়া থেকে কেবল খেটেই যায়, আর-একদল আছে, যারা প্রথম থেকেই কেবল মুখে জগত মারে। এরাই চাকরিজীবনের শেষে গিয়ে দাবি করে যে, সারাজীবন অনেক কাজ করেছে, এখন চাকরিজীবনের শেষ ক’টা দিন হাত-পা গুটিয়ে আরামে থাকতে চায়। যার হয় না, তার কোনওকালেই হয় না। যে করে, সে প্রথম থেকেই করে—এই হচ্ছে এই চাকরির সর্বজনসম্মত সত্য। অতএব অভিষেক মালাকরের নিশ্চেষ্টতা নিয়ে প্রথম প্রথম ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও এখন আর সে এই নিয়ে মাথা ঘামায় না।

ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে খালি গায়ে সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে সে মোবাইলে কিছু কেস-স্টাডি করছিল। তাদের পুলিশদের কিছু কিছু গ্রুপ আছে, যেখানে নানা অফিসার তাঁদের বিভিন্ন কেসের সম্পর্কে জানান, লেখালেখি করেন। এই সব কেস-স্টাডি নিয়ে সময় কাটাতে তার খুব ভালো লাগে। অনেক কিছু শেখা যায়। এই যেমন এখন সে পড়ছিল আলিপুরদুয়ারে ঘটে যাওয়া একটি কেস, যেখানে একটি লোক চার জন ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। হত্যা করেছে নানা সময়ে। তবে শেষ হত্যার পর সে ধরা পড়ে। তখনই বাকি তিনটি হত্যার সঙ্গে চতুর্থ হত্যার লিঙ্ক করতে সমর্থ হয় পুলিশ।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৮: অন্ধ অতীত

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

কেস-স্টাডি করে জানা যায়, ওই ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে নানা সময়ে ওই চারজন ব্যক্তির সম্পর্ক ছিল। পরে স্ত্রী পালিয়ে যায় পঞ্চম একজনের সঙ্গে। কিন্তু সেই পালানো সুখের হয়নি। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে বউটি। তার স্বামী অবশ্য মনে করত যে, তার স্ত্রী সরল, নিষ্পাপ ছিল। সেই সরলতার সুযোগ নিয়ে এরাই তার মাথা বিগড়ে দেয়। তা না হলে এমন পরিণতি হত না। এই কারণে সে ডিটারমাইন্ড ছিল যে, যে ভাবেই হোক না কেন এই চারজনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে সে। নানা সময়ে নানা ফন্দিফিকির করে নিজের হাতেই সে চারজনকে হত্যা করে তাদের লাশ নিজের বাড়ির পিছনের জঙ্গুলে বাগানে পুঁতে দেয়। পরে চতুর্থ জনের লাশের সঙ্গে সঙ্গে অবশিষ্ট তিন জনের কঙ্কালও বের হয়। আর লোকটি গোটা প্ল্যানটা সফল করেছিল ছয় বছর ধরে। কী ভাবে তাকে ধরা গেল, সে নিয়েই তদন্তকারী অফিসার দারুণ বিশ্লেষণ করেছেন।

পড়তে পড়তেই ফোণ ঢুকল। মালাকর করছেন। ভুরু কুঁচকে গেল তার। এই সময় ফোন করা মানেই আবার থানায় ডেকে পাঠানো এবং কোন নতুন পেটি কেস কিংবা আগের কেসের আপডেটেড রিপোর্ট তৈরি করে হেডকোয়াটার্সে পাঠাতে বলা। তার উপর আজ মর্গে যাওয়ার কথা আছে। ওসি যদিও বলেছিলেন, পার্টি এলে উনি নিজেই তাদের নিয়ে গিয়ে সনাক্তকরণের কাজটা মিটিয়ে নেবেন। এখন হয়ত তারা এসেছে এবং কাজটা সুদীপ্তর উপর চাপাতে চাইছেন!
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি

ফোনটা ধরবে না ভেবেছিল সে। পরে বলবে, ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, নিজের প্রয়োজনে মালাকরবাবু তার কোয়াটারে সটান চলে আসবেন। থানার চৌহদ্দির মধ্যেই কোয়াটার্সগুলি। ওসি নিজেও থাকেন তার একটায়। ফলে ফোন না ধরে পার পাওয়া যাবে না বিবেচনায় সে তেতো মুখে ফোনটা রিসিভ করল, “হ্যালো! বলুন স্যার!”

অভিষেক মালাকরের গলা শোনা গেল, “বুঝতে পারছি সেই ভোর থেকে যা ধকল গিয়েছে তোমার, তুমি খুব টায়ার্ড। কাল রাতেও তো তোমার ডিউটি ছিল। কিন্তু আমি এমন হতভাগ্য যে তোমাকে একটু বিশ্রামের সুযোগ করে দেবো, সে আমার কপালে নেই। সে জন্য বাধ্য হয়েই…”, কথা শেষ করেন না মালাকর। একটা অসহায়তার আক্ষেপ শোনা যায় তাঁর গলায়।

“কী হয়েছে স্যার?” সুদীপ্ত খুব ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞাসা করে। মালাকরের নানা অভিনয়গুণের সে ভুক্তভোগী। অতএব এই আক্ষেপ কুম্ভীরাশ্রু বলেই মনে হয়েছে তার কাছে।
“আর বলো না। এই কালাদেও-কেস আমাকে একেবারে পাগল করে দেবে!”
উত্তেজনায় উঠে বসল সুদীপ্ত, “আবার কেউ কালাদেওর বলি হয়েছে না কি স্যার ?”
“আরে না না। তা নয়। তোমার সঙ্গে একজন কথা বলবেন বলে থানায় বসে আছেন। তুমি চেনোও তাঁকে। সত্যব্রত আচার্য। লোক্যাল হেলথ্‌ সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত ডক্টর। চিনতে পারছ?”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

সত্যব্রত আচার্যকে সে ভালোভাবেই চেনে। আজ বেশ কিছুদিন হয়ে গেল ইনি এখানে আছেন। নিজের কাজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। তবে চার্চের হসপিটালে অনেক সুবিধা বেশি থাকায় স্থানীয়রা ওখানেই যায় বেশি। সত্যব্রত দিনের পর দিন মাছি না তাড়ালেও কাজ করার তেমন সুযোগ পান না। সাধারণ কিছু দরকারে সত্যব্রতর সঙ্গে মুলাকাত হয়েছে তার। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার বেশি আর আলাপ-পরিচয় এগোয়নি। তার কারণ হয়ত, সত্যব্রতর বয়স। আর যাই হোক হেলথ সেন্টারের ডাক্তারবাবুটি ইয়ং চ্যাপ নয়, ওল্ড বস্‌। কিন্তু তিনি কী কারণে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন, সেটাই মাথায় এল না তার।

সে বলল, “চিনি স্যার। তবে ওই মুখচেনা বলতে পারেন। তা হঠাৎ করে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন! কী ব্যাপারে?”

“বুধনের কেসটা তো তুমি জানো। মার্ডার ধরে নিয়েই তো আমরা এগুচ্ছি। ওঁর হেলথ সেন্টারেই তো ভর্তি হয়েছিল বুধন নামের ছেলেটি। ফলে ওঁর একটা স্বাভাবিক দায়িত্ববোধ থাকে। সেই জন্যই হয়তো কিছু বলতে চাইছেন। যাই হোক, বেশি দেরি করো না। এসো তুমি। এসে অন্তত শুনে যাও। পরের ব্যবস্থা পরে হবে!”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

বুধনের কেসটা সত্যিই একটা মিস্ট্রি! ফাইলবন্দি হয়েই পড়ে আছে। একটি ছেলে, যে সপ্তাহখানেক আগেই মৃত, সে কী ভাবে নিজের ঘরে থাকতে পারে, বাবা-মায়ের সঙ্গে এসে হেলথ সেন্টারে ভর্তি হতে পারে, তার উপর আবার বিরল কেস নিয়ে, এবং সেই রাতেই উধাও হয়ে যায়, গোটা ঘটনাটিই একটা ধাঁধার মতো। পুলিশের মধ্যে থেকে কেউ কেউ গোটা ঘটনাটিকে অলৌকিক আখ্যা দিলেও সুদীপ্তর যুক্তিবাদী মন কিন্তু বিষয়টিকে অলৌকিক বলতে মানতে নারাজ। কিছু একটা বাস্তব ট্রিকস আছে এবং কেউ বা কারা এই ঘটনাটিকে সাজিয়েছে নিজেদের মতো করে—এটাই সুদীপ্তর থিয়োরি। মালাকর সাহেবকে বলেছেও সে। যদিও তিনি মানতে নারাজ। সুদীপ্তও এখনই জোর গলায় কিছু বলতে পারছে না, কারণ ক্ল্যু নেই কোন। যদিও সে আশায় আশায় আছে, একদিন না একদিন কোনও না কোনও ল্যুফলস সে খুঁজে পাবে এবং সেই সূত্রেই ওই বাস্তব অ-বাস্তবের কেসটির সে সুরাহা করতে পারবে।

সত্যব্রত যদি সেই কারণেই কোন তথ্য বা সংবাদ দিতে আসেন, তাহলে তো ভালোই। এই কেসটা তার মনে কাঁটার মতো খচখচ করছে এখনও। যুক্তিগ্রাহ্য একটা সমাধান তো আছেই, কিন্তু কোন্‌ পথে এগোলে সেই সমাধানসূত্র মিলবে, সেটাই এখনও বুঝতে পারছে না সে।

যদিও সে ভেবেছিল আজ আর থানামুখো হবে না সে, কিন্তু এখন তার নিজেরই কৌতূহল হচ্ছে সত্যব্রত নামের মানুষটির সঙ্গে কথা বলার। দেখা যাক্‌, কোন গোপন ক্ল্যু তুলে দেন ডাক্তারবাবু।

উঠে পড়ল সুদীপ্ত। আর দেরি করে লাভ নেই। কোন না কোন সময় পিশাচপাহাড় রিসর্টের পার্টিরা এসে পড়বে। তখন তাকেই হয়তো তাদের নিয়ে মর্গে ছুটতে হবে। সে উঠে পুলিশি উর্দি গায়ে চাপাতে চাপাতে ভাবল, কী কুক্ষণেই না সে পুলিশে চাকরি করার স্বপ্ন দেখেছিল!—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content